অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস, কী পরিবর্তন হল?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৫৭:১৮ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস। পাহাড় সমান প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের। তবে দুর্নীতি-অনিয়ম ও দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ, অর্থনীতি থেকে শিক্ষা-সব ক্ষেত্রে যে কঙ্কাল রেখে গেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার- তার সমাধান স্বল্প সময়ে কঠিন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জিল্লুর রহমান মনে করেন, ‘আমরা সুশাসনের সম্পূর্ণ ধসে আক্রান্ত হয়েছিলাম। ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার আক্রান্ত হয়েছিলাম। সেক্ষেত্রে সংস্কার শব্দটি একমাত্রিক করলে চলবে না। রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং যারা ক্ষমতায় থাকবেন, তারা ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করছেন, সেটার-ও সংস্কার দরকার।
রাজনৈতিক গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘আমরা যে ধরনের রাজনীতিতে অভ্যস্ত, এজন্য-ই তিন মাস, ছয় মাস, দশ বছর কথাগুলো আসছে। আর কিছু কিছু লোকজন-তো পাগল হয়ে গেছেন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। রামের বদলে রহিম সংসদ ভবনে যাবে। এইযে ৩৫০ জনের যে মালিক সমিত, তার সদস্য হবে। কিন্তু এতে আমার লাভ কি, আপনার লাভ কি? তো সেজন্য-ই সংস্কারটা দরকার।’
তবে কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র সংস্কারের রোডম্যাপ দ্রুতই নির্ধারণ করা জরুরি বলে মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। কেননা এরইমধ্যে নানা পক্ষ নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করে সুযোগ নিতে শুরু করেছে।
মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, অনেকগুলো পাওয়ার সেন্টার রয়েছে। যেমন, আমলাতন্ত্র একটা পাওয়ার সেন্টার। কিছু রাজনৈতিক দল আছে, সেগুলো পাওয়ার সেন্টার। এরপর ছাত্ররা একটা পাওয়ার সেন্টার। সেনাবাহিনী একটা পাওয়ার সেন্টার। সুতরাং পরিস্থিতি অস্থির।
এদিকে, এমন পরিস্থিতি অস্থির নিয়ে জিল্লুর রহমান বলেছেন, বিভিন্ন জন অ্যাক্টিভ রয়েছেন। প্রত্যেকের প্রয়োজনগুলো মেটাবার প্রয়োজন রয়েছে। তাই, এগুলো সুষ্ঠুভাবে একটা সার্বিক পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এমন নয় যে প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতার কেন্দ্র অনেকগুলো হলো। এটাতো এক ধরনের বিশৃঙ্খলার দিক হয়।
অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রকাশে এরইমধ্যে কমিটি গঠন করেছে সরকার। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণসহ অর্থনীতিতে আস্থা ফেরাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ সাবেক তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুরের। গুরুত্ব দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি জোরদারের ওপর-ও।
হোসেন জিল্লুর বলছেন, গণহত্যা-গুম, খুন-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগের দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন সৃষ্টি করতে হবে। ঢালাও মামলা যেন এসব কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে।
আক্রোশ ও বিভাজনের রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শও বিশ্লেষকদের। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরো সহনশীল হয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার অনুরোধ তাদের।
এক মাসে পরিবর্তন
অহিংস কোটা সংস্কার আন্দোলনকে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিকে নিয়ে যায় বিগত সরকার। গোটা দেশে ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরিয়ে গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা।
মুক্তির মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে তিন দিন পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ছাত্র-জনতার মূল দাবি, রাষ্ট্র সংস্কারই হয়ে ওঠে সরকারের লক্ষ্য।
দায়িত্ব গ্রহণের আগের তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। নতুন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল এই নৈরাজ্য ঠেকানো। সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকের পর ১১ আগস্ট থানায় ফেরা শুরু করেন পুলিশ সদস্যরা। বিগত সরকারের আইজিপি থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের অবসরে পাঠিয়ে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়।
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়েও শুরু হয় ব্যাপক রদবদল। স্বৈরাচারী সরকারের নিয়োগকৃত চুক্তিভিত্তিক সব সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় ড. ইউনূসের সরকার। সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়, দফতর ও অধিদফতরের দায়িত্বে আসে নতুন মুখ।
১০ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের নিয়োগকৃত প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আগের নিয়োগ বাতিল করে সারা দেশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ২২৭ জন আইনজীবীকে নতুন নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে গত এক মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। খালি রয়েছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। এখন যেন একটু ফ্রন্ট ফুটে বাংলাদেশ। বিএসএফের গুলিতে মৌলভীবাজারে স্বর্ণা দাস নামে এক কিশোরী হত্যায় দিল্লিকে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। ফেনীর আকস্মিক বন্যার কারণও জানতে চাওয়া হয় ভারতের রাষ্ট্রদূতের কাছে। এছাড়া জাতিসংঘের গুমবিরোধী যে সনদে শেখ হাসিনা সরকার দীর্ঘদিন স্বাক্ষর করেনি তাতে সই করে অন্তর্বর্তী সরকার। আর জুলাই আন্দোলনের সময় বিক্ষোভ করে আরব আমিরাতে সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশিকে মুক্তির বিষয়ে দেশটির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে ক্ষমার ব্যবস্থা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা নতুন সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বেশিরভাগ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের সরিয়ে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভোক্তাদের কষ্ট কমাতে নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে সরকার।
আন্দোলনের ফলস্বরূপ গঠিত নতুন সরকার নিজেরা গত মাসে অনেকগুলো আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছে। সংখ্যালঘু নিরাপত্তা আন্দোলন, এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল, পোশাক শ্রমিক আন্দোলন, রিকশাওয়ালা ও ডাক্তাররা নানা দাবিতে নেমেছিল আন্দোলনে। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সেগুলো সুরাহা হয়। তবে বেগতিক দিকে মোড় নেয় আনসার আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি হয়ে সে আন্দোলন প্রতিহত করে। তবে আন্দোলনের মাঠ থেকে উপদেষ্টা হওয়া আসিফ মাহমুদ বলছেন, আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।