ইয়ুন ফসে: তাঁর সেপ্টোলজি প্রসঙ্গ, আর নিজেকে বদলানোর কিঞ্চিত অন্যরকম পাঠ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ৮:১৭:০৭ অপরাহ্ন
সারওয়ার চৌধুরী
সাতটি উপন্যাসের ক্রম একসাথে করা বইটি হল ‘সেপ্টোলজি’। প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার এ বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ড্যামিওন সির্লস। এই অনুবাদ প্রকাশের পর ইংরেজি ভাষার বিস্তর পাঠক জানতে পারেন ১৯২৩ সালে নোবেলজয়ী ইয়ুন ফসে কী কাজের কাজী।
বইটি সম্পর্কে এক বাক্যে বলা যায়, এটি হল, গড, শিল্প, মানুষের পরিচয়—তার পারিবারিক নৈতিক শক্তি আর মানুষের অস্তিত্বের দুর্বলতা অন্বেষণের একটি ধারাবাহিক প্রয়াস। বলা হয় ২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার প্রধান কারণ সেপ্টোলজি। নিচে দুটি সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ অনুবাদ করে তিনি কতটুকু আলাদা এবং কেন তা খুব সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।
সেপ্টোলজিতে একজন বয়স্ক চিত্রকর গভীরভাবে তার পরিবর্তনশীল অহং মোকাবিলা করেন, অ্যালকোহল আসক্তির সাথে লড়াই করেন। ব্যক্তি ইয়ুন ফসের নিজের মতোই, ওই চিত্রশিল্পী ১৪ শতকের জার্মান ক্যাথলিক ধর্মতাত্ত্বিক ও মরমি সাধক মেস্টার একহার্টের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন।
সমালোচক মার্ভে এমরের বলেন, সেপ্টোলজি একমাত্র উপন্যাস, যেটি তাকে ‘‘ঐশ্বরিক বাস্তবতায় বিশ্বাসী করেছে”। ‘নিউইয়র্কার’র জন্য একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়, ফসে তাকে বলেছিলেন— ‘‘টেক্সটের আকার-আদল ভাষাটির নিজস্ব অতুলনীয় যুক্তি তৈরি করতে পারে’’।
লস এঞ্জেলস রিভিউ অব বুক-এ প্রকাশিত একটি সাক্ষাতকারের অংশবিশেষ নিচে:
আমার মন পরিবর্তন করেছে আমার নিজের লেখা
রেমো ভার্ডিক্ট, এমিয়েল রুথুফ্ট:
সেপ্টোলজিতে, কথক মরমি সাধক মেস্টার একহার্ট সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। প্রায়ই এটা বলা হয়, একহার্ট সমসাময়িক লেখকদের প্রভাবিত করেছেন, যেমন Fleur Jaeggy আর এখন আমরা বলতে চাইছি আপনিও একজন একহার্ট প্রভাবিত। কেন আপনি তাঁর দ্বারা এতোটা প্রভাবিত?
ইয়ুন ফসে:
আমি ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি মেস্টার একহার্ট পড়া শুরু করি। দারুন একটা জ্ঞান আমার অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছিল তখন, মানে সারগর্ভ পর্যবেক্ষণ হল আমার — এরকম একটা অনুভব পেয়েছি। তখন কেবল ইউনিভার্সিটি শেষ করেছি, মানে শেষ করে তাঁকে পড়েছি। তখন পাশাপাশি আমি মার্টিন হাইডেগার পড়েছি যথেষ্ট। আমি অনুভব করেছিলাম তিনি হাইডেগারের মতো, তবে তার চেয়ে অনেক গভীর। একহার্ট হলেন সেই লেখক যিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন। তার সম্পূর্ণ নিজস্ব দৃষ্টি রয়েছে। আমার কৈশোরে, আমি এক ধরনের মূর্খ মার্ক্সবাদী এবং নাস্তিক ছিলাম। এক তরুণ আমি, উচ্চাকাঙ্ক্ষী বুদ্ধিজীবী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, সেই দিনগুলোতে ওইরকম থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু লেখালেখির প্রক্রিয়ায়, এমন কিছু ছিল যা আমি পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, মানে কিছুএকটা রহস্য — এ রহস্য কোথা থেকে আসে? নাহ্ এখান থেকে আসে না (তার হৃদয়ের দিকে নির্দেশ করে)। না, এটা ওখান থেকে — বাইরে এসেছে।
আমি সেই থেকে একভাবে গডকে একজন ব্যক্তি হিসাবে বিশ্বাস করতে শুরু করি। আমি নিজেকে গডে বিশ্বাসী বলি, মানে তিনি সেখানে এবং এখানে, একই সাথে উপস্থিত হিসাবে। তবে একহার্টের মতো আমি কোনো নৈতিক পদ্ধতির অনুসারী ছিলাম না।
এই যে আমার আলাদা ধরনের বিশ্বাস, এই বিশ্বাস আমি অন্য কারো সাথে শেয়ার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি। গেলাম তাই আমি কোয়েকারদের কাছে (জর্জ ফক্স প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় মতবাদ)। সেখানে আপনি একটি নীরব বৃত্তে থাকছেন, আপনি যদি মনে করেন, আপনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার আছে, তাহলে আপনি তা বলুন, যদি না থাকে, আপনি শুধু চুপ থাকুন। এক সময়ে, আমি আর ওই মতবাদের প্রয়োজন নেই আমার জন্যে, অনুভব করলাম। আমি টের পেলাম, আমার নিজের লেখা আমার ‘সাইলেন্ট মিটিং’ বা আমার কোয়েকার হওয়ার উপায় — আমার প্রার্থনার উপায়।
তারপরে আমি বহু বছর ধরে কেবল একজন লেখক ছিলাম। আমার বিশ্বাস যা ভিতরে ভিতরে লালন করছিলাম তা শেয়ার করার কেউ ছিল না আমার পাশে। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি, আমি নরওয়ের বেরজেন শহরের একটি ক্যাথলিক গির্জায় গণসংযোগ করতে গিয়েছিলাম। আমার সেটা পছন্দ হল। এমনকি আমি একজন ক্যাথলিক হওয়ার জন্য একটি কোর্সে যোগ দিতে শুরু করেছিলাম — হ্যাঁ, চরিত্র এসলে-র মতো, কমবেশি বলা যায়। এর অনেক বছর পরে, আমি ক্যাথলিক চার্চে রূপান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এর পেছনে প্রভাব ছিল মেস্টার একহার্টের। মানে তিনি একসাথে ক্যাথলিক ধার্মিক ও মিস্টিক/মরমি হতে পেরেছিলেন, আমি তাতে অনুপ্রাণীত হলাম।
রেমো ভার্ডিক্ট, এমিয়েল রুথুফ্ট:
আপনি কি নিজেকে একজন ক্যাথলিক ও মিস্টিক লেখক হিসেবেও বিবেচনা করবেন?
ইয়ুন ফসে: এই মরমি দিকটির সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা সাত বছর বয়স থেকে, যখন মারা যাওয়ার কাছাকাছি ছিল অবস্থা। এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল। আমি নিজেকে বাইরে থেকে দেখেছি তখন, এক ধরনের ঝলমলে আলোতে, শান্তিপূর্ণ, খুব সুখী অবস্থায়। আর আমি নিশ্চিত সেই দুর্ঘটনা, সেই মুহূর্তে, সেই মৃত্যুর কাছাকাছি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাকে একজন লেখক হিসাবে গড়ে তুলেছিল। ওই দুর্ঘটনা আমার জন্য খুবই মৌলিক কিছু। ওই অভিজ্ঞতা জীবনের আধ্যাত্মিক মাত্রায় আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। কিন্তু (তরুণ বয়সে) একজন মার্কসবাদী হওয়ার কারণে আমি যতটা সম্ভব অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিলাম।
যা আমার মন পরিবর্তন করেছে তা আমার নিজের লেখা। আমি যত বড় হয়েছি, ততই আমি অন্যদের সাথে আমার বিশ্বাস শেয়ার করার প্রয়োজন অনুভব করেছি। আমি ক্যাথলিকদের মধ্যে একটি ভাল এবং শান্তিপূর্ণ উপায় পেয়েছি৷ আমি অর্থোডক্সদেরও পছন্দ করি, কিন্তু একজন পশ্চিমার পক্ষে, অর্থোডক্স মানসিকতায় প্রবেশ করা খুব কঠিন — রেফারেন্সগুলো বেশ আলাদা৷ আমি ক্যাথলিক চার্চের এতটাই জানতাম যে আমি অর্থোডক্স চার্চে যেতে পারিনি।
মেস্টার একহার্ট। জর্মন ভাষায় মেস্টার মানে গুরু, মরমি সাধক। মেস্টার ইংরেজিতে মাস্টার।
গ্রানটা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ নিচে:
অভিজ্ঞতা লিখতে আমি মোটেই আগ্রহী না
আমার কাছে লেখা এক ধরনের শোনা। আমি জানি না আমি কি শুনছি, কিন্তু আমি শুনছি! আর তখন লেখা কমবেশি নিজেই লেখে। (যেনবা আগের বাক্যটি পরের বাক্যটি তৈরি করে দিচ্ছে) আমি প্রায়ই, একটি নির্দিষ্ট সময়ে, অনুভব করি, আমি যা লিখছি তা ইতিমধ্যেই লেখা আছে, এবং এটি অদৃশ্য হওয়ার আগে আমাকে এটি লিখতে হবে। অথবা মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে ইতোমধ্যেই সেখানে থাকা লেখাটি খুঁজে বের করতে হবে।
আমি নিজে যা অভিজ্ঞতায় পেয়েছি তা লিখতে আমার মোটেই আগ্রহ নেই। আমি নিজেকে প্রকাশ করার চেয়ে নিজেকে পরিত্রাণের জন্য বেশি লিখি। এটা একটি নতুন মহাবিশ্বের সৃষ্টি, চরিত্র, মেজাজ, একটি গল্প, লেখার একটি নির্দিষ্ট উপায়, যা আমার কাছে আকর্ষণীয়। যদি আমি (এভাবে) ভাল লিখতে পারি তবে আমি এই পৃথিবীতে এমন কিছু নিয়ে আসব যা আগে ছিল না। আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন এটা।
অন্যদিকে, আমি যা লিখছি সে সম্পর্কে আমি অবশ্যই কিছু জানি, তবে আমার অভিজ্ঞতাগুলো লেখার মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়। আমি অনুমান করি এই রূপান্তর, আপনি বলতে পারেন, আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন কেন আমার লেখার পাশাপাশি এ রূপান্তর প্রক্রিয়া ভ্রমণ করে।