মানবাধিকার রক্ষায় আমরা সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীকারবদ্ধ: জাতিসংঘে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯:৫০:৪৬ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র, আইনেরশাসন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যাবে। দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় আমরা সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীকারবদ্ধ বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৮তম অধিবেশনে বাংলায় দেওয়া ভাষণে এ কথা জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বছর আমরা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৭৫তম বার্ষিকী পালন করছি। এই মাহেন্দ্রক্ষণে বিশ্ব মানবতার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে সবার জন্য সমতা, ন্যায্যতা, স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি যাতে উন্নয়নশীল দেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে ব্যবহৃত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধান সবার মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করে। সবাইকে আইনগত সুরক্ষা প্রদান ও সুবিচার নিশ্চিতকরণে গত এক দশকে বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থার তাৎপর্যপূর্ণ সংশোধন করা হয়েছে। একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে, জনগণের মানবাধিকার রক্ষায় আমরা সম্পূর্ণরূপে অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আমরা সারা বিশ্বের আপামর জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণে অন্য সদস্যদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। আজ এই অধিবেশনে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে চাই যে, বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, বিশ্বনেতাদের প্রতি আবেদন, যুদ্ধ, স্যাংকশন ও সংঘাতের পথ পরিহার করুন। আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য কাজ করুন। আমি নিজে নিপীড়িত এবং যুদ্ধ ও হত্যার নৃশংসতার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যুদ্ধ, হত্যা, অভ্যত্থান ও সংঘাতের ভয়াবহতার জন্য মানুষ যে বেদনা ও যন্ত্রণা সহ্য করে তা অনুভব করতে পারি।
তিনি বলেন, সবার জন্য নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য অভিন্ন সংকট মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ জন্য, আমাদের অবশ্যই বিভাজন, সংকীর্ণতা ও বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে একতা, সহমর্মিতা ও বহুপাক্ষিকতা বেছে নিতে হবে। শান্তি ও টেকসই সমৃদ্ধি অর্জনের উদ্দেশে আমাদের অবশ্যই সুবিচার, ন্যায় ও ন্যায্যতার নীতি অনুসরণ করতে হবে, যার ভিত্তি হবে জাতিসংঘ সনদ এবং ২০৩০ এজেন্ডা।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে আমরা মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আধুনিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছি। তার দেখানো পথে বাস্তবমুখী নীতিগ্রহণ, সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হতে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পেরেছি। আমরা দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ থেকে ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ২৫.১ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছি। সহাস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আমরা এসডিজি অর্জনে অবিচলিত অগ্রগতি সাধন করেছি। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এক্ষেত্রে গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। করোনাভাইরাস, বিভিন্ন মানবসৃষ্ট সংকট এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় চ্যালেঞ্জগুলিকে বহুগুণে জটিল করেছে। সে কারণে, এই বছর জাতিসংঘ এসডিজি সম্মেলনের সফল আয়োজন এবং এতে গৃহীত রাজনৈতিক ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা বিশ্বাস করি, এই রাজনৈতিক ঘোষণা ২০৩০ উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করবে।
এসডিজির বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে অর্থায়ন গুরুত্বপূণ নিয়ামক। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আর্থিক অবকাঠামো লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তেমনি এটি সংকটের সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক চাহিদা মেটাতেও সক্ষম নয়। আজ এমন একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক অবকাঠামো আমাদের জরুরিভাবে প্রয়োজন যা উন্নয়নশীল দেশগুলিকে বিশেষ ছাড়ে, কম খরচে, কম সুদে এবং ন্যূনতম শর্তে অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করবে। তা ছাড়া, জরুরি অবস্থা এবং দুর্যোগের সময় আইএমএফের এসডিআর তহবিলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ন্যায়সংগত প্রবেশাধিকার থাকতে হবে। সমস্ত ঋণ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত বিশেষ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ৫০০ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রণোদনা প্যাকেজ প্রস্তাবনার জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমরা এই প্রস্তাবনার দ্রুত বাস্তবায়ন দাবি করছি।
তিনি বলেন, এসডিজি অর্জনে আমরা নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ ও প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা নারী শিক্ষাসহ সার্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক হতে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি, বৃত্তি এবং এককালীন অনুদান দেওয়া হচ্ছে। এদের অর্ধেকেরও বেশি নারী। আমাদের জাতীয় বাজেটের মোট ৩০ শতাংশ নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা সরকারের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন সকল স্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছি। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি খাতে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছি। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও তাদের যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ, নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী পাচার এবং অন্যান্য অপরাধ নিরসনের জন্য কাজ করছি। আমরা নারীর অগ্রগতির জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ‘প্ল্যাটফর্ম ফর উইমেন লিডার’ -এর মাধ্যমে সকল আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সমর্থন করছি।
রোহিঙ্গা সংকটের ওপর আলোকপাত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গত মাসে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আমাদের জন্য সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সম্ভাব্য মৌলবাদকে ইন্ধন দিতে পারে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে। বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় এবং সেখানে তারা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী। আসুন আমরা এই নিঃস্ব মানুষের জন্য তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করি।
শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ২২ মিনিটে ভাষণ শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ভাষণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সপ্তদশ বারের মতো ইউএনজিএ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। এ বছরের ইউএনজিএর মূল প্রতিপাদ্য, ‘আস্থা পুনর্গঠন ও বিশ্বব্যাপী সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা: সবার জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি ও স্থায়িত্বের লক্ষ্যে ২০৩০ এজেন্ডা এবং এর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যে ত্বরান্বিতকরণ পদক্ষেপ।’
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশন ও অন্যান্য উচ্চপর্যায়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে পৌঁছান। তিনি ২৩ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনের উদ্দেশে নিউইয়র্ক ত্যাগ করবেন এবং সেখানে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবস্থান করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন সফর শেষ করে তিনি ২৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হবেন। সেখানে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত অবস্থান করবেন এবং ৪ অক্টোবর দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।