রূপা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ৭:১৬:৩৯ অপরাহ্ন
মনযূরুল হক
রূপা নামের একটি মেয়ে ছিল প্রতিবেশি। বোনটির নাম পিংকি। মা নিতান্ত সংসারী। বাবা টিউশন মাস্টার। কোনও এককালে স্কুল শিক্ষক ছিলেন। এখন শুধু টিউশনি করেন। দিনভর একটার পর একটা ব্যাচ পড়ান। আর কোনও আয়ের পথ জানা ছিল না তার। শ্যামলা ছোট-খাটো মানুষটিকে দেখলে ভারি ভালো লাগত।
রূপার মায়ের মুখটি ছিল দারুণ মিষ্টি। একটি স্বয়ম্ভর দরিদ্র হিন্দু পরিবারের ঘরনী যেমন হয়, ঠিক তেমন। রোজ সদাই থেকে একমুঠো করে চাল রাখেন হাড়িতে, দুটি করে পয়সা জমান মাটির ব্যাংকে, পুজা-পার্বণে খুব বেছে বেছে মেয়েদের জন্য কেনেন সস্তা দামের সুন্দর জামা। তারপর ভুবনজয়ী হাসি চোখে-মুখে লেপ্টে রান্নাঘরে আম্মুর পাশে বসে আনাজ কোটেন আর প্রাণ খুলে গল্প করেন।
কপালের টিপটি কখনও তার বাঁকা হতো না। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালা কিংবা উলুধ্বনি দেওয়ায় কোনও শরিক লাগত না। ঘরের কাজ একাই সামলে আম্মুর কখন কি দরকার—ছোটাছুটি করে সম্পন্ন করতেন আপন বোনের মতো। বাসার এত বেশি নির্ভরতা হয়ে উঠেছিলেন যে, আম্মু যখন জোহর নামাজ পড়তেন, তখন নিয়মিত আমাদের দুরন্ত হাসানকে সামাল দিতেন তিনি।
হাসানের বয়স তখন দুই কি তিন বছর। আমার বারো।
রূপার বাবার হাতে বিভিন্ন স্কুল থেকে পরীক্ষার খাতা-কাটার ভার আসত। প্রাইমারির ইসলামশিক্ষার খাতাগুলি তিনি আমার জন্য রেখে দিতেন। সপ্তাহ শেষে বাসায় এলে আমি তাকে মার্কিং করতে সাহায্য করতাম। রূপা পাশে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকত। আদুল গা। তাড়া দিত বারবার, যেন দ্রুত শেষ করে ওকে গল্প শোনাতে বসি। ওর মা দৌড়ে এসে একটা ফ্রক পরিয়ে দিতেন।
তারপর দুটি পেয়াঁজ কেটে মুড়িয়ে মাখিয়ে দিতেন, কিংবা নবান্ন শরবত নিয়ে হাজির হতেন। আমি বলতাম, এ তো মলিদা, আপনারা নবান্ন কেন বলেন? তিনি হাসতেন। ধীরে ধীরে পিংকিও এসে জুড়ত। আব্বু ইশার নামাজ পড়ে ঘরে ফেরার পর রাতের খাবারের ডাক এলে আমাদের আসর সাঙ্গ হতো।
আম্মু বাজারে যেতে বললে রূপাও সঙ্গে যেতে চাইত, হাত ধরে রাখত। আমার লজ্জা লাগত—আনখকেশ হুজুর আমি, কী করে একটি মেয়ের হাত ধরে হাঁটব। মাদরাসার অন্য ছাত্ররা দেখলে কেলেঙ্কারি হবে না! ওদের বাসায় মুর্গি রান্নার উদযোগ হলে ওর মা অবশ্যই আমাকে দিয়ে জবাই করাতেন, যেন পাতে দেওয়া দু-টুকরো গোশত ‘হারাম’ না হয়।
আটানব্বইর বন্যার বছর রূপা ক্লাস থ্রি পেরিয়ে ফোরে উঠল, পিংকি সিক্সে; যদিও গায়ে-গতরে পিংকিকে রূপার চেয়ে ছোট লাগত। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল, আমার ভেতর কৈশোরের চঞ্চলতা কাটছিল—নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, গানা-বেগানা বোধ আড়মোড়া ভাঙছিল। বাসায় গেলে ওদের এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। পিংকি আর আসছিল না। কিন্তু রূপা কিছুই বুঝছিল না—ফ্রক জড়িয়ে ছুটে আসত।
একদিন সন্ধ্যার পরে ওর মা এলেন আম্মুকে বলতে, যেন এ-বেলা তাদের ঘরে দুটি ডালভাত খাই। আমি বারান্দায় বসে বই পড়ছি। খাবার সময় নাচতে নাচতে রূপা আমাকে নিতে এলো। মনে আছে, ভাইয়া ভাইয়া করে হাত ধরে টানছিল। আম্মুও ঘর থেকে বলছিলেন, যেন গিয়ে খেয়ে আসি। কিন্তু আমি ভীষণ দোটানায় পড়ে গেলাম—যাব কি যাব না, উচিত হবে কি হবে না। ওর বাবাও বারান্দা থেকে আমার নাম ধরে ডাকলেন। শেষে না পেরে রূপাকে বললাম— তুমি গিয়ে বলো, ভাইয়া হিন্দুদের ঘরে খায় না।
মনে হলো, এক মুহূর্তে আকাশ-বাতাস থমকে গেছে। রূপা চুপচাপ চলে গেলো। ওর বাবাও আর ডাকলেন না। আমিও রাতে কিছু খেলাম না। সকালে উঠে মাদরাসায় চলে গেলাম। পরের সপ্তাহে বাসায় এসে আর ওদের পেলাম না। আম্মু বললেন, ওরা গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। বাসা ছেড়ে দিচ্ছে বলেই সেদিন নিমন্ত্রণ করেছিল।
আর কোনওদিন ওদের দেখা পাই নি। বহুদিন পরে শুনেছি, ওর বাবার কোনও এক মন্দিরে চাকরি হয়েছে। পিংকির বিয়ে হয়েছে এক শ্বেতশুভ্র ঠাকুরের সঙ্গে।