সাদী মহম্মদ: শেষ পারানির কড়ি কণ্ঠে নিলে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২৪, ৬:৪২:৩৪ অপরাহ্ন
মাসকাওয়াথ আহসান
তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লিপ সার্ভিস দেওয়ার লোক ছিলেন না; এই চেতনা তার বুকের গভীরে বসবাস করত।
ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একজন অত্যন্ত প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। সাহিত্য আড্ডাগুলোকে জমিয়ে রাখতেন সেন্স অব হিউমারের জাদুতে। তিনি আত্মহত্যার বিরুদ্ধেও লিখেছেন। কিন্তু রাতে ঘুমের মধ্যে যুদ্ধের স্মৃতি এসে তাকে এলোমেলো করে দিত। তার ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ উপন্যাসের নায়ক জাক বার্নসের মাথার মধ্যে কির কির শব্দ হতো। পোস্ট ট্রমাটিক স্টেস ডিজ অর্ডার যুদ্ধফেরত সৈনিকদের নিয়তি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যবান তিনি; সমানুভূতিসম্পন্ন সমাজে জন্ম নিয়েছিলেন। ফলে তার আত্মহত্যার পরে সবাই তার সংগুপ্ত বেদনা অনুভব করতে পেরেছিল। তার মৃত্যুতে প্যারিসের সাহিত্য জগতের মানুষেরা তার লিখে যাওয়া উপন্যাস থেকে পাঠ করে বিদায় জানিয়েছিল। ঔপন্যাসিক তিনি। তার বিদায়ে সাহিত্যপাঠই যোগ্য শেষকৃত্য।
সৌভাগ্যবান তিনি, অর্থোডক্স চার্চের লোকেরা এসে বলেনি, বাইবেল থেকে পাঠ না করে উপন্যাস থেকে পাঠ কেন! এ কেমন খ্রিস্টান! এই যে অশালীন কথা বলার যুগ; তাকে ইউরোপ মধ্যযুগে ফেলে এসেছিল। বিংশ শতকে তাই চার্চের মাতবরি ছিল না মানুষের ব্যক্তিজীবনে।
এমনকী সেই তুরস্কের কনিয়েতে কবি জালালুদ্দিন রুমীর মৃত্যুতে তার অনুসারীরা; রুমীর গীতিকবিতা গেয়ে সেই দুই বাহু ওপরে তুলে ঘূর্ণায়মান দরবেশের নৃত্য করেছিল। পাকিস্তানের সূফি কবি বুল্লেহ শাহর মৃত্যুর পর তার অসাম্প্রদায়িক আহ্বানের গান গেয়ে পাঞ্জাবের মানুষেরা বিদায় জানিয়েছিল। সিন্ধু প্রদেশের সুফি কবি শাহ আবদুল লতিফ ভিটাইয়ের মৃত্যুতে তার ভক্তরা ধামাল নৃত্য নেচেছিল। এই ধামাল নৃত্য পাকিস্তানে আজও ঐতিহ্যসঞ্জাত সংস্কৃতি।
কবি আমির খসরুর মৃত্যুতে হিন্দুস্তানি রাগ সংগীতের আসর বসেছিল। মির্জা গালিবের মৃত্যুতে তার গজল গেয়ে বিদায় জানানো হয়েছিল।
দবির ও ছাবেতের মৃত্যুর সঙ্গে হেমিংওয়ে, রুমী, বুল্লেহ শাহ, লতিফ ভিটাই, আমির খসরু, গালিবের মৃত্যুর পার্থক্য আছে।
দবির আর ছাবেত এই পৃথিবীতে এসেছে খেয়ে-প্রাতক্রিয়া করে-সন্তান উৎপাদন করে আর কুচুটেপনা করে মরে যেতে। এই মৃত্যু একটি পিঁপড়ের মৃত্যুর চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পৃথিবীতে দবির ও ছাবেত কেবল কুচুটেপনা আর গায়ে মানে না আপনি মোড়লের পোদ্দারি ছাড়া আর কোনো দাগ রেখে যায়নি।
ফলে দবির ও ছাবেতের পক্ষে এটা বোঝা প্রায় অসম্ভব; সাদী মহম্মদ কে ছিলেন! কেন তার মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে শোকের ছায়া! বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবে যে ক’জন মানুষ লাখো শ্রোতার হৃদয় জয় করেছেন; সাদী সেই বিরলপ্রজদের একজন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার চোখের সামনে তার পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি খুনে সেনারা। পিতৃহারা সাদীর মাঝে কোনো প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল না; কারণ তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন ভালোবাসার ও মায়ার একজন। তার জীবনাচরণ ছিল সংগীতসাধনার; যাপিত জীবনে রবীন্দ্রসংগীতের সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের বাণীগুলো চর্চা করতেন। তিনি অন্য গো গেটার সেলিব্রেটি শিল্পীদের মতো রবীন্দ্রচেতনার লিপ সার্ভিস দিতেন না। শৈশবে বাবা হারানোর স্মৃতি এসে মাথার মধ্যে কষ্টের গোলক পাকালে তিনি রবীন্দ্রসংগীতে আশ্রয় নিতেন। শোককে তিনি সুরের শক্তিতে রূপান্তর করেছিলেন।
বিসিএস তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে সাড়ে ছয় বছর জাতীয় বেতার ভবনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ছিলেন আমাদের নিয়মিত অতিথি। তিনি নিঃশব্দে আসতেন; দেখা হলে গল্প করতেন; তারপর গান রেকর্ড করে ফিরে যেতেন। তার জীবনচর্যাটি অনুসরণ করলে এটা শেখা যায়; মানুষ যত খ্যাতিমান হয়; তত তাকে বিনয়ী হতে হয়। উনার মাঝে যে অপরিমেয় প্রাণপ্রবাহ ছিল; তা দেখে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথাই যেন মনে পড়ে যায়। যিনি আমার ডেস্কের সামনে বসে জীবনের রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদ করে আনন্দযজ্ঞে আমন্ত্রণ জানাতেন; বিশেষ অনুষ্ঠানের সংগীত রেকর্ডিং-এর পর শোনার সময় বার বার আমার দিকে তাকাতেন! কারণ উনার কাছে শ্রোতা ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকসময় তাকে রিকশায় তুলে দিয়ে অফিসে ফিরতাম।
এরপর প্রায় দুই দশক পেরিয়েছে। একবিংশের ঢাকা মোহরের ঝনঝনানিতে; ফাঁপা প্রদর্শনবাদিতায়, সংগীতের নামে অসুরের দাপাদাপিতে ভরে গেছে। পদ-পদবি-পদকের জন্য পড়িমড়ি করে দৌড়ে বেড়ানো মিডিক্রেসির কোলাহলে; এ শহর সাদীর মতো সাবস্ট্যান্সসম্পন্ন সাধকের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। শহীদ পরিবারের ছেলে বলে মিডিয়ায় কক্ষনো সেন্স অব এনটাইটেলমেন্ট ছিল না তার। কারণ তার অনন্য গায়কী; গাঢ় কণ্ঠ, সুরের ওপর দখল, বাণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব আপনা হতেই একটা এনটাইটেলমেন্ট তৈরি করেছিল কোটি শ্রোতার হৃদয়ে।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লিপ সার্ভিস দেওয়ার লোক ছিলেন না; এই চেতনা তার বুকের গভীরে বসবাস করত। তাই তো নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল উজ্জ্বল গায়ক হিসেবে গড়ে তোলার সাধনা করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু স্মরণে তার গাওয়া ‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল’ অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক সংগীত; কারণ সেখানে শিল্পীর গভীর অনুভব ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুকে হারানোর বেদনা থেকে উচ্চারণ করেছেন প্রতিটি শব্দ।
তিনি তেলাঞ্জলির আসরে যাবার মতো খর্ব মানুষ ছিলেন না; মানুষ হিসেবে তার উচ্চতা ছিল স্থূল সৌন্দর্য্য ধারকদের চেয়ে অনেক বেশি।
‘ওমা তোমার কোলে জনম আমার মরণ তোমার বুকে
তোমার পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে; তুমি শীতল জলে জুড়াইলে.”..
সাদী মুহাম্মদ অনন্তলোকে চলে যাবার পর তার কন্ঠে শুনছিলাম,
“ওমা অনেক তোমার খেয়েছি গো অনেক নিয়েছি মা
তবু জানিনে যে কীইবা দিয়েছি গো মা
আমার জনম গেলো বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা
ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।”
পৃথিবীর প্রতিটি সম্পূর্ণ মানুষের মধ্যে এই অতৃপ্তি থাকে; কী করা গেল না; তা নিয়ে আত্মদহন থাকে। মৃত্যুর আগের এক ইন্টারভিউতে তিনি বলছেন, গানের অর্থ যত বুঝেছি; তত গাইবার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছি যেন। মহৎ শিল্পীর এই যে পারফেকশনের আকাঙ্ক্ষা; অনেককে শুধু এই নিজেকে অতিক্রম করতে না পারার কষ্ট পোড়ায়। যখন অন্য কারো সঙ্গে তার আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না।
আমাদের এই গজদন্তের মিনারে বসে থাকা অতি আত্মবিশ্বাসী উপমানবদের পক্ষে এটা বোঝা অসম্ভব; চিত্রকর ভ্যান গগ কেন আত্মঘাতী হয়েছিলেন। চারপাশের খেলনা মানুষ যখন একজন সৃজনশীল মানুষকে বুঝতে পারে না; তখন সেই স্থবির শহরের জনারণ্যে একা মানুষটির অন্যলোকে চলে যাওয়াই যেন শ্রেয়তর। যেখানে শিল্প-সঙ্গীতের অন্য মায়েস্ত্রোরা অপেক্ষা করছেন তার জন্য। বিদায় সাদী ভাই।
মাসকাওয়াথ আহসান: গ্রন্থকার, প্রধান সম্পাদক ই-সাউথ এশিয়া