বার্মিংহামে মসজিদ ই নূরের প্রতিষ্ঠাতা ক্বারি আব্দুল লতিফের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৮:১২ অপরাহ্ন
বার্মিংহাম থেকে বিশেষ প্রতিনিধি: বার্মিংহাম মুসলিম কমিউনিটির প্রবীন ব্যক্তিত্ব আস্টন ‘মসজিদ ই নূরের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ক্বারী আব্দুল লতিফ (ক্বারী সাব) বার্ধক্যজনীত রোগে গত শুক্রবার (১ নভেম্বর ২০২৪) ভোর ৩টা ২ মিনিটে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তিনি ৭ মেয়ে ১ ছেলে, স্ত্রী আত্মীয় স্বজন সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
মরহুমের নামাজে জানাজা গত রোববার ৩ নভেম্বর’২৪ বাদ জোহর মসজিদ ই নূর এ সম্পন্ন করা হয় পরে সুটন নিউ হল সেমিট্রি দাফন করা হয়।
তাঁকে নিয়ে লেখা সাংবাদিক মুহাম্মদ আতিকুর রহমানের একটি প্রতিবেদন: ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল বার্মিংহাম। লন্ডনের পরেই এই বার্মিংহামে সবচেয়ে বেশী বাংলাদেশীরা বসবাস করেন। এছাড়া পাকিস্তানি, সোমালীসহ বার্মিংহামের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৭ ভাগ মুসলমানের বাস ইংল্যান্ডের মধ্যভূমি হিসেবে খ্যাত এই নগর বার্মিংহামে। রয়েছে আড়াই’শ থেকে তিন’শ এর অধিক মসজিদ। ইসলামের সুমহান ছায়াতলে এ অঞ্চলের মানুষ নিজেদের নাম লেখাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
বার্মিংহামের প্রায় প্রতিটি এলাকায় মসজিদ মাদ্রাসা রয়েছে কিন্তু ৬০/৭০ বছর আগে পরিস্থিতি কিন্তু এমন ছিলো না। অত্র অঞ্চলে সে সময় একটা মসজিদ পাওয়া ও অনেকটা্ দু:সাধ্য, দু:স্প্রাপ্য ছিলো। সেসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা যারা এদেশে এসেছিলেন জীবিকার তাগিদে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর খোদাভীরুতার কারণে আজ আমরা এতো এতো মসজিদ এই বার্মিংহামে পাচ্ছি। পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করতে পারছি। কিন্তু যারা এই সাদা চামড়ার দেশে ইসলাম প্রচার করে আমাদের জন্য এতো বিরাট কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে আমরা কী তাদের প্রকৃত সম্মান দিতে পেরেছি? মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেনো তাদের এই ত্যাগ কবুল করেন। আজ তেমন ই একজন কীর্তমানের কথা তুলে ধরব যিনি বাঙালিদের অন্যতম আবাসস্থল আস্টনে কাজ করে গেছেন নি:স্বার্থভাবে। গড়ে তুলেছেন বিশাল মসজিদ।
সময়টা ১৯৬১ সাল। আজ থেকে প্রায় ৫৯ বছর আগের কথা। সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল বিশ্বনাথ উপজেলার দশঘর সমেমর্দান থেকে জীবিকার তাগিদে সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে ক্বারী আব্দুল লতিফ আবাস গড়েছিলেন নগর বার্মিংহামে। এখন যেমন পুরো আস্টনেই বাঙালিদের আনাগোনা তখন কিন্তু পরিস্থিতি এমন ছিলো না। হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন বাঙালি ছিলেন এ এলাকায়। স্বাভাবিকভাবেই তিনি কাজ নেন একটি ফ্যাক্টরিতে।
অত্যন্ত খোদা ভীরু ক্বারী আব্দুল লতিফ কাজের প্রথম দিনই জোহরের সময় অজু করতে চাইলে সাদা চামড়ার ম্যানেজার তাকে স্রেফ জানিয়ে দেন এভাবে অজু করার নিয়ম তাদের এখানে নেই তাই তা করা যাবে না। দৃঢ়চেতা ক্বারী আব্দুল লতিফ বেঁকে বসলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে তাকে বললেন, মুসলমান হিসেবে নামাজ হচ্ছে তার অবশ্য কর্তব্য। নামাজ তাকে পড়তেই হবে। তার অবিচলতায় মন গললো ম্যানেজারের। তিনি অনুমতি দিলেন আজ থেকে মুসলমান কর্মীরা চাইলে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
এরপর এভাবেই চললো কিছুদিন। কিন্তু নামাজের সাথে যার সখ্যতা তিনি কী মসজিদ ছাড়া থাকতে পারেন? অনুভব করলেন এই এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ জরুরি। যেই ভাবা সেই কাজ। কাছের দু’একজনের সাথে আলাপ আলোচনা করে এক দু:সাহসিক কাজে হাত দিলেন। ১৯৬৩ সালে লিচফিল্ড রোডের একটি ঘরে শুরু করলেন অস্থায়ী মসজিদ। নাম দেয়া হলো জামাত এ মুসলিমিন। দীর্ঘ আট বছর ইমামতি করেন সোসাইটির ইমাম হিসেবে। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর মসজিদ স্থানান্তর করা হয় ২১২ ভিক্টোরিয়া রোডে। ইতিমধ্যে স্থায়ী মসজিদ নির্মাণের জন্য আবেদন জমা দেয়া হয় কাউন্সিলে। বেশ কয়েক বছর ভিক্টোরিয়া রোডে থাকার পর মসজিদ আবারো স্থানান্তর করা হয় ফ্রেডরিক রোডে ১০৯ নম্বর বাসায়। সেখানে কিছুদিন চলার পর ১৯৮২ সালে তা আবারো স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মসজিদটি নিয়ে যাওয়া হয় একই রোডের ১৫৮ নম্বর বাসায়। এর ঠিক দু’বছর পর স্থায়ী মসজিদের আনুমতিপত্র দেয়া হয়।
যেহেতু মসজিদ নির্মাণে বিশাল ফান্ড প্রয়োজন তাই এই ফান্ড কীভাবে ম্যানেজ হবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান ক্বারী আব্দুল লতিফ ও তার সহযোগিরা। সে বছর তিনি হ্জ্বে যান ব্রিটেনের ডিউজবেরী মারকাজের আমীর, ইউরোপের প্রখ্যাত মুবাল্লীগে ইসলাম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মুকতি সাহেবের সাথে। হজ্ব এর আনুষ্ঠানিকতা শেষে একদিন মসজিদে হারামাইনে বসে তিনি বার্মিংহামের মসজিদের অনুমতি প্রাপ্তির কথা জানান আব্দুল মুকিত সাহেবকে এবং মসজিদের জন্য একটি নাম দেয়ার ও প্রস্তাব করেন। সে প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে তিনি নাম ঘোষণা করেন মাসজিদ ই নূর। ক্বারী আব্দুল লতিফেরও নামটি বেশ পছন্দ হয়।
তারপর হজ্ব শেষে ফিরে লেগে পড়েন মসজিদ নির্মাণ কাজে। মসজিদের ফান্ড জোগাড় করতে চষে বেড়ান ব্রিটেনের বিভিন্ন প্রান্ত। একসময় ভিক্টোরিয়া রোডে বিশাল জায়গা নিয়ে নির্মিত হয় মসজিদ ই নূর। মসজিদ ই নূর আজো তার নূর ছড়িয়ে যাচ্ছে বার্মিংহামে।
ক্বারী আব্দুল লতিফের সাথে ছিলো ইসলামী স্কলারদের এক নিবিড় সম্পর্ক। আরশাদ মাদানী ব্রিটেনে বেড়াতে আসলে নিয়মিত তার আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন। এছাড়া বাংলাদেশের প্রখ্যাত সব বুজুর্গরাও তার নিমন্ত্রণে এসেছেন বেশ কয়েকবার।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দশঘর সমেমর্দান গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া ক্বারী আব্দুল লতিফের বাবা ছিলেন মৌলভী আব্দুল করিম।
এরকম শত শত মানুষ আছেন যারা নীরবে ইসলাম প্রচারে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা তাদের কয়জনের ই বা খবর রাখি? অথচ তাদের ত্যাগ তিতিক্ষার কারণেই এর সুফল ভোগ করছি আমরা বর্তমান প্রজন্ম।