হারিয়ে যাচ্ছে কিছু সবল ব্যাংকসহ যেসব
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১০ এপ্রিল ২০২৪, ১০:১২:৫০ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: খুব জলদিই বিলুপ্ত হবে এমন ব্যাংকের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাঁচটি ব্যাংকের নাম প্রকাশ্যে এসেছে। এর মধ্যে রেড জোনে থাকা তিনটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে স্বেচ্ছায়। আর দুটি ব্যাংককে জোর করে একীভূত করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সিটি ব্যাংকের সঙ্গে বেসিক ব্যাংকের এই একীভূত হবে স্বেচ্ছায়। স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় ব্যাংক হিসেবে একীভূত হচ্ছে বেসিক ব্যাংক। স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়া তৃতীয় প্রতিষ্ঠানের নাম ন্যাশনাল ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি খাতের ইউসিবি, এক্সিম ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক। সব কিছু ঠিক থাকলে এই ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে ন্যাশনাল, পদ্মা ও বেসিক ব্যাংক।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে ইয়োলো জোনে থাকা বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাচ্ছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন ব্যাংকগুলোকে নথিপত্রের সঙ্গে একীভূতকরণ স্কিমের কপিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকে আনুষ্ঠানিক আবেদন করতে হবে। নথিগুলোর মধ্যে দুই ব্যাংকের সম্পত্তির দাম, সম্পদ ও দায়-দেনার হিসাবও দিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক খসড়া প্রকল্পে সন্তুষ্ট হলে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী একীভূতকরণের অনুমোদন দেবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, দিন যত যাবে বিলুপ্ত হওয়ার তালিকা আরও লম্বা হবে।
অবশ্য দেশে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে গত কয়েক বছর ধরেই তাগিদ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও ব্যাংক খাতের সংস্কারের বিষয়টি তাদের সর্বশেষ নির্বাচনি ইশতেহারে রেখেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি ব্যাংকের সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি পুরো ব্যাংক খাতকে করে ফেলেছে কলুষিত। সৃষ্টি হয়েছে উচ্চ খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি। অনাস্থা, তারল্য সংকট বেড়েই চলেছে।
এমন পরিস্থিতি উত্তরণে দুর্বল ও ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকগুলোকে সবলের সঙ্গে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আড়াই বছরের ‘রোডম্যাপ (কর্মকৌশল)’ ঠিক করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এক বছর সময় দিয়ে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানো ও ভেঙে পড়া সুশাসন ফেরাতে ১৭ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে দেওয়ার মতো পরিকল্পনাও রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ‘রোডম্যাপ’ নামের প্রস্তাবটি পাস হয়। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের সেগুলো তুলে ধরেন। কর্মপরিকল্পনার ১১টি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত এবং বাকি ছয়টি মূলত ব্যাংকে সুশাসন ফেরানোর রূপরেখা।
এর আগে গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল ব্যাংক একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে ভালো ও দুর্বল ব্যাংকের এমডিদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরুরও পরামর্শ দেওয়া হয় ওই বৈঠকে। শুধু তাই নয়, দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক এবং নীতি সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়।
ইউসিবিএলে হারাবে ন্যাশনাল
বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবিএল) সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক। মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সভাপতিত্ব করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগের আগে একীভূতকরণ ইস্যুতে ইউসিবি এবং এনবিএল’র ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল। অপরদিকে ইউসিবির আর্থিক ভিত্তি সবল।
এক্সিমে মিশেছে পদ্মা
একীভূতকরণের আলোচনার মধ্যে প্রথম নিজেকে ইসলামী ধারার বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ঘোষণা আসে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংকের। ১৪ মার্চ এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক উদ্যোগের পর দুটি ব্যাংকের একীভূত হওয়ার এটিই প্রথম সিদ্ধান্ত।
সিটিতে হারাবে বেসিক
বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে দুর্দশাগ্রস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। সোমবার (৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ওইদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন বৈঠক করেন। সেখানে বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। এখন জারি করা নীতিমালা মেনে একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করবে ব্যাংক দুটি।
এছাড়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এছাড়া একীভূত হওয়ার তালিকায় নাম থাকা এবি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স, আইসিবি ইসলামিক এবং বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান রয়েছে। এভাবে একীভূতকরণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকের সংখ্যা ৪৪টিতে নামিয়ে আনা হতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
অবশ্য ভালো ব্যাংকের সঙ্গে এসব খারাপ ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে এ খাত-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। কর্মকর্তাদের আতঙ্কের বিষয়টি উঠে এসেছে বেসিক ব্যাংকের একীভূত হওয়ার খবরে।
মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা এই আতঙ্কের কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থমন্ত্রীকে লেখা স্মারকলিপিতে তারা সরকারি যেকোনও ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার অনুরোধ জানিয়েছেন তাদের ব্যাংককে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংকের অবস্থা দুর্বল এবং অতি দুর্বল। এর মধ্যে ১২টির অবস্থা খুবই নাজুক। এর মধ্যে ৯টি রেড জোনে চলে গেছে। অপর ৩টি রেড জোনের খুব কাছাকাছি থাকলেও তাদের অবস্থান ইয়েলো জোনে।
এর বাইরে আরও ২৬টি ইয়েলো জোনে অবস্থান করছে। অন্যদিকে মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ৮টিই বিদেশি ব্যাংক। অর্থাৎ গ্রিন জোনে দেশি ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র ৮টি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিচারে রেড জোনের ব্যাংকগুলো সবচেয়ে খারাপ (পুওর) এবং ইয়েলো জোনের ব্যাংকগুলো দুর্বল (উইক)। আর গ্রিন জোনের ব্যাংকগুলো ভালো মানের (গুড)। অর্থাৎ দেশে এখন সবলের চেয়ে দুর্বল ব্যাংকের সংখ্যাই বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই প্রতিবেদনে রেড জোনে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ন্যাশনাল ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক ও এবি ব্যাংকে।
ইয়েলো জোনে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকসহ ১৯টি বেসরকারি ব্যাংক এবং আটটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক আছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো হলো—আইএফআইসি, মেঘনা, ওয়ান, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল, এনআরবি, এনআরবি কমার্শিয়াল, মার্কেন্টাইল, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ডাচ-বাংলা, প্রিমিয়ার, ব্র্যাক, সাউথইস্ট, সিটি, ট্রাস্ট, এসবিএসি, মধুমতি, ঢাকা, উত্তরা ও পূবালী ব্যাংক।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, আল আরাফাহ, স্ট্যান্ডার্ড, ইউনিয়ন, এক্সিম ও গ্লোবাল ইসলামী।
এছাড়া গ্রিন জোনে আছে ১৬টি ব্যাংক। গ্রিন জোন মূলত ভালো আর্থিক অবস্থাকে বোঝায়। গ্রিন জোনে থাকা ব্যাংকগুলো হলো প্রাইম, ইস্টার্ন, হাবিব, এনসিসি, মিডল্যান্ড, ব্যাংক আলফালাহ, ব্যাংক এশিয়া, সীমান্ত, যমুনা, শাহজালাল ইসলামী, উরি, এইচএসবিসি, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, সিটি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।
অবশ্য বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককে এই বিশ্লেষণ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন