বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শ্রমবাজার: মালয়েশিয়ার বিমান বন্দরে অপেক্ষমান হাজার হাজার কর্মী
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ৩০ মে ২০২৪, ৭:১৩:৪৮ অপরাহ্ন
মালয়েশিয়ার বিমান বন্দরে অপেক্ষমান হাজার হাজার কর্মী । ছবি: সংগৃহীত।
আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়া সরকারের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার (৩১ মে) এর পর থেকে আর কোনো বাংলাদেশি শ্রমিক মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করতে পারবে না।
এতে অপেক্ষমান কর্মীদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। সময় বৃদ্ধি না হলে প্রায় ৪০ হাজার অপেক্ষমান কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্স যোগে উল্টো পথ হয়ে বাংলাদেশি কর্মীরা ¯্রােতের ন্যায় মালয়েশিয়ায় প্রবেশ করছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কুয়ালালামপুরস্থ দু’টি আর্ন্তজাতিক টার্মিনালে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী পৌঁছে ফ্লোরে অবস্থান করছে। শেষ মুহূর্তে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে কর্মীদের উপচেপড়া ভিড়। এতে দুর্ভোগ বাড়ছে কর্মী ও নিয়োগকর্তাদের। নিজেদের কর্মী শনাক্তে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে নিয়োগকর্তাদের। আর দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে কর্মীদের।
এদিকে মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগ ৩০ মে বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দৈনিক বিদেশি কর্মীদের আগমন হয় ৫শ’ থেকে ১ হাজার মধ্যে। ২২ মে থেকে আগমনের সংখ্যা বাডতে শুরু করে। এ পরিস্থিতিতে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত ও যানজট নিয়ন্ত্রণে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত কাউন্টার খোলা হয়েছে ও অভিবাসন কর্মকর্তার সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও বিদেশি কর্মীদের পানি ও খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও জানানো হয় অভিবাসন কর্তৃপক্ষের বিবৃতিতে।
একটি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজার কর্মীর বর্হিগমন ছাড়পত্র ইস্যু হয়েছে। কর্মী প্রবেশের সময় আর মাত্র একদিন বাকি থাকায় বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীরা উল্টো পথে দুবাই, কাতার, চীন, হংকং, সিংগাপুর, ইন্দোনেশিয়া হয়ে ¯্রােতের ন্যায় দেশটিতে ঢুকছে।
অনেকের অভিযোগ, বিমানের টিকিটের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে সিন্ডিকেট চক্র মালয়েশিয়ার ৩০ হাজার টাকার ওয়ানওয়ে টিকিটের দাম এখন ৯৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে এসব দেখার কেউ নেই। এ ব্যাপারে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় নিরব ভূমিকা পালন করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্ধারিত ১০০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে এফডব্লিউ সিএমএস প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের দেশটিতে প্রবেশের সবশেষ সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয় ৩১ মে।
মালয়েশিয়া সরকারের অনুমোদিত বাংলাদেশি কর্মীদের ৩১ মের মধ্যে দেশটিতে প্রবেশের ডেডলাইন নির্ধারণ করার ফলে অপেক্ষমান কর্মীদের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার হিরিক পড়েছে। এ সুবাদে টিকিট সিন্ডিকেটের পরামর্শে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সগুলো ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে ওয়ানওয়ে টিকিটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছে। চড়া দাম দিয়েও হাজার হাজার মালয়েশিয়াগামী কর্মী টিকিট মিলছে না। চড়া দামের টিকিটের অতিরিক্ত টাকা যোগাতে যাত্রীরা হিমসিম খাচ্ছেন। বাংলাদেশে অপেক্ষমান মালয়েশিয়াগামী কর্মীরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রবাসী কমিউনিটি নেতা রাশেদ বাদল জানান, মালয়েশিয়া আমাদের জন্য অন্যতম বড় শ্রমবাজার হওয়ায় এই সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের বিরাট ক্ষতি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়া ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক প্রবাসী বলেন,সিন্ডিকেট চক্রের অনিয়ম দুর্নীতি এবং অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়ের কারণে ৩১ মের পর থেকে জনশক্তি রফতানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দালালদের হাত বদল হয়ে প্রায় চার থেকে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে কর্মীরা দেশটিতে যাচ্ছে।
বায়রার যুগ্ম মহাসচিব মো.ফখরুল ইসলাম ফোনে আলাপকালে বলেন, প্রায় ১০ লাখ কর্মীর মেডিকেল করেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশটিতে প্রবেশের সময় বৃদ্ধি না হলে প্রায় ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া গমনে অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। বায়রার যুগ্ম মহাসচিব বলেন, জাতিসংঘের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে শোষণের শিকার হচ্ছে। দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মীরা অস্থিতিশীল ও অসম্মানজনক অবস্থায় রয়েছে। শোষণকারী নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি অপর্যাপ্ত। বায়রা নেতা বলেন, ভবিষ্যতে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হলে কোনো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যাকে কর্মী নিয়োগ না হয় সে ব্যাপারে প্রবাসী মন্ত্রণালয়কে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। টিকিট সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে মালয়েশিয়ার প্রবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দাতুশ্রী কামরুজ্জামান কামাল বলেন, মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের টিকিট কয়েকটি এয়ারলাইন্স গতকাল থেকে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে মাত্র ৩০ হাজার হাজার টাকার টিকিটের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে কর্মীদের একটি টিকিট ১ লাখ ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। এটা বিদেশগামী কর্মীদের ওপর মারাত্মক জুলুম করছে বিমান কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেন, বিদেশের মাটিতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা রেমিট্যান্স আয় করে দেশে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন তাদের টিকিটের দাম এতো বৃদ্ধি করার নজির পৃথিবীর কোথাও নেই। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ এবং মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রবেশের সময় আরো এক মাস বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
তিনি বলেন, ইউএস বাংলা ঢাকা-কুয়ালালামপুর ওয়ানওয়ে টিকিট ১ লাখ ২ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। এটা ডাকাতি ছাড়া কিছু নয়। এক প্রশ্নের জবাবে কামরুজ্জামান বলেন, বিদেশগামী কর্মীদের টিকিটের মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো সংস্থা কি নেই ? তিনি বলেন, যেসব কর্মী ভিটেমাটি বিক্রি এবং ঋণ করে বিদেশে যাচ্ছেন তাদের লেবার ফেয়ার নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তিনি টিকিট সিন্ডিকেট চক্রের বিরুদ্ধে শা¯িতমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানান।
নানামুখী জটিলতায় ভুগছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। তবে কর্মী পাঠানো বন্ধ হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। নতুন করে কোটা পেতে দেশটির সাথে আলোচনা চলছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। প্রতিবছর লাখ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে রেমিট্যান্সের যোগান আসছে দেশটি থেকে। ২০২১ সালে দেশটির সাথে পারস্পারিক সমঝোতা চুক্তির পর আবারও চালু হয় কর্মী পাঠানোর কার্যক্রম। ২০২২ সালের ৮ আগস্ট থেকে নিয়মিতভাবে কর্মী যাওয়া চলমান থাকলেও পরিস্থিতি পুনরায় দোলাচলে। ২০২২ সাল থেকে এ যাবত দেশটিতে প্রায় সাড়ে চার লাখ কর্মী গেছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা ব্যয় করে চাকরি লাভ করেছে কর্মীরা। বিএমইটি জানায়, গত ১ মে থেকে গত ২০ মে পর্যন্ত ২১ হাজার ৮২৩৩ জন কর্মী মালয়েশিয়ায় বর্হিগমন লাভ করেছে।
সম্প্রতি দেশটির নানা বাধ্যবাধকতায় কর্মী পাঠানো নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। নানা প্রতিবন্ধকতায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে হুমকির মুখে বাংলাদেশসহ ১৫টি কর্মী প্রেরণকারী দেশ। এদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ইস্যুতে তৎপরতা বাড়িয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। যার অংশ হিসেবে সম্প্রতি একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তারা। যাতে মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করে যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে বলা হয়।
কিন্ত দেশটিতে কর্মী প্রবেশের সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের কোনো শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা কুয়ালালামপুরে যাননি। মালয়েশিয়া প্রবাসী ইমরান আহমদ বলেন, কর্মী গমনের সময় বৃদ্ধি না হলে অপেক্ষমান কর্মীরা জনপ্রতি প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে। একজন কর্মীকে দেশটিতে যাওয়ার জন্য ৫ থেকে ৬ মাস অপেক্ষা করতে গিয়ে আরো প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছে।
মালয়েশিয়ার নিউ স্ট্রেইট টাইমস জানায়, ১ জুন থেকে বর্তমান কোটার অধীনে নতুন কোনো শ্রমিক নেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দীন নাসুশন ইসমাইল। অপরদিকে, কোটা পদ্ধতিতে সংস্কার সাধনের পর এবং ৩০ জুন শ্রমিকদের আসার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন করে শ্রমিক নেয়ার ব্যাপারে চিন্তা করা হবে বলে জানিয়েছেন মানবসম্পদ মন্ত্রী স্টিভেন সিম।
এর আগে ২০২৫ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার মোট শ্রমিকের ১৫ শতাংশ অন্যান্য দেশ থেকে আগতদের জন্য নির্ধারিত করে দেশটির সরকার। মালয়েশিয়ার অভিবাসন বিভাগের তথ্যমতে, ১৫ মার্চ পর্যন্ত দেশটিতে ২০ লাখ বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন।