কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্য: দুদকের দুই কর্মকর্তাও ডলারে ঘুষ লেনদেন চক্রে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫১:২৮ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: দেশের কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার সেলের সিস্টেম অ্যানালিস্ট এ কে এম শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটির সনদ বাণিজ্যে জড়িতদের নাম।
এমনকি শামসুজ্জামান নিজে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা থেকে রেহাই পেতে সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে ডলারে ঘুষ দিয়েছেন। এ ঘটনায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খানকে ওএসডি করা হয়েছে।
শামসুজ্জামান পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায়, পরে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে সনদ বাণিজ্য ধামাচাপা দিতে কারা, কীভাবে তাঁর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন, তা বিশদ জানিয়েছেন।
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান জানান, অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের উপপরিচালক আলী আকবর তাঁকে নোটিশ দেন ও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর পর মামলা হলে রেহাই পেতে তিনি দুদকের আরেক উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় আবু বকর তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করার কথা জানিয়ে ৬০ লাখ টাকা দাবি করেন। শামসুজ্জামান টাকা দিলে বদলে যায় তদন্ত কর্মকর্তা। সহকর্মী আবু ফজলের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল আবু বকরের। সেই সূত্রে তাঁর কাছে যান শামসুজ্জামান।
ডিবির ভাষ্য, শামসুজ্জামান ৬০ লাখ টাকা জোগাড় করার পর আবু বকরকে ফোন করেন। ফোনে টাকা-পয়সা নিয়ে খুব একটা আলাপ হতো না। কারণ আবু বকরই নিষেধ করেছিলেন। এক রাতে আবু বকরের বাসায় ৬০ লাখ টাকা নিয়ে হাজির হন শামসুজ্জামান। কিন্তু আবু বকর এগুলো ডলার করে দিতে বলেন এবং নিজে মতিঝিলের একটি মানি এক্সচেঞ্জের ঠিকানাও দেন। পরদিন সেখান থেকে টাকাগুলো ডলার করে দুদক কার্যালয়ে গিয়ে আবু বকরকে দিয়ে আসেন শামসুজ্জামান। তখন আবু বকর ফাইল দেখিয়ে বলেছিলেন, আপনার মামলায় গোলাম মাওলা তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন।
ডিবি সূত্র জানায়, দুদক কর্মকর্তা গোলাম মাওলা বিভিন্ন সময় তথ্য চেয়ে শামসুজ্জামানকে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় ডাকতেন। দোকান থেকে চা নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটির সময় কাগজপত্র নিতেন। এভাবে বিভিন্ন সময় তিনি ৩, ৫ ও ১০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। শামসুজ্জামান ও গোলাম মাওলাকে বাড্ডার বাসায় ডেকে নিয়ে প্রায়ই কথা বলতেন আবু বকর। গোলাম মাওলা ঠিকই শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেন। প্রতিবেদন দেওয়ার দিনও ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে শামসুজ্জামান জানিয়েছেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, আবু বকর আশির দশকে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে যোগদান করেন। গত ২৯ জানুয়ারি তিনি অবসরে গেছেন। উপপরিচালক গোলাম মাওলার ‘দুর্নীতির হাতেখড়ি’ আবু বকরের কাছেই। ২০১৪-১৬ সাল পর্যন্ত দুদকের পাবনা অফিসে আবু বকরের অধীনে সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি। বর্তমানে গোলাম মাওলা দুদকের পিরোজপুর কার্যালয়ে কর্মরত।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ডিবির দায়িত্বশীল কয়েক কর্মকর্তা জানান, সনদ বাণিজ্য চক্রে কারা জড়িত এবং কীভাবে কাজটি করা হতো, তা বিস্তারিত জানিয়েছেন শামসুজ্জামান। তিনি বলেছেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিবিএ নেতা ও সনদ শাখার কম্পিউটার অপারেটর আব্দুল বাছেদ শত শত সনদ করাতেন। রেজিস্ট্রেশন শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রামার মামুন-উর রশীদও জড়িত। তিনি শিক্ষার্থীর নাম পরিবর্তন ও নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলতেন। তবে মামুন টাকা শামসুজ্জামানকে দিতেন না। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে টাকা নিজেই নিতেন। অফিসের শামসুল আলম ও উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া পরীক্ষার্থীদের নম্বর বেশি দিতে চাপ দিতেন। তারাও শামসুজ্জামানকে টাকা দিতেন না। টাকা চাইলে তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করতেন। শামসুজ্জামান জানান, তিনি এ কাজ শিখেছেন বোর্ডের অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যানালিস্ট শামসুল আলমের কাছে। শামসুল হাজার হাজার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সনদ অনলাইনে নিখুঁতভাবে দিয়েছেন। এ ছাড়া ১২৮ শিক্ষার্থীর এসএসসির সনদ জালিয়াতি করেছেন তিনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের মাধ্যমে তিনি সনদ বিক্রি করতেন।
বোর্ড প্রধানের স্ত্রী রিমাণ্ডে
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে বোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খানের স্ত্রী সেহেলা পারভীনকে গত শনিবার রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। একই অভিযোগে আগে আরও পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। গতকাল রোববার সেহেলাকে ঢাকার আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন ডিবির পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম। শুনানি শেষে আদালত দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিবি জানায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও পরিচালকের মাধ্যমে সেহেলা পারভীন সনদ বাণিজ্য করেছেন। চক্রে জড়িত কুষ্টিয়ার গড়াই পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক সানজিদা আক্তার ওরফে কলির কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছেন। তবে সেহেলা ডিবিকে বলেছেন, মেয়ের বিয়ের খরচ বাবদ সানজিদার কাছ থেকে ওই টাকা তিনি ধার নেন। আর শামসুজ্জামানই টাকাগুলো এনে দেন। এটি ঘুষ নয়। কারণ নির্ধারিত সময়ে ফেরত দিতে চেয়েছেন সেহেলা। যদিও সানজিদা টাকার বিনিময়ে স্বামীর মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করে দিতে সেহেলাকে বলেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, শামসুজ্জামান ও তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সাল হোসেন কয়েক বছরে পাঁচ হাজারের বেশি জাল সনদ এবং নম্বরপত্র বানিয়ে বিক্রি করেছেন। একই সঙ্গে তারা পাসওয়ার্ড ও অথরাইজেশন ব্যবহার করে বোর্ডের সরকারি ওয়েবসাইটে ভুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করা সনদ আপলোড করেছেন। ফলে যে কোনো দেশে বসে ওয়েবসাইটে ঢুকে রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে তল্লাশি করলে সনদ সঠিক দেখায়। সনদ তৈরিতে শিক্ষার্থীপ্রতি ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিতেন। প্রয়োজনে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সনদ বাণিজ্য চক্রে ৩০-৩৫ জনের নাম পাওয়া গেছে, যাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, পরিচালক, দালাল ও সিবিএ নেতা রয়েছেন। এ সিন্ডিকেটের সদস্যদের শনাক্ত করা হয়েছে। যে কোনো সময় গ্রেপ্তার করা হবে। এ ছাড়া সিন্ডিকেটের কাছ থেকে আট সাংবাদিক আর্থিক সুবিধা নিতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন শামসুজ্জামান। কয়েকজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, খবর প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন সময় তারা টাকা নিয়েছেন।
ডিবি আরও জানায়, গত ১ এপ্রিল মধ্য পীরেরবাগ থেকে প্রথমে শামসুজ্জামান ও তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী ফয়সালকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে বিপুল পরিমাণ জাল সনদ, নম্বরপত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও প্রবেশপত্র জব্দ করা হয়। পরদিন মিরপুর থানায় সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে কুষ্টিয়া গড়াই সার্ভে ইনস্টিটিউটের সানজিদার নাম বেরিয়ে এলে ৫ এপ্রিল তাঁকেও ধরা হয়। তিনজনের জবানবন্দি ও তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ডিভাইস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিলফুল ফুযুল টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ সরদার গোলাম মোস্তফা ওরফে মোস্তাফিজুর রহমানকে গত বৃহস্পতিবার মিরপুর থেকে এবং ঢাকা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের (মেডিকেল) পরিচালক মাকসুদুর রহমান ওরফে মামুনকে গত শুক্রবার যাত্রাবাড়ী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিবির লালবাগ বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, সনদ বাণিজ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ভেতর-বাইরের অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে। যারা পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তাদেরও ছাড় দেওয়া হবে না। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। মেধাবীদের ভাগ্য বঞ্চিত করতে দেওয়া হবে না।