জেন-জি জেন-এক্স জেন-ওয়াই কারা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:২১:০৬ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশের মঞ্চে যুগপৎভাবে বদলেছে মানুষের জীবনধারণ ও দৃষ্টিভঙ্গি। পুরোনো জায়গায় নতুনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রগতিশীলতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ঐতিহ্যের ভিত্তি প্রস্তরে। সময়ের এই ধারাকে অব্যাহত রাখার তেমনি এক নিদর্শন “জেনারেশন জেড” বা “জেন-জি”। এই শব্দ যুগল যুগের চাহিদার সঙ্গে সমসাময়িক জীবনধারার সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে মানব সভ্যতার এক বিশাল শ্রেণীকে।
প্রতিটি প্রজন্মই আগের প্রজন্ম থেকে এগিয়ে থাকে। আর কিছুতে না হোক, প্রযুক্তিতে অবশ্যই। বর্তমান প্রজন্মের বাবাদের তারুণ্য ছিল রেডিওনির্ভর। কালক্রমে বিটিভি, ভিসিপি, ভিসিআর—শেষ পর্যন্ত কেব্ল টিভি চ্যানেল দেখে গেছেন। তাঁরা মুঠোফোন ভালো চালাতে জানতেন না।
একটু জেনে নেওয়া যাক বিভিন্ন প্রজন্মের নাম, তাঁদের জন্মের সময়সীমা ও বর্তমানে তাঁদের বয়সের মান।
গ্রেটেস্ট জেনারেশন বা মহত্তম প্রজন্ম: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯০১ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স অবশ্যই ৯৫ বছরের বেশি।
সাইলেন্ট জেনারেশন বা নীরব প্রজন্ম: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯২৮ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স ৭৯ থেকে ৯৪ বছর।
বেবি বুমার্স জেনারেশন: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স ৬০ থেকে ৭৮ বছর।
জেনারেশন এক্স: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স ৪৪ থেকে ৫৯ বছর।
জেনারেশন ওয়াই বা মিলেনিয়ালস বা সহস্রাব্দ প্রজন্ম: এঁদের জন্মকাল আনুমানিক ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। এবং এঁদের বর্তমান বয়স ২৮ থেকে ৪৩ বছর। এই প্রজন্মেরই যাঁদের জন্ম আবার ১৯৯০ সালের ভেতরে অর্থাৎ যাঁরা পুরো নব্বই দশকে তাঁদের শৈশব-কৈশোর পার করেছেন, তাঁদের বলা হয় নাইন্টিজ কিডস। এঁদের মা-বাবারা বেশির ভাগই বুমার্স ও জেনারেশন এক্সের সদস্য।
জেনারেশন জেড বা জেন-জি: এঁদের জন্মকাল ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এবং এঁদের বর্তমান বয়স ১২ থেকে ২৭ বছর। এঁদের মা-বাবারা মূলত জেনারেশন এক্স ও ওয়াইয়ের সদস্য।
জেনারেশন আলফা: এদের জন্মকাল আনুমানিক ২০১২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং এদের বর্তমান বয়স ০ থেকে ১২ বছর। এদের মা-বাবারা আবার জেনারেশন ওয়াই বা সহস্রাব্দ প্রজন্মের সদস্য।
একটু সবিস্তারে জেনারেশন জি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রথম প্রজন্ম
১৯৯৭ সালে চালু হয় প্রথম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাইট “সিক্স ডিগ্রি”। যেখানে ব্যক্তিগত প্রোফাইল তৈরিসহ ছবি আপলোড, শেয়ার এবং বন্ধুত্ব করা যেত। এরই বর্তমান রূপ এখনকার এক্স (যা আগে টুইটার নামে পরিচিত ছিল) এবং ইন্সটাগ্রাম।
এ প্রজন্ম স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের যুগ থেকে ফেসবুক ও ইউটিউবের যুগের রূপান্তরটা দেখেছে। সাক্ষী হয়েছে কাগুজে পত্রিকার ওপর নির্ভরতা এবং ধারাবাহিকের নতুন পর্বের জন্য পুরো সপ্তাহ ধরে অপেক্ষার অবসানের। স্ন্যাপ চ্যাট এবং টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর মতো দ্রুত, আকর্ষণীয় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ কন্টেন্ট স্বাদ দিচ্ছে তাৎক্ষণিক ইচ্ছে পূরণের। এই মনোভাব পরিচালিত করছে মনোযোগের দ্রুত পরিবর্তনের দিকে। এতে করে দ্রুতগতির জীবনধারায় পাল্টে যাচ্ছে বিনোদন, সামাজিকীকরণ, এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম।
বিশেষত প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলোর পাশাপাশি নতুন কোম্পানিগুলোও গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে তাদের মনস্তাত্ত্বিক নিরীক্ষণে। যোগাযোগ, লেনদেন ও প্রতিক্রিয়া জানানোর কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় অপরিহার্য পুঁজিতে পরিণত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মানুষের আচরণগত পরিবর্তনের সূত্রে সৃষ্ট এই বিপণন ব্যবস্থা পাল্টা অবদান রাখছে সেই আচরণকে বজায় রাখতে।
মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা
শিশু, তরুণ ও বৃদ্ধ নির্বিশেষে জেন জি’র প্রত্যেকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে ভীষণ সচেতন। উদ্বেগজনিত ব্যাধি, বিষণ্ণতা, বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যাগুলো নিয়ে এতটা খোলামেলা আলোচনায় আগে কখনও দেখা যায়নি। নিদেনপক্ষে পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলোতে এসব ব্যাপারে একরকম হীনমন্যতা ও ভয় কাজ করত। এখানে অনেকাংশে ভূমিকা পালন করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো। এগুলো নিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং তারকাদের উন্মুক্ত কথোপকথন মানসিক সমস্যা নিয়ে আলোচনাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে।
বিষয়টি শুধু আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। জেন জি সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেওয়াতে অভ্যস্ত। এর ধারাবাহিকতায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাস্থ্যগত সংস্থানগুলো, অভিজ্ঞ পরামর্শকেন্দ্র, এবং মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উদযাপন তারই দৃষ্টান্ত। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে কাজের সময়সীমা এবং পরিমাণ নির্ধারণের ব্যাপারেও আলাদাভাবে গুরুত্ব পায় কর্মচারীর মানসিক অবস্থা। এই সার্বিক ব্যবস্থার আঙ্গিকে পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও সমস্যাগুলো জনসমক্ষে উঠে আসে ইতিবাচকভাবে। একই সঙ্গে উত্তরণের জন্য থাকে মানসিক সমর্থন এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুস্থতা নিশ্চিতকরণের প্রচেষ্টা।
আর্থিক বিষয়গুলোর প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ
যুগ যুগ ধরে বাজারগুলোতে অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, এবং প্রাকৃতিক সম্পদে ঘাটতির মতো নিয়ন্ত্রণহীনতা সাক্ষী হয়েছে জেন জি। এমনি অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে তারা সংগ্রাম করতে দেখেছে মিলেনিয়াল বাবা-মাদের। আর্থিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বাস্তববাদিতা মূলত এরই ফলাফল। শুধুমাত্র ব্যয়ের চেয়ে সঞ্চয়কে অগ্রাধিকার দেওয়াই নয়, অর্থের সময় মানকে তারা ভীষণভাবে আমলে নেয়। তাছাড়া ২১ শতকের শুরু থেকে মুদ্রাস্ফীতি হারের উত্থান-পতন সতর্ক করে তুলেছে তাদেরকে। এগুলোর বিধ্বংসী প্রভাব তারা দেখেছে ছাত্র ঋণ, বাড়ি ভাড়া এবং নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যে। তাই তারা সবকিছুর ওপরে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে অগ্রাধিকার দেয়। তাছাড়া এদের মধ্যে আশাবাদী জনগোষ্ঠীরা জীবনের কৃতিত্ব হিসেবে আর্থিক স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়।
প্রতিনিয়ত বিকশিত প্রযুক্তির কারণে তারা অ্যাপ ও সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের ব্যয়, বাজেট কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। অর্থের সময় মূল্যকে টেক্কা দিতে অল্প বয়স থেকেই দেখা যায় বিনিয়োগের প্রবণতা। সবচেয়ে যুগান্তকারী বিষয় হচ্ছে, পূর্ববর্তী প্রজন্ম যেখানে ঋণের প্রতি দুর্বলতা ছিল, সেখানে জুমাররা ঋণের সুবিধাকে সর্বদা পাশ কাটাতে পছন্দ করেন। এই আর্থিক বিচক্ষণতা এমনকি তাদের ছোট ছোট ব্যয়ের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়।
ইন্টারনেটজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রিভিউ সাইটগুলো যেকোনো কেনাকাটার আগেই পণ্যগুলো নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গবেষণার প্রয়াস যোগায়। এই প্রয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি এবং চাকরি খোঁজা পর্যন্ত বিস্তৃত। তারা মূলত আর্থিক সচ্ছলতাকে কেন্দ্র করে একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাদের আগ্রহকে পরিচালিত করে। ফলে বাস্তববাদী শিক্ষা, অনলাইন সম্পদের ব্যবহার, বিনিয়োগ এবং উদ্যোক্তা সম্পর্কে জানার জন্য তারা ভিড় জমায় প্রাসঙ্গিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে।
ফ্রিল্যান্সিং বা গিগ কেন্দ্রিক কর্মপ্রবণতা
উদ্যোক্তা মনোভাব এবং আয়ের ছোট ছোট মাধ্যমের প্রতি আগ্রহী হওয়ার কারণে আই জেনারেশনকে “সাইড হাসেল জেনারেশন”ও বলা হয়ে থাকে। ইন্টারনেটকে কাজে লাগিয়ে ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিং-এর উত্থানটা হয়েছে মূলত এদের সময়টাতে। অধিকাংশ তরুণরা শুধুমাত্র অতিরিক্ত আয়ের জন্য নয় বরং ফুল-টাইম চাকরি হিসেবে এই কাজগুলোতে নিয়োজিত থাকে। প্রোজেক্টের সময়সীমাতে স্বাধীনতা থাকায় পড়াশোনার পাশাপাশি এই ফ্রিল্যান্সিং-এর প্রতি তাদের এক রকম আবেগ কাজ করে।
প্রযুক্তি নির্ভর ছোট ছোট দক্ষতা বা গিগ কেন্দ্রিক হওয়ায় প্রোজেক্টগুলোতে থাকে যথেষ্ট বৈচিত্র্য। পাশাপাশি সুযোগ থাকে নিজের পারদর্শিতাকে নিলামে তোলার মাধ্যমে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার। যেমন গ্রাফিক্স ডিজাইন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন, ভিডিও এডিটিংয়ের মতো কাজগুলো ঘরে বসেই দেশ-বিদেশের নানা ক্লায়েন্টদের নিকট জমা দেওয়া যায়। আপওয়ার্ক, ফাইভার, অ্যামাজন, ও ইটসি-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ফ্রিল্যান্সিংয়ের মূলধারার মার্কেটপ্লেস। এগুলোতে কাজ করার মাধ্যমে বেশ কম সময়ের মধ্যেই নিজেদের যোগ্যতা ও কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি করে নেওয়া যায়।
ক্লায়েন্ট খোঁজার পাশাপাশি নিজেকে রীতিমত একটি ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফেসবুক, এক্স, ইন্সটাগ্রাম, ও লিঙ্ক্ডইনের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সাররা ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড তৈরি করে বিশ্বব্যাপী কাঙ্ক্ষিত ক্লায়েন্টদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। সব মিলিয়ে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা ও স্বাধীনতার সন্নিবেশ ঘটায় এই মুক্তপেশা অচিরেই স্থলাভিষিক্ত হয়ে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী পেশাগুলোর জায়গায়।
এই কর্মব্যবস্থার ফলে সেন্টিনিয়ালদের মধ্যে নতুন দক্ষতা অর্জন ও ঘন ঘন সৃজনশীলতা চর্চার প্রবণতা দেখা যায়। বিশেষত এই চাঞ্চল্যতা শুধু কাজের জন্য নয়, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় মানসিক প্রশান্তি এবং অনলাইন নেটওয়ার্ক তৈরিতে। ফলশ্রুতিতে আই জেনারেশন কিছুতেই একক নিয়োগকর্তার উপর নির্ভর করতে রাজি নয়। বরং সুপ্ত উদ্যোক্তা মানসিকতা প্রতিনিয়ত তাদের ধাবিত করে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের দিকে।
বৈচিত্র্যমুখরতা ও সর্বস্তরের অন্তর্ভুক্তি
প্রগতিশীল তথ্য-প্রযুক্তি ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাঝে বেড়ে ওঠা জুমার শিশুরা পছন্দ করে বৈচিত্র্য। সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রথা, ও রীতি-নীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সব রকম প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে চায়। এই নিরিখে অবতারণা ঘটে সর্বস্তরের অন্তুর্ভুক্তিকরণ। বিশ্বায়নের এই যুগে নিঃশর্ত স্বাধীন মতামত গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটায়। এখানে স্থান, কাল, পাত্র, ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণী সবকিছুই উপেক্ষণীয়। বরং আই জেনারেশন প্রত্যেককে তাদের স্বতন্ত্র সত্ত্বা নিয়ে গ্রহণে বিশ্বাসী।
জেড প্রজন্ম বৈশিষ্ট্যগতভাবেই বাস্তববাদী এবং প্রায়োগিক জ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা মেনে চলে। তাদের মতে এমন কোনও ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে রাখা উচিত নয়, যা সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে। ইতিহাস যে কোনো উন্নয়নে সর্বস্তরের ভূমিকাকে সব সময় ঘোষণা দিয়ে এসেছে। এখানে এমনিক অনেক প্রান্তিক গোষ্ঠীর অগ্রগামী অবদান রেখেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জুমারদের দাবি থাকে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষের অন্তর্ভুক্তির। এতে শুধু বিচিত্রতাই আসে তা নয়, বরং এর মাঝে নিহিত থাকে ভিন্ন অভিজ্ঞতার আঙ্গিকে অভিনব ও ফলপ্রসূ ব্যবস্থা গঠনের সম্ভাবনা।
তাদের এই বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দাবি সামাজিক ও গণ যোগাযোগ মাধ্যমকেও সংযুক্ত করে। কেননা চলচ্চিত্র, টিভি শো এবং বিজ্ঞাপনের এই মাধ্যমগুলো বিচিত্রতার প্রসার ঘটাতে দ্রুত ও মোক্ষম ভূমিকা রাখে। ২১ শতকের শুরুতে বর্ণবাদের বিরোধিতা (ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার) সেন্টিনিয়ালদের বৈপ্লবিক পদক্ষেপের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
গেমিং ক্যারিয়ার
এক সময় কেবল বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ডিজিটাল নব্য নাগরিকদের যুগে রীতিমত পেশাগত দক্ষতা হিসেবে অভিভূত হয়েছে ভিডিও গেম। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে প্লে-স্টেশনের গেমিং কনসোল থেকে শুরু করে স্মার্টফোন পর্যন্ত বিভিন্ন গেমিং পরিষেবার পর্যাপ্ততা।
আই জেনারেশনের জন্য গেমিং কেবল একটি শখ নয়; এটি একটি সামাজিক কার্যকলাপ। ফোর্টনাইট, মাইনক্র্যাফ্ট, এবং অ্যামোং ইউয়ের মতো অনলাইন মাল্টিপ্লেয়ার গেমগুলোতে বাস্তব কমিউনিটি তৈরি করা যায়। এই কমিউনিটির খেলোয়াড়দের মধ্যে কথোপকথন ও গেমিং-এ পারস্পরিক সহযোগিতার সূত্রে তৈরি হয় বন্ধুত্ব। এই নেটওয়ার্ক শুধু স্ক্রিনেই আবদ্ধ থাকে না; বরং বাস্তব জগতেও তারা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে একত্রিত হয়।
জেড প্রজন্মের সৃষ্টি করা এই গেমিং ম্যানিয়া বর্তমানে ওয়েব কন্টেন্টের এক বিশাল পরিসর হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। ইউটিউব ও ফেসবুকে এখন প্রায়ই বিভিন্ন গেমের লাইভ স্ট্রিমিং, গেম রিভিউ, এবং জনপ্রিয় গেমারদের পডকাস্ট দেখা যায়। যে কোনও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের মতো এগুলোতেও গেমাররা ভক্ত ও অনুসারীদের সঙ্গে সরাসরি আড্ডায় অংশ নিতে পারে।
তাছাড়া জেন জি-এর অনেকেই জড়িত ছিল বিভিন্ন গেম ডিজাইন ও ডেভেলপার পেশায়। এই সম্পৃক্ততা পুরো জেনারেশন জুড়ে গেম ভিত্তিক পেশার উত্থান ঘটিয়েছে। এই পেশা তাদের উদ্যোক্তা মনোভাব ও ফ্রিল্যান্সিং প্রবণতা এবং স্বাধীন জীবনযাপনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বিশদভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
বাস্তবধর্মী শিক্ষা ব্যবস্থা
বৈশিষ্ট্যগতভাবে নেট জেন-এর আচরণের আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো বাস্তবসম্মত শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হওয়া। তত্ত্বীয় ও সময় সাপেক্ষ অধ্যয়নের ওপর অগ্রাধিকার পাচ্ছে কর্মক্ষেত্র-কেন্দ্রিক, তুলনামুলকভাবে স্বল্প পরিসরের কোর্সগুলো। পূর্ববর্তী প্রজন্ম যেখানে ৫ থেকে ১০ বছরের দীর্ঘ মেয়াদি অধ্যয়নে অভ্যস্ত ছিল, সেখানে জেড প্রজন্ম সর্বোচ্চ ৪ বছর মেয়াদি স্নাতকে সীমাবদ্ধ থাকে। অধিকাংশরাই বছরব্যাপী ডিপ্লোমা নিয়ে সরাসরি চাকরিতে প্রবেশের প্রচেষ্টায় নেমে পড়ে। এই পরিস্থিতি শিক্ষার সঠিক মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও ক্রমবর্ধমান টিউশন খরচ, ছাত্র ঋণ এবং চাকরির বাজারের টাল-মাটাল অবস্থার চাপে তা ধামাচাপা পড়ে যায়।
সঙ্গত কারণেই এই প্রজন্মদের নিকট অন-দ্যা-জব ট্রেনিং, ইন্টার্নশিপ এবং অনলাইন কোর্সগুলোর গুরুত্ব সর্বাধিক। এখানে আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে থাকে প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা এবং ব্যবসা। কোর্সেরা, ইউডেমি এবং খান একাডেমির মতো অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলোর চাহিদার বীজ বুনেছিল নেট জেনরাই। এগুলোর মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যের বিনিময়ে নিকট ভবিষ্যতে ক্যারিয়ারের লক্ষ্যটি দৃষ্টিগোচর হয়, যা জেন জি’দের সিদ্ধান্ত গ্রহণের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
‘ফিজিটাল’ বিশ্বের উত্থান
ভৌত বা “ফিজিক্যাল” এবং “ডিজিটাল”- এ দুটি শব্দের সংমিশ্রণে গঠিত হয়েছে “ফিজিটাল” শব্দটি, যা একটি অনন্য বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। জুমারদের সময়ে রাজকীয় আগমন ঘটেছে ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির, যেখানকার প্রতিস্ক্রিয়াগুলো ভৌত জগতের মতোই অর্থবহ।
কেবল বিনোদনই নয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এই যুগান্তকারী প্রভাব কেনাকাটা, পারস্পরিক যোগাযোগ, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ব্যবসা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। অনলাইন ও অফলাইনের এই দ্বৈত অভিজ্ঞতার ফলে জুমাররা মিলেনিয়ালদের তুলনায় দ্রুত চিন্তা করতে এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে।
তাছাড়া উন্নত প্রযুক্তির এমন সুযোগ-সুবিধার কারণে ছোট থেকেই তারা সৃজনশীলতা ও দ্রুততায় প্রতিযোগিতা করার পরিবেশ পায়। এই পটভূমিতে প্রাথমিক পর্যায় থেকে তাদের মস্তিষ্ক উদ্ভাবনী কল্পনা করার যথেষ্ট রসদ পায়, যা পূর্বসূরিদের ক্ষেত্রে ছিল কল্পনারও অতীত।
নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে একাধিক ডিভাইসকে একত্রিতকরণ প্রজন্মকে দিয়েছে সমন্বয় সাধনের অভাবনীয় ক্ষমতা। আই জেনারেশনের এই সময়টাতে বিশ্ব অভ্যস্ত হয়েছিল ব্লুটুথের মতো রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনায়। ফলে পরবর্তীতে অগমেন্টেড রিয়েলিটির (এআর) ব্যবহারের সময় খুব একটা বেগ পেতে হয়নি প্রযুক্তি-বান্ধব প্রজন্মকে।
ওপেন-টু-ওয়ার্ল্ড জেনারেশন
জেনারেশন জেডের দর্শনে সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর মানুষের অন্তর্ভুক্তির নেপথ্যের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে তাদের উদারতা। এক্স ও ওয়াই জেনারেশনে যেখানে জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখার সংকীর্ণতা দেখা যেত, সেখানে নেট জেন ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ারকে সুবিধার হিসেবে দেখে।
আগের প্রজন্মের কিশোর-তরুণরা ব্যক্তিগত ডায়েরি ব্যবহার করত শুধুমাত্র একান্তে নিজের সঙ্গে কিছু সময় কাটানোর জন্য। সেই ডায়েরি পড়ার কারও অধিকার ছিল না, এমনকি সেই জগতে কারও হস্তক্ষেপকে নিতান্ত অনুপ্রবেশ হিসেবে গ্রাহ্য হত। অপরদিকে জেন জি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে তাদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল সবাই দেখাতে পছন্দ করে। প্রত্যেকে নিজের স্বতন্ত্রতা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভার্চুয়াল জগতে তাদের জীবনধারাকে শেয়ার করে।
তাছাড়া এ জেনারেশনের সময়েই রেডিও, পডকাস্টসহ নানা সামাজিক মাধ্যমগুলোতে মুখরোচক হয়ে ওঠে ‘হটসিট’ শব্দটি। এই হটসিটে এসে তারকাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরাও নিজেদের জীবনের স্পর্শকাতর ঘটনাগুলো শেয়ার করে। এখানে শ্রোতা ও দর্শকদের ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সূত্রে অবতারণা ঘটে সম্ভাব্য সমাধানের। এই প্রাণবন্ত ও উন্মুক্ত মনোভাব দূরে থেকেও বিপুল পরিসরে দর্শকদের কাছাকাছি পৌঁছা যায়।
বহু বা মিশ্র সংস্কৃতির প্রতি উদারতা
আগের জেনারেশনগুলোতে সামাজিকতা এবং অর্থ-সম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব পেত নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর পরিমণ্ডল। এমনকি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা বেড়াজালে আবদ্ধ থাকত মিশ্র সংস্কৃতি বা সংস্কৃতির সহযোগ। সেন্টিনিয়ালরা সেখানে প্রতিটি পর্যায়কে দেখে স্কুলের ক্লাস ঘরের মতো। প্রাথমিক পাঠদানের সহশিক্ষার সাধারণ পরিবেশে শ্রেণী, ধর্ম, পেশা নির্বিশেষে সকলের সন্তান পাশাপাশি বসে ক্লাস করতে পারে। এখানে আসে না কোনও সার্বভৌমত্ব বা পারস্পরিক চুক্তির বিষয়। উন্নত শিক্ষা, অর্থনীতি, এবং শিল্প ক্ষেত্রে জেড প্রজন্মের চিন্তাধারাও ঠিক একই রকম।
অবশ্য সময়ের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন এবং নানা স্থানে যুদ্ধের ফলে ব্যবসায়িক অবনতির এখানে প্রভাব রেখেছে। ওয়াই জেনারেশন যেখানে স্বর্ণ সঞ্চয় ও বাড়ি কেনাতে অর্থ বিনিয়োগে ব্যস্ত, সেখানে জেন জি অভ্যস্ত হয়েছে ক্রিপ্টো-কারেন্সিতে। এখানে কখনও মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়নি ভিন্ন দেশীয় প্রযুক্তি উপেক্ষা করার ব্যাপারটি।
উচ্চশিক্ষা লাভে ঘন ঘন অভিবাসনের কারণে বেড়েছে দুই ততোধিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিদের একই ছাদের নিচে বসবাসের সুযোগ। জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে দেশের ভেতরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কো-লিভিং এবং কো-ওয়ার্কিং স্পেস। দেশে ও বিদেশে এই পরিবর্তনগুলোর মধ্য দিয়ে আই প্রজন্মরা নতুন অর্থ নির্ধারণ করেছে সামাজিকতার। এই বিবর্তন একটি কর্মদক্ষ ও বাজেট-বান্ধব ব্যবস্থা তৈরি করলেও বিলুপ্তির মুখে পড়েছে সমাজের ঐতিহ্যবাহী রীতি-নীতিগুলো।