সংস্কৃতিবান্ধব আমলা এবং ম্যানচেস্টার বইমেলা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮:২০:১২ অপরাহ্ন
আবু মকসুদ
আমলারা যদি সাহিত্য, সংস্কৃতিবান্ধব হয় তাহলে দেশ ও জাতির লাভ হয়; অন্তত ক্ষতির কোন সম্ভাবনা থাকে না। আমাদের দুর্ভাগ্য বেশিরভাগ আমলাই সাহিত্য সংস্কৃতির ধার ধারে না। কেন যেন আমলা এবং কবিতা খাপ খায় না। গানের সপ্তকে সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি আছে কিন্তু আমলার আ নেই। গানের সাথে আমলার কোন সংযোগ আছে চিন্তা করা কষ্টকর হয়ে যায়।
আমলাদের নিয়ে সাধারণের কি ভাবনা এ নিয়ে হুমায়ূন আজাদের দুটি প্রবচন উদ্ধৃত করছি।
‘একজন চাষী বা নদীর মাঝি সাংস্কৃতিকভাবে যতোটা মূল্যবান, সারা সচিবালয় ও মন্ত্রীপরিষদও ততোটা মূল্যবান নয়।’
‘একটি আমলা আর মন্ত্রীর সাথে পাঁচ মিনিট কাটানোর পর জীবনের প্রতি ঘেন্না ধ’রে গেলো; তারপর একটি চড়ুইয়ের সাথে দু-মুহুর্ত কাটিয়ে জীবনকে আবার ভালবাসলাম।’
বেশ কিছু আমলার সাথে আমার নিজেরও পরিচয় আছে। পরিচয় পর্বে তাদের সংস্কৃতিক মান খুব একটা উন্নত মনে হয়নি। আমার মনে হয়নি কবিতা কিংবা গান তাদের আকর্ষণ করে। কবিতা গান তাদের কাছে দূর প্রদেশের অভিযাত্রী, যে অভিযাত্রীর প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই।
সব কিছুর পরেও কিছু ব্যতিক্রম থেকে যায়। সব আমলারা কাঠঠোকরা হয় না বিরক্তিকর ঠক ঠক শব্দের পরে কেউ কেউ কোকিলের মধুময় কণ্ঠের অধিকারীও হয়।
কোন কোন আমলা এখনো সব পাখি নীড়ে ফিরে গেলে মনের পাণ্ডুলিপিকে পুনরায় পড়ে নেয়। এখনো বনলতা সনে তারা দুদণ্ড অবসরে বসে। গল্পের তরে এখনো তাদের মন ঝিলিমিল করে।
ম্যানচেস্টার সহকারী হাইকমিশনের সহকারী হাইকমিশনার কাজী জিয়াউল হাসানকে আমার কিছু পরিমাণে ব্যতিক্রমী আমলাই মনে হয়েছে।
দেশের বিদেশ মিশনে যারা নিয়োগ পায় তাদের কিছু রুটিন কাজ করতে হয় শিল্প সাহিত্যের কিছু লোক দেখানো অনুষ্ঠানে তাদের সংযুক্ত হতে হয়। এগুলো নিতান্তই দায়ে পড়ে।
ম্যানচেস্টারের সহকারী হাইকমিশন ম্যানচেস্টার ও আশেপাশের শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। কখনো আয়োজক হিসাবে কখনো সহযোগী হিসাবে।
ম্যানচেস্টার বইমেলা এবং সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজকদের সহযোগী হিসাবে ম্যানচেস্টার সহকারী হাইকমিশন অংশগ্রহণ করেছে।
বইমেলা এবং উৎসবে অংশ নিতে আমরা ম্যানচেস্টার গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম হাই কমিশনের সংযোগে হয়তো দায়সারা কোন অনুষ্ঠান হবে।
কিন্তু বইমেলা এবং উৎসব ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত দেখতে পেলাম। মাননীয় সহকারী হাইকমিশনার যেভাবে অনুষ্ঠানের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখছেন তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল।
আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম অনুষ্ঠানের সামান্য ভুল ত্রুটিও তার নজর এড়াচ্ছে না। অনুষ্ঠানের নান্দনিকতার সামান্যতম স্খলন দেখলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে স্খলন দূর করতে সচেষ্ট হচ্ছেন।
আমি দেখলাম মাননীয় সহকারী হাই কমিশনার সবার বক্তব্য খুব মনোযোগ সহকারে শুনছেন। দেখলাম বক্তব্য শুনতে গিয়ে সামান্য গোলযোগ হলে নিজে মঞ্চে এসে সবাইকে অনুরোধ করছেন বক্তাকে যথাযথ মনোযোগ দেয়ার জন্য।
সাধারণ কোন আমলা এই সৌজন্যটুকু দেখাতেন না।
আমি নিজেকে কবি বলি না। নিজেকে কবি হিসেবে দাবি করার মত যথেষ্ট প্রতিভা আছে; আমার মন তা মানে না। শুধু চেষ্টা করে যাই; ভাবি একদিন হয়তো কবিতা লিখে ফেলতে পারব।
মান্যবর সহকারী হাই কমিশনার একজন অখ্যাত কবিতা কর্মীকে যেভাবে সম্মান প্রদর্শন করেছেন তাতে আমি আপ্লুত। আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
শিল্প সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই দায়বদ্ধতা আমাকে মুগ্ধ করেছে আমি তাঁর জয়গান করছি।
বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিক পরিষদ গ্রেটার ম্যানচেস্টার এবং বাংলাদেশ সহকারি হাইকমিশনের ম্যানচেস্টার ইউকের আয়োজনে অনুষ্ঠিত বইমেলা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতিক উৎসব অত্যন্ত সফল উৎসব ছিল।
বিপুল পরিমাণ বাঙালির উপস্থিতির জন্যই শুধু নয়। বিপুল পরিমাণ সেলফি বা ফটোগ্রাফির জন্যই নয়। এই প্রথম দেখতে পেলাম এই মেলায় কিংবা উৎসবে আমাদের তৃতীয় প্রজন্ম এবং চতুর্থ প্রজন্ম মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
আমাদের মাঝে কিছুটা হতাশা আছে মেলা বা উৎসবে যারা উপস্থিত হয় তারা সবাই বাংলাদেশ কেন্দ্রিক অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে বড় হয়ে এদেশে এসেছে কিন্তু যাদের জন্ম এ দেশে এসব মেলা কিংবা উৎসবে তাদের সম্পৃক্ততা খুব একটা দেখা যায় না ম্যানচেস্টারে এর ব্যতিক্রম দেখলাম।
আমি দেখলাম যারা এদেশে বড় হয়েছে তারা আমাদের কৃষ্টি কালচার থেকে দূরে নয় বরং তারা আমাদের কৃষ্টি এবং কালচারে বেশ ভালোভাবে দীক্ষিত।
তাদের পরিবেশিত একটি অনুষ্ঠান আমাকে এমন মুগ্ধ করলো যে চোখে জল এসে গেল। পরবর্তী প্রজন্ম যথেষ্ট পরিমাণে সম্পৃক্ত হচ্ছে না ভেবে যে হতাশা ছিল সেই হতাশা এখন আশাবাদে পরিণত হয়েছে। মনে হচ্ছে আমাদের ছেলেমেয়েরা পথ হারাবে না তারা ঠিকই পথ খুঁজে নেবে।
সফল একটি বইমেলা এবং উৎসবের আয়োজকদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তাদের পরবর্তী উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকব।