যুক্তরাজ্যের কৃষিকর্মী ভিসা: কত জন যেতে পারবে বাংলাদেশের? বিশেষজ্ঞরা যা বললেন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জুন ২০২৩, ৫:৪৫:১৪ অপরাহ্ন
অনুপম প্রতিবেদক: যুক্তরাজ্য ৪৭ হাজার স্বল্পমেয়াদী মৌসুমি কৃষিকর্মী নিচ্ছে চলতি বছর। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের কিছু কৃষিকর্মী যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশ থেকে এ সুযোগে কৃষিকর্মী যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তবে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের প্রতারক চক্র এ সুযোগের কথা নানাভাবে বলে সহজ-সরল মানুষদেরকে প্রতারণার জালে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, ভিসা প্রসেসের জন্যে রিজেন্সি রিক্রুট লিমিটেড, ইথেরো লিমিটেড এবং আরো তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক টেলপাস্ক কনসোর্টিয়ামকে কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কাসহ আরো কিছু দেশ থেকে প্রতিবছর ৩,৭৫০ জন কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদেরকে। অফিসিয়াল ডকুমেন্টের এক অনুলিপি থেকে জানা গেছে এ তথ্য।
এ প্রক্রিয়ায় কর্মীদেরকে মাত্র ছয় মাসের জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে। চুক্তির মেয়াদ শেষে তাদের ফেরত আসতে হবে নিজ নিজ দেশে।
বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য নিযুক্ত রিজেন্সি রিক্রুটের কর্মকর্তারা জানান, এ কর্মীরা এরপর আবার যুক্তরাজ্যে কাজের উদ্দেশ্যে যেতে চাইলে অভিজ্ঞ হিসেবে অগ্রাধিকার পাবেন।
রিজেন্সি রিক্রুটের পরিচালক নাসিম তালুকদার গণমাধ্যমকে বলেন, “আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার কর্মী নেওয়ার সুযোগ রয়েছে; কিন্তু আমরা প্রথম বছরেই এত সংখ্যক কর্মী পাঠাতে আগ্রহী নই।”
“যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষের একটি শর্ত রয়েছে যে ৯৭% কর্মীকে চুক্তির পর অবিলম্বে দেশে ফিরতে হবে। অন্যথায় আমাদের রিক্রুটিং লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। তাই আমরা পর্যায়ক্রমে ঝুঁকি নেব,” বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, রিজেন্সি রিক্রুট এ বছর বাংলাদেশ থেকে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী ১০০০ এরও কম কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা করছে, যেখানে কৃষিকাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ বলেন, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো এবং ইস্টার্ন ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে এসব কৃষিকর্মী আসার সুযোগ আছে। তবে তাদেরকে ৬ মাস পর ফিরে যেতে হবে। এ ভিসা পেতে তেমন কোনো বিশেষ যোগ্যতা লাগে না। যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে থাকার কোনো সুযোগ নেই এ ভিসার আওতায়।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি বাঙালি কমিউনিটিতে এবার এই ভিসায় স্বজনদের দেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেকে খোঁজ নিচ্ছেন—জানতে চাচ্ছেন সলিসিটরদের কাছে—কীভাবে কি করা যায়।
লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার লুৎফুর রহমান বলেন, এ ভিসা পেতে তেমন কোনো যোগ্যতা লাগে না—কথাটি সত্য, তবে তা বাংলাদেশিদের জন্যে না। তিনি বলেন নির্দিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি ছাড়া অন্য কোনো ফার্ম এ ভিসার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে না। তিনি জানান, একটা এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল হয়ে গেছে এ কারণে যে ওরা কিছু লোক এনেছিল ইন্দোনেশিয়া থেকে, ওই লোকগুলো ফেরত যায় নি বলে এজেন্সিটির লাইসেন্স বাতিল হয়েছে।
জানা যায়, কেবল সুপারস্পন্সরশিপ লাইসেন্স যাদের আছে তারাই এ ভিসায় লোক নিতে পারবে, যেকোনো এজেন্সি পারবে না।
এ বিষয়ে লন্ডন-বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি সৈয়দ নাহাস পাশা বলেন, এ সুযোগে প্রতারক চক্র তৎপর রয়েছে সবখানে, তাই সবাই সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। অতীতেও দেখেছি যখন আনস্কিল্ড কর্মী ভিসা দিয়েছিল এক বছরের জন্যে, তখন অনেকেই তাদের আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে এলেন। তারা আর ফিরে যাননি। পরিণামে ব্রিটিশ সরকারের ধর-পাকড় অভিযানে অনেক রেষ্টুরেন্ট মালিককে ২০ হাজার পাউন্ড করে জরিমানা করা হয়েছে।
ওদিকে সিলেট থেকে যারা কৃষিকর্মী ভিসায় যুক্তরাজ্যে ‘পার হতে’ চান তাদের মতামত এ রকম যে— তারা অনুপমনিউজটোয়েন্টিফোরকে জানালেন, তারা চান যুক্তরাজ্য হয়ে ফ্রান্সে পৌঁছতে। তারা যুক্তরাজ্যে থাকার জন্যে যুক্তরাজ্যে যেতে চান না। কেননা , তাদের বন্ধু স্বজন যারা যুক্তরাজ্য থেকে ফ্রান্সে গিয়েছেন তারা ভাল আছেন, ভাল রুজি করছেন।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের কৃষিকর্মী ভিসায় যারা দেশটিতে কাজ করার সুযোগ পাবে ন্যূনতম বেতন হিসেবে প্রতিমাসে দেড় লাখ টাকা (প্রতি ঘণ্টায় ১০.৪২ পাউন্ড হিসাবে) দেওয়া হবে। রিক্রুটিং ফার্মটি অবশ্য জানিয়েছে, প্রকৃত বেতন মূল অফার থেকে আরও বেশি হবে। সপ্তাহে ৩২ ঘণ্টা নিয়মিত কাজের বাইরে ওভারটাইম করার সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছে তারা।
“ওভারটাইম মিলিয়ে সাপ্তাহিক কাজের সময় ৬০-৭০ ঘণ্টা হতে পারে। সেক্ষেত্রে, শ্রমিকরা ন্যূনতম বেতনের প্রায় দ্বিগুণ টাকা পাবে,” জানালেন নাসিম তালুকদার।
প্রতি কর্মীর জন্য অভিবাসন খরচ হবে প্রায় ২.২ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা। এরমধ্যে রয়েছে বিমানের খরচ, ভিসা আবেদন ফি এবং অন্যান্য খরচ। তারা বিভিন্ন ফল ও সবজির ফার্মে কাজ করবে।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এই বছরের ২১ মার্চ বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য রিজেন্সি রিক্রুটকে অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে আসার [ব্রেক্সিট] পর থেকেই এশিয়ান অঞ্চলের কৃষি কর্মীদের নিয়োগের দিকে ঝুঁকছে যুক্তরাজ্য। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তাদের শ্রমিক ঘাটতি আরও তীব্র হয়েছে।
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির শেফিল্ড পলিটিক্যাল ইকোনমি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ২০২০ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, যুক্তরাজ্যের কৃষি অভিবাসী শ্রমিকদের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে। প্রতি বছর তাদের প্রায় ৭০,০০০ কর্মী প্রয়োজন হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য ২০২২ সালে ৯৪২ জন বাংলাদেশি এবং এই বছরের প্রথম তিন মাসে ৮৭১ জন বাংলাদেশি কর্মীকে বিভিন্ন খাতে নিয়োগ দিয়েছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০,০০০ বাংলাদেশি নাগরিক যুক্তরাজ্যে বসবাস করছিলেন এবং তারা সে বছর বাংলাদেশে ১৫৬০.৪ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন।
এদিকে, যুক্তরাজ্য, নেপাল এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করা কর্মীরা গত মাসে যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন মিনিস্টার রবার্ট জেনরিকের কাছে একটি যৌথ চিঠিতে মৌসুমী কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা অপব্যবহারের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তারা বলেন, এ প্রক্রিয়ায় যেসব নিয়োগ হয় তা আন্তর্জাতিক মান পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। মানবাধিকার অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ফেয়ার স্কয়ারের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও এটি উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের নির্বাহী পরিচালক সিআর আবরার চিঠিতে বলেন, “আমরা খুব ভালভাবেই জানি, এ কর্মীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে শোষণমূলক ফি পরিশোধ এবং খারাপ আচরণের ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। অভিবাসী কর্মীদের আরও ভাল সুরক্ষার জন্য সব রকমের পদক্ষেপ নিতে হবে যুক্তরাজ্য সরকারকে।”
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক শ্রম অধিকার কর্মী অ্যান্ডি হল বলেন, “যদি কর্মীদের এই নিয়োগের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত খরচ এমনকি রিটার্ন টিকিটের খরচ, ভিসা ফি দিতে হয় তাহলে এটি আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করেনা; এটি নৈতিকও না।”
শ্রমিকদের সুরক্ষা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে নাসিম তালুকদার বলেন, “আমরা এই বিষয়ে উদ্বিগ্ন। আমরা গ্যাংমাস্টার এবং লেবার অ্যাবিউজ অথরিটির সাথে যোগাযোগ করছি। যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দুর্বল ও শোষিত শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করে তারা।”
“এছাড়া, কর্মীদের একটি তালিকা লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনেও পাঠানো হবে। যদি কোনো কর্মী মনে করেন যে তিনি কোনো ধরনের শোষণের শিকার হয়েছেন, তাহলে তিনি মিশনের হটলাইন বা ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন,” বলেন তিনি।




