সাহিত্যলেখক হওয়া মানে সত্য আবিষ্কারে নিবেদিত থাকা: মিলান কুন্ডেরা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২০ মার্চ ২০২৪, ৩:০৬:০০ অপরাহ্ন
যোগ্যতা ছাড়া ভালোবাসা পাওয়াটাই প্রকৃত ভালোবাসার প্রমাণ
চেক প্রজাতন্ত্রের কথাসাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরা, ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ এর লেখক তিনি ৯৪ বছর বয়সে মারা গেছেন ১১ জুলাই মঙ্গলবার ২০২৩। তার কিছু বই, সাক্ষাৎকার এবং নিবন্ধ থেকে স্মরণীয় কিছু কথা তুলে ধরা হল। অনুবাদ করেছেন অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর-র নির্বাহী সম্পাদক সারওয়ার চৌধুরী
ভালবাসার সবটুকু আসে না ভাষাতে
দুজন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক মায়া কতটুকু আছে তা আপনি তাদের কথা বিনিময় থেকে ষোলআনা বুঝে নিতে পারবেন না।
মায়ার চেয়ে গাঢ়তর কিছু নেই
কারণ ভালবাসার চেয়ে ভারী কিছু নেই। এমনকি নিজের ব্যথার ওজন এত ভারী নয়, যে-ব্যথা একজন অনুভব করে কারও জন্য — এমন একটি ব্যথা কল্পনা দ্বারা তীব্র হয় এবং শত প্রতিধ্বনিতে দীর্ঘায়িত হয়। (আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং)
ভালবাসা কি?
ভালবাসা হল, কারও প্রশংসনীয় গুণ না থাকলেও পাওয়া যায় এমন এক উপহার। যোগ্যতা ছাড়া ভালোবাসা পাওয়াটাই প্রকৃত ভালোবাসার প্রমাণ। যদি একজন নারী আমাকে বলেন: আমি তোমাকে ভালোবাসি কারণ তুমি বুদ্ধিমান, কারণ তুমি ভদ্র, কারণ তুমি আমাকে উপহার কিনে দাও, কারণ তুমি নারীদের তাড়া করো না, কারণ তুমি খাবার তৈরি করো, তাহলে আমি হতাশ; এই ধরনের প্রেম হল নিজের স্বার্থে ব্যবসা করা। এটি শুনতে কতটা সুন্দর যে আমি আপনার জন্যে পাগল, যদিও আপনি বুদ্ধিমান বা ভদ্র নন, যদিও আপনি একজন মিথ্যাবাদী, একজন অহংকারী, একজন বেজন্মা। (স্লোনেস)
লেখক হওয়া বিষয়ে
ছোটবেলায় হাফপ্যান্ট পরার বয়সে আমি অলৌকিক এক মলমের স্বপ্ন দেখতাম, যে মলম শরীরে মেখে নিলে অদৃশ্য হতে পারব। তারপর বয়স বাড়ল আমার, লেখালেখি শুরু করলাম, সফল হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগল। এখন আমি সফল হয়েছি, তবে এখনো আমি সেই মলমটা চাই, অদৃশ্য হওয়ার মলম।
একজন লেখকের জন্য একাধিক দেশে বাস করার সুযোগ একটা বড় অনুগ্রহ। দুনিয়াটাকে কেবল তখনই বুঝতে পারবেন, যদি এটাকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখতে পারেন।
লাফেবল লাভস-এর (১৯৫৯-এ লিখেছিলাম) প্রথম গল্পের পর মনে বিশ্বাস গেঁথে গিয়েছিল — এবার ‘নিজেকে খুঁজে পেয়েছি’। গদ্য লেখা শুরু করলাম, হয়ে উঠলাম একজন ঔপন্যাসিক। আসলে এর বাইরে আমি আর কিছু না। তারপর থেকে আমার নান্দনিকবোধ কোনো রূপান্তর দেখেনি; এটার বিবর্তন ঘটে, আপনার ভাষায় বলতে গেলে, সমান্তরালভাবে।
৪৫ বছর অব্দি চেকোস্লোভাকিয়ায় বাস করেছি। বয়স যখন ৩০ ছিল, তখন থেকেই আমার লেখকজীবনের প্রকৃত ক্যারিয়ারের শুরু। সেদিক থেকে দেখলে, আমি দিব্যি বলতে পারি যে আমার সৃষ্টিশীল জীবনের বড় অংশের উন্মোচন হবে ফ্রান্সে। যতটুকু ভাবা যায়, তার চেয়ে বেশি পরিমাণে আমি ফ্রান্সের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি।
সাহিত্যের লেখক হওয়া মানে সত্যের প্রচারে নিবেদিত থাকা নয়, এর অর্থ হল সত্য আবিষ্কারে নিবেদিত থাকা।
উপন্যাস বিষয়ক
সব প্রশ্নের উত্তর যখন হাতের নাগালে তৈরি থাকে, তখন তা মানুষের মধ্যে নির্বুদ্ধিতার জন্ম দেওয়ার কারণ হয়ে যায়। আর সবকিছুকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে উপন্যাসের প্রজ্ঞা প্রাপ্তি হয়।
একটা উপন্যাস কোনো কিছুকে প্রমাণ করে না; উপন্যাস অনুসন্ধান করে আর প্রশ্ন উত্থাপন করে। আমি জানি না আমার জাতি বিলীন হয়ে যাবে কি না, আমি এও জানি না আমার চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনটি সঠিক। আমি গল্প তৈরি করি, একটাকে আরেকটার সামনে দাঁড় করাই, আর এভাবে আমি প্রশ্ন করি।
আমার কাছে মনে হয় ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে উপন্যাসের গুরুত্ব অনেক বেশি। উপন্যাস ছাড়া একটা ইউরোপীয় মানুষকে ভাবাই যায় না, তাকে তৈরি করেছে এ উপন্যাসই। শত শত বছর ধরে এই মানুষেরা সবার আগে উপন্যাসটাই পড়েছে। অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটা ইউরোপীয়দের একান্ত কাছের। অ্যাডভেঞ্চারকে গুণ হিসেবে দেখা হয়। আপনি যদি বলেন, ‘আমার সারাটা জীবন কাটল অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া’ তাহলে সেটাকে ব্যর্থ বই ছাড়া আর কি বলা যাবে, তা-ই না? এই উপন্যাসই আমাদেরকে অ্যাডভেঞ্চারের এমন কদর করতে গড়ে দিয়েছে মানসিকভাবে।
মহান ঔপন্যাসিক চারজন: কাফকা, ব্রক, মুসিল, গমব্রোভিচ। আমি তাদেরকে ডাকি মধ্য ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের ‘চার মহারথী’ হিসেবে।
যৌনতা প্রসঙ্গে
আজকাল যৌনতা ট্যাবু বিবেচিত না হওয়াতে, হয়ে গেল নিছক বর্ণনা, নিছক যৌন স্বীকারোক্তি, এটা একদম একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। লরেন্স, এমনকি হেনরি মিলারের অশ্লীলতার ভাবমূর্ছনাও কেমন সেকেলে হয়ে গেল।
আরও পড়ুন—
হাফিজ যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন ফারসি গজল
উপন্যাসের লেখকদের নয়, বরং উপন্যাসের ভেতরে থাকা যৌনতা নিয়ে আমাদের আগ্রহ হওয়া উচিত। সব বিখ্যাত উপন্যাস, সব নিখাদ উপন্যাসই উভকামী। এ কথার অর্থ হচ্ছে এগুলো দুনিয়ার নারী ও পুরুষ উভয় দর্শনকে প্রকাশ করে। আর লেখকেরা, যারা বাস্তবে অবস্থান করেন, তাদের যৌনতা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
মধ্য ইউরোপ প্রসঙ্গে
এর সীমান্ত আঁকতে যাওয়াটা অনর্থক হবে। মধ্য ইউরোপ কোনো রাষ্ট্র নয়; এটা একটা সংস্কৃতি বা একটা তকদির অনুযায়ী পাওয়া ব্যাপার।
সত্যি কথা হল, একজন হাঙ্গেরিয়ান, একজন চেক বা পোলের কাছে ইউরোপের অর্থ কী? কয়েক হাজার বছর ধরে তাদের জাতিরা ইউরোপের রোমান ক্রিস্টিয়ানিটিসমৃদ্ধ অংশে বাস করে এসেছে। তারা ইতিহাসের প্রতিটি পরতে অংশ নিয়েছে। তাদের কাছে ইউরোপের কোনো ভৌগোলিক অর্থ নেই, বরং ইউরোপ তাদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক ধারণা যেনবা।
রাশিয়া না, কমিউনিজম হচ্ছে কোনো জাতিকে তাদের সত্তা থেকে বঞ্চিত করার অভিনেতা।