ব্রিটিশ পাসপোর্টসহ যা সঙ্গে নিয়েছিলেন বিচারপতি মানিক ওরা নিয়ে গেল
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ২:০৮:০৩ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এ সময় সঙ্গে নিয়েছিলেন নগদ ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা, ব্রিটিশ পাসপোর্টসহ ব্যক্তিগত বিভিন্ন সামগ্রী। তবে শেষমেশ বিজিবির হাতে আটক হতে হয় তাকে।
শুক্রবার (২৩ আগস্ট) ওই সীমান্ত এলাকা থেকে রাত ১১টা ২০ মিনিটে আটক হয় সাবেক এ বিচারপতি।
পালিয়ে যাওয়ার জন্য যাদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, তারাই নগদ সব টাকা নিয়ে তাকে একা ফেলে চলে যায়। তবে আটকের সময় বিজিবি তার কাছ থেকে নগদ ৪০ হাজার টাকা জব্দ করেছে বলে জানা গেছে।
আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ মালিক বলেন, আমার সাথে ব্রিটিশ পাসপোর্ট, বাংলা পাসপোর্ট, নগদ কিছু টাকা, ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ড ছিল।
আপনার সঙ্গে আর কী ছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে জানতে চাইলে সাবেক এই বিচারপতি বলেন, তেমন কিছু ছিল না। চল্লিশ হাজারের মতো টাকা ছিল। গতকাল ৬০-৭০ লাখ টাকার মতো ছিল। ওটা নিয়ে গেছে।
কে নিয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেগুলো ওই দুই ছোকরাই নিয়েছে। আমার সঙ্গে কিচ্ছু নাই, সব নিয়ে গেছে। আমি ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে আসছিলাম, ওই টাকা আমি তাদের দিয়েছি। কিন্তু পরে ওই দুই ছেলে আমাকে মারধর করে সব নিয়ে গেছে।
তাকে আটকের পর ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন তাকে জিজ্ঞাসা করছেন, আপনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন কেন? তখন বিচারপতি মানিক বলেন, প্রশাসনের ভয়ে পালিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। এসময় অপর পাশ থেকে একজন জিজ্ঞাসা করেন, আপনি তো অনেক জুলুম করেছেন। তখন তিনি বলেন, আমি কোনো জুলুম করিনি।
এর আগে, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করায় সাবেক এই বিচারপতির বিরুদ্ধে নোয়াখালীর আদালতে মামলা করা হয়েছিল।
সোমবার (১৯ আগস্ট) বিকেলে জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল হাসান পলাশ বাদী হয়ে নোয়াখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ১নং আমলি আদালতে মামলাটি করেন।
কে এই বিচারপতি মানিক?
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দীর্ঘদিন ধরেই দেশে বেশ আলোচিত। নানা কারণে তুমুল সমালোচিতও তিনি। সবশেষ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে নারী উপস্থাপিকার সাথে বাজে আচরণ করে আবার আলোচনায় আসেন। ওই অনুষ্ঠানে নারী উপস্থাপিকাকে রাজাকারের বাচ্চা বলে সম্বোধন করেন। আবার যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল বা সংস্কার চায় সেসব শিক্ষার্থীরাও রাজাকারের বাচ্চা বলে মন্তব্য করেন এই সাবেক বিচারপতি।
চৌধুরী মানিক সম্প্রতি বিতর্কিত হননি। তিনি দীর্ঘ প্রায় দুই দশক ধরে নানা কাজে বিতর্ক তৈরি করেছেন। আর এসব বিতর্কের কারণেই তিনি এত পরিচিত।
ইন্টারনেটের বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, চৌধুরী মানিক ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন জীবন শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। এরপর ২০০১ আওয়ামী লীগ সরকার তাকে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে হাইকোর্টে নিয়োগ দেন। তবে ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপি তার নিয়োগের বিষয়টি সমর্থন করেনি।
জানা যায়, ২০০৩ সালে ট্র্যাফিক পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তার গাড়ি দেখেও স্যালুট না করায় আদালত অবমাননার অভিযোগ করেছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সরকার হাইকোর্টে একজন পূর্ণ বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয় চৌধুরী মানিককে।
মানিকের বিরুদ্ধে নবম সংসদে নিন্দা এবং সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ তাকে একজন দুঃখবাদী বলে অভিহিত করেন। তিনি অভিযোগ করেন, মানিক ট্রাফিক সার্জেন্টদের হাইকোর্টের বিচারকের গাড়িকে সালাম না দেয়ার কারণে আদালতে কান ধরে উঠবস করিয়েছিলেন। বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিমানের ইকোনমি শ্রেণির টিকিট কিনে জোরপূর্বক বিজনেস শ্রেণির আসনে বসে ভ্রমণ করেছেন।
২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পদোন্নতি পান বিচারপতি মানিক। ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে তাকে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপরই আরও বেশি বিতর্কে জড়ান এই বিচারপতি। তিনি অবসরে যাওয়ার সময় তখনকার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার সাথে তার একটি গোপন কথোপকথন রেকর্ড করেন এবং কথোপকথনটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এর জের ধরে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মানিককে বিদায় সংবর্ধনা দেয়নি। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসও তার জন্য বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেনি। অথচ অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বিচারকদের জন্য বিদায় অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য রয়েছে। এছাড়া বার অ্যাসোসিয়েশন মানিকের বিরুদ্ধে রায়ে স্বাক্ষর না করাসহ ১৪ জন আইনজীবীকে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ করেছিল।
এছাড়া প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বিচারপতি মানিককে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়ায় তিনি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে প্রধান বিচারপতির অভিশংসনের আবেদন করে বিতর্কিত হন।
সবশেষ সরকারি বাড়ির ভাড়া পরিশোধ না করার অভিযোগে বিচারপতি মানিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে দুদককে নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। একটি গণমাধ্যমের সংবাদকে উদ্ধৃত করে নোটিশে উল্লেখ করা হয়, অবসরে যাওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় রাজধানীর গুলশানে একটি সরকারি বাড়ি দখলে রেখেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
উল্লেখ্য, প্রয়াত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার শুনানির জন্য গঠিত আপিল বিভাগের বেঞ্চের সদস্য ছিলেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। আর বিচারপতি মানিক ইতোমধ্যে অবসরে গেছেন।
আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেখা যায়, সাঈদীকে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আমৃত্যু কারাদণ্ড দিলেও জামায়াতের এ নেতাকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন বিচারপতি মানিক। বিচারপতি মানিক তার রায়ে সাঈদীকে ফাঁসি দেওয়ার পক্ষে কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরেন। এছাড়া রায়ে বিচারপতি মানিক তার তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহকর্মী বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার রায়েরও তীব্র সমালোচনা করেন।