জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে যা করেছিল ইরাকে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জুলাই ২০২৩, ১:১৬:০৪ অপরাহ্ন
মূল: মাহমুদ মামদানি, অনুবাদ: সারওয়ার চৌধুরী
ইরাকে বিরতিহীন বোমা হামলার সাথে সমান্তরালভাবে চলছিল জাতিসংঘের অনির্দিষ্টকালের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শাসন। জাতিসংঘ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে ১৯৪৫ সালের সনদ অনুযায়ী বৈশ্বিক শৃঙ্খলা ঠিক রাখার উপায় হিসাবে। তারপর থেকে, নিষেধাজ্ঞাগুলি চৌদ্দ বার ব্যবহার করা হয়েছে, এর মধ্যে বারোটি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাক সেই দেশ যেখানে প্রথমবারের মতো ব্যাপকভাবে নিষেধাজ্ঞাগুলির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যার মানে কার্যত ইরাকের রপ্তানি ও আমদানির প্রতিটি দিক ছিল জাতিসংঘ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং মার্কিন স্বার্থের পক্ষে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ব্যাপক বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ৬৬১ প্রস্তাব মোতাবেক ৬ আগস্ট, ১৯৯০ সালে। সমস্ত আমদানি রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কেবল চিকিৎসা সামগ্রী আর কিছু খাদ্যদ্রব্যের ছাড় ছিল।
একই বছর ৬৬৫ ও ৬৭০ প্রস্তাবের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার জন্য সামুদ্রিক ও বিমান অবরোধ আরোপ করে।
৬৮৭ প্রস্তাবের দ্বারা ১৯৯১ সালে একই মানবিক সতর্কতাসহ নিষেধাজ্ঞার শাসন পুনরায় নবায়ন করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালের প্রস্তাবে আরও একটি সেট অনুমোদিত হয় পেট্রোলিয়াম এবং পেট্রোলিয়াম পণ্য বিক্রয় করার জন্যে। প্রতি ছয় মাসে ১.৬ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। কিন্তু প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হয়নি ১৯৯৫ সালের খাদ্যের জন্যে তেল কর্মসূচির ৯৮৬ প্রস্তাব বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত।
পরে দেখা গেল, নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা বদলাতে থাকে। প্রথমত, এটি ইরাককে কুয়েত থেকে প্রত্যাহার করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। যখন ইরাক কুয়েত ছেড়ে এলো, যুক্তিটি এটিকে নিরস্ত্র করার প্রয়োজনে ব্যবহার করা হল। বিশেষ করে গণবিধ্বংসী রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্র ধ্বংসকরণে। আসল উদ্দেশ্য এর সার্বভৌমত্বের সাথে আপস করা। যখন ১৯৯১ সালের প্রথম দিকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল যে জাতিসংঘ-নিয়ন্ত্রিত ইরাকি তেল বিক্রি হবে মানবিক সহায়তার পণ্য কিনতে। সে-প্রস্তাবে ইরাক আপত্তি জানিয়েছে দেশটির সার্বভৌমত্ব খর্ব করবে বলে। কিন্তু জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার শাসন ইরাকিদের প্রত্যাশার চেয়েও দীর্ঘ সময় অব্যাহত ছিল। সংকট আরও গভীর করা হল, অবশেষে ইরাক জাতিসংঘের প্রস্তাবিত খাদ্যের জন্যে তেল কর্মসূচিতে চুক্তিতে আসতে বাধ্য হল।
এই নিষেধাজ্ঞার শাসন স্বল্প-তীব্রতার সংঘাতের ইতিহাসে সত্যিকার অর্থে একটি অভিনব মানবিক দুঃসময় নিয়ে আসার কৌশল। কিন্তু তারা প্রচার করল মানবাধিকারের জন্যে তারা তা করছে। বলা হয় শাস্তিকে নরম করার জন্যে তারা তা করছে ‘জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়কারীদের’ দ্বারা। বাস্তবে, এটি শত সহস্র, প্রধানত শিশুদের, সম্পূর্ণভাবে এবং ব্যাপকভাবে নির্মম হত্যার সূচনা করেছে। এই শাসন জাতিসংঘের নামে করা হয়েছে। আসলে তা ছিল কম তীব্রতার সংঘাতের জন্য একটি আমেরিকান প্রক্সিতে জাতিসংঘের কাজ।
যেহেতু কোন বিদেশী ঋণ বা বিদেশী বিনিয়োগ নেই—এবং বিদেশী কোন বিনিময় অ্যাক্সেস নেই—অনুমতি দেওয়া হয় নি। প্রোগ্রামটি কাজ করেছে এভাবে: ইরাককে ছয় মাসের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তেল বিক্রি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে (প্রাথমিকভাবে ১.২ বিলিয়ন ডলার নেট, পরে ৩ বিলিয়ন ডলার নেট)। এই তেল বিক্রির টাকা কোথায় গেল? সরাসরি জাতিসংঘের অ্যাকাউন্টে। এই একাউন্টের টাকার তিন ভাগের এক ভাগ(৩০ শতাংশ, পরে ২৫ শতাংশ) নিয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন ক্ষতিপূরণ তহবিল হিসাবে কুয়েতে ইরাকের আগ্রাসনের কারণে।
আরও ১০ শতাংশ জাতিসংঘ নিয়ে গেল অপারেটিং খরচ বাবদ। অবশিষ্ট টাকাও শুধুমাত্র জাতিসংঘ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ঠিকাদার এবং সরবরাহকারীদের দেওয়া হয়েছে খাদ্যসামগ্রী এবং ওষুধ বাবদ।
অর্থাৎ এই ইরাকি তেল বিক্রির দোহাই দেওয়া হয়েছিল বিপদাপন্ন ইরাকি নারী শিশু বৃদ্ধদের মানবিক সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু মোট টাকার অর্ধেক গেছে ক্ষতিপূরণ আর প্রশাসনিক খরচ বাবদ। বাকি টাকা দিয়ে তারা ইরাকের তিনটি প্রশাসনিক অঞ্চলে দেখিয়েছে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। অথচ পনেরাটি প্রশাসনিক অঞ্চলের শিশুমৃত্যু বেড়েছে অপুষ্টি, খাদ্যাভাব ও ওষুধের অভাবে।
(মাহমুদ মামদানি রচিত ‘গুড মুসলিম ব্যাড মুসলিম’ বই থেকে)