‘৫ আগস্টের জন-আকাঙ্ক্ষাই একটি নতুন সংবিধানের বৈধতা দেয়’
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯:৫০:১৫ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান চিন্তক মাহফুজ আলম। নতুন সরকারে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিশ্রুত রাষ্ট্র সংস্কার, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও সংবিধান পুনঃপ্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে সম্প্রতি ইত্তেফাকের সঙ্গে কথা বলেছেন মাহফুজ আলম। সাক্ষাতকার নিয়েছেন আবির হাকিম ও নেছার উদ্দিন।
ইত্তেফাক: নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সংস্কারের কথা বলেছেন আপনারা। সেই সংস্কার কেমন হবে?
মাহফুজ আলম: বিগত ১৫ বছরে দেশের রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সব কিছুতেই সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রাথমিকভাবে সরকার ছয়টি রিফর্ম কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্য দিয়ে জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সংবিধান, ইলেকশন সিস্টেম ও জুডিশিয়ারি—এই ছয়টি প্রতিষ্ঠানের সংস্কার হবে।
ইত্তেফাক: রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে আপনারা কত সময় নিবেন?
মাহফুজ আলম: সংস্কারের ধরন অনুযায়ী এই সরকারের মেয়াদ নির্ধারিত হবে। আমরা কী স্বল্পমেয়াদী সংস্কার চাই, নাকি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চাই? সরকার, কমিশন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলো থেকে সংস্কারের যে প্রস্তাবনা আসবে সেগুলোর বিবেচনায় সংস্কারের সময় নির্ধারণ হবে। তবে জনগণের বৃহত্তর একটি অংশ যেহেতু এই সরকারের সঙ্গে আছে সেহেতু আমরা দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের কথাই বলব। স্বল্পমেয়াদী সংস্কার হলো ব্যক্তির বদলে ব্যক্তিকে নিয়ে আসা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, দৃষ্টিভঙ্গিগত সংস্কার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। যেহেতু জনগণ আমাদের একটি সুযোগ দিয়েছে আমরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার করতে চাই।
ইত্তেফাক: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কেমন হবে?
মাহফুজ আলম: নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত শুধুমাত্র রাজনৈতিক না। আমরা এর মাধ্যমে বুঝাচ্ছি রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত যত ধরনের বিষয় আছে সবকিছুর বন্দোবস্ত। ফ্যাসিস্টের যে ভাবাদর্শ, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে এই তিনটি ব্যবস্থাকে বিলোপ করতে হবে। এই তিনটি ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন ঘটাতে হবে। সামগ্রিকভাবে আমরা এটিকে বলছি, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এগুলোর ভিত্তিতে অন্যান্য প্রয়োগিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত যেমন, নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান নির্ধারিত হবে। এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত শুধুমাত্র ক্ষমতার পালাবদলের জন্য না, বরং ক্ষমতাকাঠামোর পালাবদলের জন্য। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এই বন্দোবস্তে থাকা প্রয়োজন। সেজন্য আমাদের জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে। আমরা যদি শুধু ক্ষমতার পালাবদলের উপায়গুলো ঠিক করি, তবে তা নতুন বন্দোবস্ত হবে না। আমরা যদি নতুন বন্দোবস্তকে নিরঙ্কুশ করতে পারি, তবে যে দলই ক্ষমতায় আসুক পরাজিত শক্তির বন্দোবস্ত কখনোই আর ফিরে আসবে না।
ইত্তেফাক: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কী সংবিধান পুনর্লিখন করতে পারে? সরকারের সেই ম্যান্ডেট আছে?
মাহফুজ আলম: অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে পুরাতন সংবিধানের আলোকে সরকার যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন হয়, সে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি। ভিন্ন একটি প্রক্রিয়া এখানে অবলম্বন করা হয়েছে। সংবিধান-বহির্ভূতভাবে এই গণঅভ্যুত্থান সরকার হটিয়েছে। পুরাতন সংবিধান ৫ আগস্টই বাতিল হয়ে গেছে। এখন মূলত একটা ধারাবাহিকতার জন্য সংবিধানকে ফলো করা হচ্ছে। ৫ আগস্টের জন-আকাঙ্ক্ষাই একটি নতুন সংবিধানের বৈধতা দেয়। সংবিধান পুনঃপ্রণয়নের জন্য আলাদাভাবে কোনো ম্যান্ডেট প্রয়োজন নেই।
ইত্তেফাক: সংবিধানে কী কী পরিবর্তন চান?
মাহফুজ আলম: বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সংবিধান লেখার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার অনেকগুলো উপকরণ আছে। গণআলোচনার ভেতর দিয়ে আমরা সেই উপকরণগুলো বুঝতে পারব। একটি জিনিস নিশ্চিত করতে হবে, সংবিধান ৭২ সালে যেভাবে একচ্ছত্রভাবে আওয়ামী লীগ কর্তৃক লিখিত হয়েছে এটা যাতে এবার না হয়। সংবিধান পুনঃপ্রণয়নের মধ্য দিয়ে যাতে জনগণের বৃহত্তর অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় তা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। জনগণের বৃহত্তর অংশের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে সংবিধান। এছাড়া যেগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকারসম্মত মৌলিক মানবাধিকার প্রশ্ন আছে ঐগুলো একই থাকবে। জনগণের বৃহত্তর অংশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোর সংলাপের ভিত্তিতে এটা নির্ধারিত হবে।
ইত্তেফাক: আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা আছে কী না?
মাহফুজ আলম: এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নেই। তবে যে ভাবাদর্শ দেশের নাগরিক হত্যার ন্যায্যতা তৈরি করে সেই ভাবাদর্শ আমাদের প্রয়োজন নেই। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেই ভাবাদর্শ আমরা রাখব কী না? যে ছাত্র সংগঠন তার সহপাঠীদের হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে সেই ছাত্র সংগঠন আমরা আর রাখব কী না? এই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এই ভাবাদর্শের রাজনীতি করে মানুষের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে তাদের প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা হবে। আওয়ামী লীগ যেভাবে ইচ্ছে সংগঠিত হোক, তবে আওয়ামী লীগের ব্যানারে সংগঠিত হওয়ার নৈতিক অধিকার তাদের নেই।
ইত্তেফাক: শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির রূপরেখা কেমন হবে?
মাহফুজ আলম: শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি থাকবে। তবে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি আমরা চাই না। ছাত্ররাজনীতির রূপ কেমন হবে তা আলোচনার বিষয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে ছাত্ররাজনীতির রূপ কেমন হবে। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যে ধরনের আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিয়েছে তার ভিত্তিতে ছাত্রসংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ সক্রিয় করতে হবে।
ইত্তেফাক: এখন পর্যন্ত এই সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতাগুলো কী?
মাহফুজ আলম: সরকারের একজন অংশীদার হিসেবে বলতে পারি, সরকার নিয়মিত চেষ্টা করছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে। সরকারের কিছু সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে, যেহেতু এই সরকার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মনোনীত। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শক্তি পরাজিত হয়েছে। যেহেতু ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট শক্তি রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান করছিল তাই রাষ্ট্রকে সচল করার জন্য সময় লাগছে। জনগণের জীবনমান উন্নয়ন, মানবাধিকার ও তাদের শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য যতগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার তা করতে সরকার নিয়মিত চেষ্টা করছে। দেশি ও বিদেশি অনেকগুলো চক্রান্তের জন্য সরকারের এই সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক সহযোগিতা পেলে সরকার এই সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারবে।