ইসি পুনর্গঠন যেভাবে হবে, স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পরামর্শ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৫১:২১ অপরাহ্ন
অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে বিদ্যমান আইনকে বাতিল করতে হবে
অনুপম নিউজ ডেস্ক: গত বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর পরই সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটিতে শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে নতুন কমিশন গঠন নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া, কমিশনকে শক্তিশালীকরণ এবং সর্বোপরি একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ কী হতে পারে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। সেজন্য নির্বাচন কমিশন নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার এবং কমিশনের ক্ষমতাও বাড়াতে হবে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি তথা সার্চ কমিটি গঠন করতে হয়। এ কমিটিতে আপিল বিভাগের একজন বিচারক ছাড়াও আর যারা থাকেন, তারা হলেন—প্রধান বিচারপতি মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক; বাংলাদেশের মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক; সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। তবে ওই দুই বিশিষ্ট নাগরিকদের মধ্যে একজন হবেন নারী।
আইনে বর্ণিত যোগ্যতা-অযোগ্যতা বিবেচনা করে এ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের উদ্দেশ্য মোট ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। অর্থাৎ, প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে তারা। ওই ১০ জনের মধ্য থেকেই পাঁচজনকে নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। এক্ষেত্রে কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পেশ করতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে কয়েকটি যোগ্যতার কথা উল্লেখ আছে আইনে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স হতে হবে ন্যূনতম ৫০ বছর। এ ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধাসরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
আর অযোগ্যতা নিয়ে ছয়টি বিষয় উল্লেখ আছে। সেগুলো হলো—আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে, দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩ বা ‘বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার, ১৯৭২’-এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে এবং আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ছাড়া প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।
২০২২ সালে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে জাতীয় সংসদে এই আইন পাস করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই সময় থেকেই আইনটির বিরোধিতা করে আসছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তবে এর আগে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আলাদা কোনো আইন ছিল না। ওই বছরই নতুন কমিশন গঠনের আগে ওই আইন প্রণয়ন করা হয়। আর সেই আইনের অধীনেই প্রথমবারের মতো কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কমিশনের অধীনেই চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যেই একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। একই সঙ্গে সদ্য বিদায়ী আউয়াল কমিশনকে সরকারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সমালোচকরা বলছেন, নিজেদের নিয়োগ করা আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের ওপর ভর করেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করে নেওয়ার চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগ। আর সেটি সাময়িকভাবে সফল হলেও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জন্য বুমেরাং হয়েছে। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পরবর্তী নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্য হল, তারা সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে চায়। কিন্তু সেই যৌক্তিক সময়ের মেয়াদ কত, অর্থাৎ কবে নাগাদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার গঠিত হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর জানার কৌতূহল সবার। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার পদত্যাগ করেছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। কিন্তু বিদ্যমান আইনে কোনো নির্বাচন আয়োজন করার প্রধান শর্ত হল নির্বাচন কমিশন থাকা।
এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে বর্তমান আইন মানতে হবে নাকি ওই আইনকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোনো উপায়ে কমিশন গঠন করার সুযোগ আছে? জানতে চাইলে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার একটি গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে যে আইন রয়েছে, সেটি ত্রুটিপূর্ণ। আর যে সংসদে আওয়ামী লীগ ওই আইন পাস করেছিল, সেই সংসদও ছিল ত্রটিপূর্ণ ও বিতর্কিত। সেজন্য একটি শক্তিশালী কমিশন গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে বিদ্যমান আইনকে বাতিল করতে হবে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। সেখানে কমিশনকে কীভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, সে বিষয়টিও উঠে আসবে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে যেভাবে সার্চ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, সেটি নিরপেক্ষ নয়। কারণ, সরকারি বিভিন্ন পদে যারা থাকেন তারা মূলত ক্ষমতাসীন দলের দ্বারাই নিয়োগ করা। সে ক্ষেত্রে তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন না। যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, সেটি হতে হবে স্বচ্ছ। অর্থাৎ সার্চ কমিটি প্রাথমিকভাবে কাদের নাম প্রস্তাব করেছে এবং শেষ পর্যন্ত কাদের নিয়োগ করা হয়েছে, সেটি জনগণের জানা উচিত। প্রাথমিক তালিকা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে জনগণ জানতে পারবে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন আইন অনুযায়ী সার্চ কমিটি যেসব নাম প্রস্তাব করে, সেগুলো সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা থাকে না।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু গাইডলাইন আছে। বিভিন্ন দেশে এসব গাইডলাইন কিংবা রীতি অনুসরণ করা হয়। আর সার্চ কমিটিতে যারা থাকবেন তারা হবেন নিরপেক্ষ। সার্চ কমিটি নিরপেক্ষ না হলে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা যাবে না। যাদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা হবে, তাদের বিষয়ে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান করা দরকার। তাদের অতীত কেমন, পেশাগত জীবন কেমন ছিল ইত্যাদি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।