শস্য চুক্তি ভেঙে যাওয়ায় বাংলাদেশসহ বিপদে পড়বে যেসব দেশ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুলাই ২০২৩, ৯:৫৮:৩৯ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ শস্য রফতানি হয় কৃষ্ণসাগর রুটে। বিশ্বের ‘রুটির ঝুড়ি’ খ্যাত ইউক্রেনের সমুদ্র পথে বিকল্প আর কোনো পথ নেই। গত বছর সংঘাত শুরুর পরপরই তাদের শস্য রফতানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
এর পর জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় গত বছরের জুলাই মাসে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ‘কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এতে শুরু হয় ইউক্রেনের শস্য রফতানি।
তারপর মতানৈক্য থাকলেও আরও কয়েক বার উভয়পক্ষ চুক্তিটি নবায়ন করেছে। এ যাত্রায় গত সোমবার (১৭ জুলাই) ছিল চুক্তিটি নবায়নের শেষ দিন। রাশিয়া বেশ আগে থেকেই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় মস্কো। পুতিন প্রশাসনের অভিযোগ, চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার সার ও শস্য রফতানি সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়নি।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান শস্য ও তেলবীজ উৎপাদনকারী দেশ ইউক্রেন। যুদ্ধের ফলে দেশটির এসব পণ্য রফতানি বন্ধ হওয়ায় বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তবে শস্য চুক্তি খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনতে বেশ সাহায্য করেছিল।
লেবানন, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনের মতো দেশে সহায়তা হিসেবে জাতিসংঘে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) যে পণ্য পাঠিয়েছিল, সেখানেও ইউক্রেন ৭ লাখ ২৫ হাজার ২০০ টন বা ২.২ শতাংশ সহায়তা করতে সক্ষম হয়েছিল।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এতে গোটা বিশ্বে খাদ্য সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি লাগামহীন হয়ে পড়বে খাদ্যের দাম। নাগালের বাইরে চলে যাবে গম, আটা ও ময়দা ছাড়াও এসব পণ্যের তৈরি সব খাবারের দাম। চরম অনিশ্চয়তায় পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা।
বৈশ্বিক খাদ্য ও পানি নিরাপত্তা প্রোগ্রামের পরিচালক কেটলিন ওয়েলস এ প্রসঙ্গে বলেন, এ চুক্তি নবায়ন না হলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে আমদানি নির্ভর দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। কেননা অন্য উৎস থেকে আমদানি আরও সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল হবে। ফলে খাদ্যের সংকট এবং দাম বৃদ্ধি অবধারিত।
চুক্তি থেকে মস্কোর বের হয়ে যাওয়া নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস এরই মধ্যে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনের সঙ্গে করা শস্য চুক্তি থেকে রাশিয়ার বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে বিশ্বের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষ বিপাকে পড়বে।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব আরও বলেন, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এরই মধ্যে ক্ষুধায় ধুঁকছে। খাদ্যের দাম ও জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। শস্য চুক্তি নিয়ে রাশিয়ার এ সিদ্ধান্তের কারণে তাদের আরও চরম মূল্য দিতে হবে। গুতেরেস আরও বলেন, ‘মস্কোর এই পদক্ষেপ বিশ্বের সর্বত্র অভাবী ও দরিদ্র লোকদের বিপাকে ফেলবে।’
বাড়তে শুরু করেছে খাদ্যশস্যের দাম
রাশিয়া একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় এরই মধ্যে খাদ্যশস্য ও তেলবীজের দাম বেড়ে গেছে। গত সোমবার শস্য চুক্তি ভেঙে পড়ার পরপরই বিশ্ববাজারে গম ও ভুট্টার দাম বেড়ে গেছে।
গত সোমবারই (১৭ জুলাই) শিকাগো বোর্ডে প্রতি বুশেল গমের দাম (হুইট ফিউচার) ২ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে ৬ দশমিক ৮০ ডলারে পৌঁছে। অপরদিকে প্রতি বুশেল ভুট্টার (ফিউচার কর্ন) দাম ০ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেড়ে ৫ দশমিক ১১ ডলারে পৌঁছায়। মূলত পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকা ও ঘাটতির শঙ্কা থেকেই একদিনের ব্যবহানে অতি প্রয়োজনীয় এ দুটি খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর মার্চে গম ও ভুট্টার দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তবে ওই সময় সময়ের তুলনায় সোমবার গমের দাম ৫৪ শতাংশ এবং ভুট্টার দাম ৩৭ শতাংশ কম ছিল। তবে আগামী দিনগুলোতে রুটি, পাউরুটি ও পাস্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাবারের দাম নিশ্চিতভাবেই বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে
শস্য চুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অবরুদ্ধ ইউক্রেনীয় শস্য রফতানির পথ সুগম করে বিশ্বের খাদ্য সংকট দূর করা। সবশেষ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত চুক্তির অধীনে ইউক্রেন প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ টন শস্য ও অন্যান্য খাবার সরবরাহ করেছে। যুদ্ধের আগে ইউক্রেন সাধারণত ২ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টন শস্য রফতানি করত।
রাশিয়া চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোয় ইউক্রেনের খাদ্য শস্য রফতানি ও সরবরাহ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এর ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
সবচেয়ে বিপর্যয়কর প্রভাব পড়বে সেসব দেশের ওপর, যারা ইউক্রেনীয় শস্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ-সংঘাত ও অন্যান্য কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই এরই মধ্যে চরম খাদ্য সংকট মোকাবিলা করছে।
বিশ্বে প্রতিবছর যত গম উৎপাদন হয় তার প্রায় ১০ শতাংশই উৎপাদন করে ইউক্রেন। আর ভুট্টা উৎপাদন করে ১৫ শতাশ। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই ইউক্রেনের এসব শস্যের প্রধান ক্রেতা। কম মাথাপিছু আয়ের এই দেশগুলোতে এরই খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য-উপাত্ত বলছে, ইউক্রেনের খাদ্য শস্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল দেশগুলোর তালিকার প্রথম দিকেই রয়েছে লেবানন, পাকিস্তান, লিবিয়া, ইথিওপিয়া, তিউনিশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্যের লেবানন ও এশিয়ার পাকিস্তান খাদ্য সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটও রয়েছে।
খাদ্যের দাম বাড়ার পাশাপাশি শস্য চুক্তি ভেঙে পড়ার মানে নির্ভরশীল দেশগুলোকে খাদ্য শস্য আমদানির জন্য আরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ইউক্রেনকে তার পণ্য পাঠানোর জন্য স্থলপথ ব্যবহার করতে হবে। সেক্ষেত্রে সময় বেশি লাগবে।
ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে
বিশ্বে খাদ্য সংকট কমেনি, বরং গত কয়েক বছরে আরও বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিুউএফপি) গত মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও গৃহযুদ্ধ, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগের কারণে গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বজুড়ে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
গত ১২ জুলাই ‘স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষ একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের বৈশ্বিক খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তা বিষয়ক সংস্থা ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (ফাও), ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট (আইএফএডি), ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে তীব্র খাদ্য-সংকটে ভুগেছেন অন্তত ৭৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। ২০১৯ সালের তুলনায় এই সংখ্যা ১২ কোটিরও বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০১৯ সালে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা হাসিলের মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু বর্তমানে যে হারে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা সম্ভব নয়। উল্টো এই সময়সীমার মধ্যে আরও ৬০ কোটি মানুষ নতুন করে এই তালিকায় যুক্ত হবে।’
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি প্রতিবছর কয়েক কোটি টন খাদ্যসামগ্রী ক্রয় করে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই খাদ্য শস্য। ২০২১ সালে ডব্লিউএফপি যে শস্য কেনে, তার মধ্যে ইউক্রেন থেকে আসে ২০ শতাংশ। ইউক্রেন প্রধানত গম ও ভাঙা মটর সরবরাহ করে। এসব খাদ্যের অধিকাংশই যায় আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার দেশ ইয়েমেনে। খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্যের কারণে তহবিল সংকটে কিছু দেশে কম খাদ্য পাঠায় সংস্থাটি।
সুদূরপ্রসারী প্রভাব
শস্য চুক্তি পতনের খাদ্য উৎপাদনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে ইউক্রেনের ফসল উৎপাদনের পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধের মধ্যে ২০২৩-২৪ মৌসুমে সেখানকার কৃষকরা ভুট্টা ও গমের চাষ কমিয়ে দিতে পারে।
এর ফলে ভুট্টার রফতানি ১৯.৫ মিলিয়নে নেমে আসতে পারে। যেখানে আগের মৌসুমে এর পরিমাণ ছিল ২৮ মিলিয়ন এবং ২০১৮-২৯ সালে ছিল ৩০.৩ মিলিয়ন, যা বিশ্ববাণিজ্যের ১৭ শতাংশ।
অন্যদিকে গম রফতানি কমে ১০.৫ মিলিয়নে নেমে যেতে পারে। যেখানে আগের মৌসুমে ছিল ১৬.৮ মিলিয়ন এবং ২০১৯-২০ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২১ মিলিয়ন, যা বিশ্ববাণিজ্যের ১১ শতাংশ।
পূর্ব ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে এমনকি সেই কম পরিমাণে শস্য রপ্তানি করাও কঠিন এবং ব্যয়বহুল। বিশেষ করে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে যেসব ফসল উৎপন্ন হয়, সেগুলো এমনকি সীমান্তে পৌঁছানোর যাত্রাও দীর্ঘ ও কঠিন।
বাংলাদেশের জন্যও দুঃসংবাদ
গত বছরের ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরপরই রাশিয়া কৃষ্ণসাগরে নৌ অবরোধ দিলে ইউক্রেনের খাদ্য শস্য রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। এতে বড় ধরনের সংকটে পড়ে বাংলাদেশও।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করে প্রায় ১১ লাখ টন (১৫%)। বাকিটা আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে বছরে ২৩ লাখ টন আমদানি হয় ইউক্রেন থেকে।
কিন্তু যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যহত হওয়ায়, বাংলাদেশে গমসহ অন্যান্য খাদ্য শস্য এবং সংশ্লিষ্ট পণ্য যেমন আটা-ময়দা, ভোজ্য তেল, পোল্ট্রি ও বেকারি পণ্যের দামও হু হু করে বাড়তে থাকে। যুদ্ধের আগে যে প্যাকেটজাত আটার দাম কেজি প্রতি ছিল ৩২ থেকে ৩৫ টাকা সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ থেকে ৬৮ টাকায়।
আবার পোল্ট্রি ফিডের সবচেয়ে বড় উপকরণ ভুট্টার আমদানি ব্যহত হওয়ায় মুরগি ও ডিমের দামও চলে গেছে নাগালের বাইরে। এতে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর আমিষের আহারে টান পড়েছে।
গত সোমবার কৃষ্ণসাগর শস্য চুক্তি থেকে রাশিয়া সরে যাওয়ায় বিশ্ববাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশের গমের বাজারে নতুন করে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আমদানিকারকরা।




