কেন নজরুল হিন্দু মুসলমানের ঐক্য চেয়েছিলেন?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ মে ২০২৩, ১০:০৩:৩৫ অপরাহ্ন
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম
সারওয়ার চৌধুরী
কাজী নজরুল ইসলাম হিন্দু মুসলিম ঐক্য গড়বার সুনির্দিষ্ট কারণ ছিল। এই কারণটাই ছিল পরাধীনতার শৃংখলমুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা। জগতে সবকিছুর যথাযথতা (পার্টিকুলারিটি) আছে। এটা থাকার কারণেই মানুষে মানুষে মিলনের, ভালবাসার, মায়ার কারণ সামনে আসে। এটাই পার্টিকুলারিজম। তোমার গুণে তুমি গুণী, আমার গুণে আমি গুণী, এসো আমরা মিলেমিশে ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হই- সমস্যাটির সমাধান করার জন্যে।
নজরুল বললেন, “আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের কুসংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, বা হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই। অবশ্য এর জন্য অনেক জায়গায় আমার সৌন্দর্যের হানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।” [শব্দ-ধানুকী নজরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা ২৩৬,২৩৭]
এই মিলন প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিত না বুঝলে নজরুলকে কেউ সাম্প্রদায়িক বলতেই পারে। দেখতে হবে তিনি কী কারণে কী করেছিলেন। সবকিছুকে ঢালাওভাবে দেখলে বিষয়কেন্দ্রিক সুবিবেচনা প্রকাশ পায় না। জগতে অযুথ প্রসঙ্গ থরে থরে সাজানো। এসব প্রসঙ্গের যুথবদ্ধতাও আছে।
দেখা গেল, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই ডিসেম্বর কোলকাতা এ্যালবার্ট হলে বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বিপুল সমারোহ ও আন্তরিকতা সহকারে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানে তিনি বললেন, “কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। [নজরুল রচনাবলী – ৮, পৃষ্ঠা ৩, ৫]
তিনি ইসলামের ভিতর নিজেকে রেখেই অন্য ধর্মের মানুষের সাথে সম্প্রীতি রাখার পক্ষে ছিলেন। তিনি জানতেন, যার যার ধর্ম তার তার। সকল প্রাণের ইননেইট নেচারও আলাদা। এই ভিন্নতা নিয়ে ভালবেসে তারা অনুপম সুন্দর হতে পারে।
তাঁর এই প্রচেষ্টা মুলত কালচারাল নয়, রাজনৈতিক অবস্থার ভয়ংকর পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে। তাঁর এই প্রচেষ্টার ভিতর এটা নাই যে, এই দুই সম্প্রদায়ের আলাদা পরিচয়কে উৎখাত করতে চেয়েছেন, কিংবা তিনি নিজেকে ধর্মের বাইরে রেখেছেন। এই বিভ্রান্তি আসতে পারে বলেই নজরুল নিজেই জবাব দিয়েছিলেন তাঁর ‘আমার লীগ কংগ্রেস’ প্রবন্ধের ৬১ পৃষ্ঠায়—
“আমার আল্লাহ নিত্য-পূর্ণ-পরম-অভেদ, নিত্য পরম-প্রেমময়, নিত্য সর্বদ্বন্দ্বাতীত। ‘ইসলাম’ ধর্ম এসেছে পৃথিবীতে পূর্ণ শান্তি সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে – কোরান মজিদে এই মহাবাণীই উত্থিত হয়েছে। ···এক আল্লাহ ছাড়া আমার কেউ প্রভূ নাই। তাঁর আদেশ পালন করাই আমার একমাত্র মানবধর্ম। আল্লাহ লা-শরিক, একমেবাদ্বিতীয়ম। আল্লাহ আমার প্রভু, রসূলের আমি উম্মত, আল-কোরআন আমার পথ-প্রদর্শক। আমার কবিতা যাঁরা পড়ছেন, তাঁরাই সাক্ষী: আমি মুসলিমকে সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য তাদের জড়ত্ব, আলস্য, কর্মবিমূখতা, ক্লৈব্য, অবিশ্বাস দূর করার জন্য আজীবন চেষ্টা করেছি।”
মানে, তিনি ইসলামের ভিতর নিজেকে রেখেই অন্য ধর্মের মানুষের সাথে সম্প্রীতি রাখার পক্ষে ছিলেন। তিনি জানতেন, যার যার ধর্ম তার তার। সকল প্রাণের ইননেইট নেচারও আলাদা। এই ভিন্নতা নিয়ে ভালবেসে তারা অনুপম সুন্দর হতে পারে। পৃথিবীতে যদি কোনো ধর্ম না থাকে, তবু স্বভাবের তারতম্য থাকবে, বিভেদের পরিপ্রেক্ষিত থাকবে। তখনও ভালবাসার পরিপ্রেক্ষিত থাকবে, পার্টিকুলারিজম থাকবে।