শ্রাবণের রূপ ও শেকড়ের গল্প
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ আগস্ট ২০২৩, ৭:২৫:১৬ অপরাহ্ন
পঞ্চানন মল্লিক
মেঘ মেদুর বরষায় কেবল মজে না মন চিরচেনা কদমের বর্ণনায়। বরং খুঁজে ফেরে চালতা, গাঙ কচুরি, সাদা শসা কিংবা বাবলার হলুদ সমারোহ; যেখানে মিশে আছে শাশ্বত জীবনের রং-শেকড়ের গল্প। পা টিপে টিপে চলে যায় সেই মৃত্তিকা রঞ্জিত বিস্তৃত আঙিনায়, যেখানে লেগে আছে নববধূর আলতো পায়ের কোমল ছাপ, নিবিড় মমতায়। গ্রাম বাংলার বর্ষার সে চিরচেনা আয়োজনে, অবাধ প্রাণ জোয়ারে একবার ফিরে যেতে চায় মন, শ্রাবণ ধারার রূপ দরশনে, গ্রামের কৃষককুলের স্যাঁতসেতে গৃহকোণে। কেন যাব সেটা বড় কথা নয়, তবে মন টানে যে বড়। ওখানে ঢ্যাপের খালে সেই বৃষ্টি দুপুরে টুপটাপ কৈ মাছের ‘চায়ার’। খালি পায়ে আইলে দাঁড়িয়ে বড়শি দিয়ে কৈ মাছ ধরার বৃক্ষসম ধৈর্য। কদাচিৎ দুই একটা মাছ ধরতে পারলে মন যেন আনন্দে ভরে যায়। নেশা লেগে রয় মনে। সেই লোভনীয় সময় মনকে সেথায় টেনে নিয়ে যায়।
শ্রাবণ দিনে ধবলী কবলীরে নিয়ে রাখাল ছেলে মাঠে যায় চরাতে। ওই রকমই হয় গৃহস্থের দেওয়া গাভী যুগলের নাম। রাখালের লাঠি খেলার ফাঁকে গাভীসব চাতরের ধানের ‘পাতো’ খেয়ে ফেললে প্রতিবেশী কৃষকের কর্কশ বকুনি রাখাল ছেলেটির প্রতি। প্রাণে বাজে, জীবনের মিঠে কড়া সেই সময়। শ্রাবণে গ্রামে ধানের ‘পাতো’র চাতর (বীজতলা) তৈরি আরেক কষ্টসাধ্য কাজ। কদাচিৎ জলের অভাব হলে পাশে মাটি গভীর করে খুঁড়ে ছোট আকৃতির জলাধার সৃষ্টি করে সেঁউতি দিয়ে কৃষকরা ‘চাতরে’ জল তোলেন। এভাবে চাতরে জল তোলা বড়ই মেহনতের কাজ। বাড়ির জন-মজুরদের হাত লাল হয়ে ফোসকা পড়ে যেতে দেখা যায়। এছাড়াও থাকে চাতরের আগাছা বা ঘাস বাছার কঠিন কাজ। তবুও কৃষকের মুখে লেগে থাকে ভবিষ্যতের স্বপ্নময় সোনালি ফসলের হাসি। এত পরিশ্রম শুধু ভবিষ্যতের দু’মুঠো সঞ্চিত ফসলের জন্য। কারণ এ ‘পাতো’ বড় হলে ক্ষেতে লাগানো হবে, আর এতেই ফলবে ভবিষ্যতের সোনার ফসল। ‘পাতো’ তৈরির কাজ তাই যতই কষ্টসাধ্য হোক কৃষকরা করেন সানন্দে। এই বর্ষায় ধান চাষের পাশাপাশি গ্রামের কৃষকেরা লাগান আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, মেহগনি, শিরিশ, পেয়ারা, সবেদা, লেবু, কুল, বেলুম্বাসহ নানা রকম ফলদ ও কাষ্ঠ উদ্ভিদের চারা। চারা রোপণ করে পাশে শক্ত লাঠি বা বাঁশের আগা পুঁতে তার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় সেটিকে, যাতে এটির গোড়া নড়ে বা বেঁকে না যায়। চারদিকে বাঁশের চাচ বা চটায় নির্মিত খাঁচা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় গরু-ছাগল যাতে নাগাল না পায়। এভাবে লাগানো চারা বৃষ্টির পানি পেলে বেঁচে থাকে এবং বেড়ে ওঠে। মাত্র কয়েক বছরে এগুলো বেড়ে বড় গাছে পরিণত হয়। ফলদ গাছে ফল ধরে, কাষ্ঠ গাছ আমাদের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক চাহিদা মেটায়। জ্বালানির জন্য গাছ কাটলে তার পরিবর্তে আবার গাছ লাগানো দরকার। একটি গাছের পরিবর্তে তিনটি গাছ লাগালে কমপক্ষে ১-২টি গাছ টিকে থাকবে ও বড় হয়ে উঠবে বলে ধরে নেওয়া যায়।
বৃষ্টির দিনে গ্রামের কাঁচা রাস্তাঘাট হয়ে পড়ে কর্দমাক্ত। লোকজন হাঁটু সমান কাদা ভেঙে এ-বাড়ি ও-বাড়ি বেড়াতে যান। এমন দিনে কত আর গৃহকোণে বন্দি থাকা যায়। পাশের বাড়িতে গিয়ে গল্প গুজব করে সময় পার করেন মানুষজন। প্রতিবেশী সহপাঠীদের বাড়িতে গিয়ে পুতুল, লুডু ইত্যাদি খেলায় মজে শিশুরা। ক্লাব, দহলিজ, দোকানে কেরাম খেলায় ব্যস্ত থাকে ছেলেরা। যেসব শিশুর স্কুল দূরে, বিশেষ করে তিন-চার কিলোমিটার দূরত্বে¡ অবস্থিত, তাদের যাতায়াতের ভোগান্তি বেড়ে যায় এ মৌসুমে। কাঁচা রাস্তায় পা টিপে টিপে অতি সাবধানে চলতে হয়। কখনো কাদা ছিটকে জামা কাপড় নষ্ট করে দেয়। পানি দিয়ে ধুয়ে কোনো রকম ঢুকতে হয় স্কুলে। তবু আহা! কত শান্তির গ্রামের সেই স্কুল জীবন। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ হলেই সহপাঠীরা সবাই মিলে হইচই করে ওঠে। সেই হইচই-এর শব্দ যেন চালের শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। সেসব আনন্দমুখর দিন আজ যেন শহরের কর্মমুখী ও যান্ত্রিক স্রোতে হারাতে বসেছে। গ্রাম বাংলার বর্ষার রূপ বর্ণনা পেয়েছে কাব্যে এভাবে- “বৃষ্টি এলো কাশবনে,/জাগলো সাড়া ঘাস বনে,/বকের সারি কোথায় রে/লুকিয়ে গেলো বাঁশ বনে।/ নদীতে নাই খেয়া যে,/ ডাকলো দূরে দেয়া যে,/কোন সে বনের আড়ালে/ফুটলো আবার কেয়া যে।/ গাঁয়ের নামটি হাট খোলা,/বৃষ্টি বাদল দেয় দোলা,/রাখাল ছেলে মেঘ দেখে/ যায় দাঁড়িয়ে পথ ভোলা।/মেঘের আঁধার মন টানে,/যায় সে ছুটে কোনখানে,/আউশ ধানের মাঠ ছেড়ে/আমন ধানের মাঠ পানে।” শহরের ইট পাথর আর পিচঢালা রাস্তায় আজ যেন টের পাইনে বৃষ্টির সেই শাশ্বত আমেজ। সে দিনের সেই টোপর, জোঙড় (বৃষ্টি হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য শক্ত বেতের তৈরি এক প্রকার আবরণ), গামছা, পলিব্যাগের পরিবর্তে আজ এসেছে রেইন কোর্ট, রাবারের তৈরি জুতো ইত্যাদি। যা বৃষ্টির দিনে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিলেও কমে গেছে বৃষ্টিতে মন খুলে ভেজার সেই অপার আনন্দ। এই বর্ষা দিনে বৃষ্টির প্রকৃত রূপ দর্শনে আর শ্রাবণের সজীব ধারায় ভিজে শরীর জুড়াতে তাই একবার মন ছুটে যেতে চায় গ্রামের খোলামেলা বৃষ্টিমুখর পরিবেশে, শেকড়ের পানে।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে বর্ষা তথা শ্রাবণ মাসের রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের অধিকাংশ প্রজাতি যেমন আউশ, আমন, ইরি ধান এ সময়ই রোপণ করা হয়। এসব ধানের চারা রোপণে প্রয়োজনীয় সেচ বা পানির চাহিদা মেটায় বৃষ্টির পানি। এ পানি মিষ্টি বা মিঠা, তাই এসব ধানের চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এতে কৃষকের সেচ ব্যয় বহুলাংশে কমে যায়। বর্ষাকালে নদী, নালা, খাল, বিল ইত্যাদির পানি অনেক বেড়ে যায়। এতে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র ও বিচরণ ক্ষেত্র বৃদ্ধি পায় এবং ফলন বাড়ে। মাছের ফলন বৃদ্ধি পেলে গ্রামীণ মৎস্যজীবী তথা চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। এছাড়া এ সময় নদী পথের প্রসারতা বৃদ্ধি পায়, ফলে নৌচলাচলও সহজতর হয়।
অবশ্য শ্রাবণের অঝোর ধারা ধরে রাখার জন্য দরকার অনুকূল পরিবেশ বা উপযুক্ত আবহাওয়া। ইদানীং ব্যাপক হারে গাছপালা ধ্বংসের ফলে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন এবং অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি দেখা দিচ্ছে। এমন হলে শ্রাবণ মাস তার বৈচিত্র্য হারাবে। বর্ষার শেষ মাস, তাই এ সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এমনটিই সবার কাম্য। তবে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে প্রকৃতি যদি তার বৈচিত্র্য হারায়, তবে শ্রাবণ মাসও এক সময় হয়ে পড়বে বৃষ্টিবিহীন। যা হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি আমাদের কারোরই কাম্য নয়। আমরা গ্রাম বাংলার চিরচেনা বৃষ্টি স্নাত শ্রাবণধারাকে চিরকাল ধরে রাখতে চাই। ভিজতে চাই বর্ষার সজীব ফোঁটায়, ভেজাতে চাই বৃক্ষকুল ও প্রকৃতিকেও। প্রাকৃতিক ভারসাম্য অটুট রাখতে আসুন তাই আমরা সবাই এই শ্রাবণে আমাদের বাড়ির আশপাশে প্রচুর গাছ লাগাই এবং সেগুলো যতœ সহকারে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট হই। গ্রামের সঙ্গে আমাদের প্রায় সবারই রয়েছে নাড়ির টান। শহরে বসবাসকারীরা এ সময় তাই গ্রামে গেলে অবশ্যই সঙ্গে করে কিছু গাছের চারা নিয়ে যাব, সেগুলো লাগাব গ্রামে গিয়ে। গাছ লাগাতে উৎসাহিত করব সবাইকে। আমরা যেন সবুজ বেষ্টনী ঘেরা গ্রামীণ পরিবেশে শ্রাবণে বর্ষার চিরায়ত রূপকে প্রতিবছর প্রত্যক্ষ করতে পারি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরাই আমাদের প্রকৃতিকে হত্যা করছি। তাকে স্নেহ-মায়া-মমতা দেওয়ার বদলে তার সঙ্গে করছি বিরূপ আচরণ। ফলে প্রকৃতিও রুষ্ট হচ্ছে। আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে আমাদের প্রতি। যা কখনই আমাদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট