ইরান যেকারণে এখন ইসরায়েল-আমেরিকাকে পরোয়া করে না
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৩২:০৭ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক: দিন যতই যাচ্ছে, ইরান স্পষ্ট করছে তার শক্তিমত্তা। আগে দেখা যেত প্রায় নিয়মিতই দেশটির বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতো ইসরায়েল। তখন নিন্দা জানানো ছাড়া পাল্টা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যেত না তেহরানকে।
কিন্তু সময় পাল্টেছে, দেশটির সমরভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক সব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র। যার অধিকাংশই নিজস্ব প্রযুক্তির। এর সাথে ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়ার দেওয়া আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যেন রীতিমতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে খামেনির দেশকে।
বলা হচ্ছে, এর ওপর ভরসা করেই সরাসরি ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামলা চালায় দেশটির সেনাবাহিনী, যা নাড়িয়ে দেয় ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বকে। ইরান সেই দেশ যাকে যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমিয়ে রাখতে পারে নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান-রাশিয়া এই সুসম্পর্কের জেরে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে নেতানিয়াহুর দেশকে।
ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাতে নতুন করে উত্তপ্ত গোটা মধ্যপ্রাচ্য। শুরু থেকেই ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে আমেরিকা। অন্যদিকে ভয়ংকর সব অস্ত্র দিয়ে ইরানকে শক্তিশালী করে তুলেছে বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার রাশিয়া। সব দিক বিবেচনা করেই চিরশত্রু ইসরায়েলের ভূখণ্ডে হামলা চালিয়েছে তেহরান।
এমনকি ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে ঠেকিয়ে দেওয়ারও সক্ষমতা রয়েছে উপসাগরীয় দেশটির। আর এই কাজে ইরানকে সহযোগিতা করেছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনকে হাজারো ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে ইরান।
এর প্রতিদান হিসেবে তেহরানকে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান দিয়েছে রাশিয়া। তবে এগুলোর পরিমাণ সম্পর্কে জানা যায়নি।
রাশিয়ার নিত্য নতুন প্রযুক্তি ইরানকে আরও শক্তিশালী করেছে, যা ইসরায়েলের মাথাব্যথার কারণ।
এরই মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পেয়েছে ইরান। এখন এস-৪০০ নিতেও উৎসাহী দেশটি।
কিন্তু রাশিয়া এগুলো তেহরানকে দিয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা মনে করেন, সরাসরি এস-৪০০ না দিলেও এর নকশা বা প্রযুক্তি ইরানের কাছে হস্তান্তর করা হতে পারে।
কারণ, চলতি মাসের শুরুর দিকেই ইরানের ১৭ সদস্যের একটি দল রাশিয়ার সমরাস্ত্র ভান্ডার ঘুরে এসেছে।
বিশ্লষকরা বলছেন, ইরান যদি এ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পেয়ে থাকে, তবে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আরও সুরক্ষিত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হাডসন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো কান কাসাপগলো বলেন, রাশিয়ার এসব অস্ত্রে ইরানের আকাশ ইসরায়েলের জন্য অজেয় হয়ে উঠবে।
ইসরায়েলের জন্য আরও ভীতিকর খবর হলো, সম্প্রতি যৌথভাবে নতুন ড্রোন তৈরি শুরু করেছে মস্কো ও তেহরান। ফাঁস হওয়া নথিতে সামনে এসেছে এসব তথ্য।
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এসব নথির যথার্থতা যাচাই করছেন। রাশিয়া ও ইরান অবশ্য এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
সুয়েজ খালের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালী ইরানের নিয়ন্ত্রণে
সারা বিশ্বের মোট বাণিজ্যের শতকরা ৮০ ভাগই হয় সমুদ্রপথে। ২০২১ সালে একটি জাহাজ আটকে সুয়েজ খাল ছয় দিন বন্ধ থাকায় বিশ্ব অর্থনীতি এক হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আর এই খালের চেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে মধ্যপ্রাচ্যের হরমুজ প্রণালি। এ প্রণালি ছাড়া পারস্য উপসাগর পাড়ি দেওয়ার কোনো পথ নেই। এ উপসাগর ঘিরেই রয়েছে সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ইরান, ইরাক আর ওমান।
বিশ্বব্যাপী যে পরিমাণ জ্বলানি চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশই মিটিয়ে থাকে উপসাগরীয় এসব দেশ। আর প্রতিদিন যে পরিমাণ জ্বালানি রপ্তানি হয় তার এক পঞ্চমাংশ তথা ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রপ্তানি হয় এ পথে। বলা হয়ে থাকে, উপসাগরীয় অঞ্চলে পৃথিবীর মোট জীবাশ্ম জ্বালানির প্রায় অর্ধেক সঞ্চিত আছে। পারস্য উপসাগরের নিচে এবং উপসাগরীয় এসব দেশে পৃথিবীর মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের ৪০ শতাংশ জমা।
এসব জীবাশ্ম জ্বালানি বিশ্বব্যাপী সরবরাহ করতে পাড়ি দিতে হয় হরমুজ প্রণালি। আর এ প্রণালি হয়েই এসব জ্বালানি মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছায়। ফলে এ প্রণালি যদি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবে থমকে যাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা। পরাস্য উপসাগরের জ্বালানি ছাড়া বহু দেশের অর্থনীতিই হোচট খাবে। চীনের ৪৫ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানি আসে হরমুজ প্রণালি হয়ে, জাপানের ক্ষেত্রে এটি ৪৮ শতাংশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে এটি ৩০ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে একমাত্র ইরান বাদে উপসাগরীয় প্রতিটি দেশই আমেরিকার দাসে পরিণত হয়েছে। তাই কোনোভাবেই তেহরানের হাতে এ প্রণালির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ দিতে চায় না ওয়াশিংটন। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ এ নৌপথ রক্ষায় উপসাগরজুড়ে গড়েছে অসংখ্য সামরিক ঘাটি ও স্থাপন করেছে পঞ্চম নৌবহর। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকাকে ঠেকাতে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসহ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছে ইরান। এমনকি মজুত রেখেছে বিপুল পরিমাণ জলমাইন।
যাতে কোনো সংঘাত হলে মুহূর্তেই বন্ধ করে দেওয়া যায় গুরুত্বপূর্ণ এ হরমুজ প্রণালি। ইরান জানায়, পশ্চিমা অবরোধের কারণে ইরান যদি তেল বিক্রি করতে না পারে তবে কোনো উপসাগরীয় দেশই তা করতে পারবে না। হয়তো এমন হুমকির কারণেই ইরানকে খুব বেশি ক্ষেপাতে চায় না আমেরিকা।