‘মারা যাওয়ার আগে নিজেদের সন্তানদের নাম ধরে চিৎকার করতেন’
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ জুলাই ২০২৩, ১০:৩৩:০৪ অপরাহ্ন
শুভ্র কিশোর বসু
জাপানে আছি প্রায় বছর সাতেক হয়ে গেল। টোকিও থেকে কোয়েটো যাব বলে, ট্রেনে উঠেছি। নাহ, বুলেট ট্রেনে নয়। সাধারণ ট্রেনে। স্পিড মন্দ নয়। বুলেট ট্রেনগুলোর প্রচুর ভাড়া। হাতে সময় আছে। অতিরিক্ত খরচ না করাই ভালো।
জাপানে সাধারণ ট্রেনগুলোতে ভালোই ভিড় হয়। তাও, উইন্ডো সিট পেয়েছি। টোকিওর পরিমিত কোলাহল ছাড়িয়ে ট্রেন ক্রমশ ― সবুজের ছোঁয়া পাচ্ছে।
বর্ডার ফিল্মটা ― আমার খুব প্রিয়। মোবাইলে দেখছি। প্রায়ই দেখি। দেশ ছেড়ে আসার পর দেশের প্রতি টানটা যেন বড্ড বেড়েছে ! তাছাড়া, কিছু মানুষ নিজেদের পরিবার পরিজনকে পেছনে রেখে দেশের জন্য নিজেদের জীবন দিয়ে দিচ্ছেন ― এমন ভাবনা, আমাকে মোহিত করে।
আমার পাশে এক বৃদ্ধ বসে আছেন। মুখে স্মিত হাসি। মাঝে মাঝে বোধহয় আমার মোবাইল স্ক্রিনের দিকে একঝলক তাকাচ্ছেন। চোখে চোখ পড়াতে, একটু ঝুঁকে বললেন ― হ্যালো।
আমিও পাল্টা সৌজন্য দেখিয়ে জানালাম যে আমি শুভ, একজন ভারতীয়। বৃদ্ধ স্তিমিত কণ্ঠে উত্তর দিলেন ― আমি, নিশিজাকি । তুমি কি ওয়ার ফিল্ম পছন্দ করো !
আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ। আমি আমার দেশকে ভালবাসি । আমার দেশের সৈন্যরা ,নিজেদের দেশের জয়গান করতে করতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে, এর থেকে বড় স্যাক্রিফাইস আর কী হতে পারে !
বৃদ্ধ গম্ভীর হয়ে বললেন ― তুমি কোনও দিন যুদ্ধ দেখেছো !
আমি দু দিকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে ― না বললাম।
উনি নিজের মাথাটা সামান্য নামিয়ে, মাটির দিকে চেয়ে বললেন ― ১৯৪২ সালে, আমার বয়স ছিল মাত্র পনেরো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সারা বিশ্বকে নিজেদের পদানত করার জন্য, সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য, শাসকের ইচ্ছেতে, আমাদের মরতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সিম্পলি মরতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি জাপানের নৌবাহিনীতে যোগদান করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে, বাড়ি ছাড়ার সময় মা’র সাথে আমার একটা চুক্তি হয়েছিল।
চুক্তি ! মায়ের সাথে ! সত্যিই ! অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
বৃদ্ধ গোল্ডেন ফ্রেমের ফাঁক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ― মা বলেছিলেন, ” তোমাকে কথা দিতে হবে, তুমি বেঁচে থাকবে আর বাড়ি ফিরবে ..” । পুরো প্যাসিফিক রিজিয়ন জুড়ে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। নৌবাহিনীতে থাকাকালীন একবার ওকিয়ামা-তে (জাপানি দ্বীপপুঞ্জের অংশ) আমাকে একটা সুইসাইড মিশনে যাওয়ার জন্য – বাধ্য করা হয়। মিশন ব্যর্থ হয়। আমরা ধরা পড়ি।
আমি অবাক চোখে সাদা জামার ওপর নীল সোয়েটার পরিহিত বৃদ্ধের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
উনি বলে চললেন, আমাদের সকলকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বেছে বেছে গুলি করে মারা হয়েছিল আমার সহকর্মীদের। আমাকে কেন সেদিন মেরে ফেলা হয় নি, আমি জানি না। হয়তো মায়ের সাথে চুক্তি ছিল যে আমাকে বেঁচে থেকে বাড়ি ফিরতে হবে, সেজন্যই হয়তো …!!!
বৃদ্ধ আসন ছেড়ে উঠে পড়তে উদ্যত হলেন। পরের স্টেশনে নামবেন সম্ভবত। ওঠার সময় , আমার কাঁধে হাত রেখে কানের সামনে মুখটুকু এগিয়ে নিয়ে এসে বললেন ― সিনেমার পর্দায় একজন ডায়িং সোলজারের মুখে কী ডায়লগ বসানো হয় আমি জানি না, কারণ আমি ওয়ার ফিল্ম দেখি না …তবে, মাই ফেলো ফ্রেন্ড, একটা কথা আমি বলতে পারি যে যুদ্ধে আমি চোখের সামনে ― নিজের দেশের বা বিপক্ষের বহু সৈন্যদের, মরতে দেখেছি…
… মারা যাওয়ার আগে বা গুলি খাওয়ার আগে, যারা তোমার মতন বা তোমার থেকেও তরুণ ছিল, তাঁরা তাঁদের মায়ের নাম ধরে চিৎকার করত…
… আর যারা বয়সে অপেক্ষাকৃত বড় ছিলেন, তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়ার আগে নিজেদের সন্তানদের নাম ধরে চিৎকার করতেন… নিজেদের শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু দিয়ে চিৎকার করতেন… স্যরি , মাই ফ্রেন্ড আমি নিজে সৈনিক হিসেবে, এমন কোনও সৈনিককে দেখিনি যিনি মৃত্যুর আগে ― নিজের দেশ বা শাসকের নাম ধরে চিৎকার করেছেন … বিলিভ মি…
আমাকে স্তম্ভিত করে, বৃদ্ধ ক্রমশ ধীর পায়ে, দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। বগিটা বোধহয় একটু বেশিই দুলছিল সেদিন।
আমি মোবাইলটা ― সুইচ অফ করে দিলাম|
পুনশ্চ : বিরাশি বছরের জাপানি ওয়ার ভেটারেন নোবুও নিশিজাকি , বর্তমানে বিশ্বে বেঁচে থাকা গুটিকয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সেনানীদের মধ্যে একজন। (ফেসবুক থেকে)