নজিরবিহীন ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের, গোপনে যা করা হবে, সরকার চিন্তিত না
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০২৩, ১০:২৭:২৩ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: নজিরবিহীন এক ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে। ওই ঘোষণায় নির্বাচনে বাধা প্রদানকারীদের মার্কিন ভিসা বন্ধের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের অধীনে কেবলমাত্র বাংলাদেশের জন্য ভিসা নীতিটি জারি করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্তকারী ব্যক্তি, পরিবার বা প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের বিরুদ্ধে ভিসায় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে।
বুধবার দিবাগত বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিংকেন ভিসা কড়াকড়ি সংক্রান্ত ওই ঘোষণা দেন।
এটাকে ‘ভিন্নরকম নিষেধাজ্ঞা’ হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ব্লিংকেনের টুইট বার্তা, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ বিষয়ক নতুন ওই ভিসা নীতি বা ঘোষণাটি একযোগে প্রচারিত হয়।
চ্যানেল আই’র তৃতীয় মাত্রায় সরাসরি ডোনাল্ড লু
তাছাড়া তাৎক্ষণিক চ্যানেল আই’র তৃতীয় মাত্রার অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ভিসা কড়াকড়ি বিষয়ক নতুন নীতি নিয়ে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। ব্লিংকেনের ঘোষণায় খোলাসা করেই বলা হয়, বাংলাদেশের অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে কেবলমাত্র বাংলাদেশের জন্য ওই ভিসা নীতি প্রণয়ণ করা হয়েছে। এই নীতির অধীনে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দুর্বল বা বাধা প্রদানের জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্য তথা জীবনসঙ্গী, ছেলে বা মেয়ের ভিসার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপিত হবে।
লু বলেন, আমাদের এই নীতির লক্ষ্য হলো সহিংসতা রোধ করা। আগামী বছরে বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে উৎসাহিত করা। আমার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়। আমাদের এই নীতি প্রধানমন্ত্রী, সরকার, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও বাংলাদেশিরা যাতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পায়, তার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক।
বাংলাদেশের নির্বাচন কেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কেন- জিল্লুর রহমানের এমন প্রশ্নে লু বলেন, বাংলাদেশে কয়েকবার সফরের সুযোগ হয়েছে আমার। এই দেশটি আমাদের কাছে খুব স্পেশাল। জনগণের মধ্যে সম্পর্ক, পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের কোম্পানির মধ্যে সম্পর্ক আছে। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করা আমাদের কেন্দ্রীয় প্রবণতা। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করে।
লু বলেন, আমি জানি এই নীতি অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি করবে। আমি আবারও জোর দিয়ে বলতে চাই, আমরা সবচেয়ে গঠনমূলক এবং ইতিবাচক উপায়ে এই নীতি গ্রহণ করছি। আমরা বাংলাদেশে সংলাপ চাই। সরকার, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ- সবার উদ্যোগ চাই, যাতে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যেখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। এটা হতে পারে বাংলাদেশের কঠিন সময়। এই নির্বাচন হতে পারে আনন্দের। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অগ্রগতি হতে পারে এর মধ্য দিয়ে।
ওই ঘোষণায় ব্লিংকেন বলেন, আমি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের ধারা ২১২(এ)(৩)(সি) (“৩সি”) এর অধীনে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি।
এই নীতির অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত যে কোন বাংলাদেশির ভিসা প্রদান সীমিত করবে। নতুন ভিসা নীতির আওতায় বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পড়বেন।
বাংলাদেশ সরকারকে নতুন ভিসা নীতি বিষয়ক ওয়াশিংটনের ওই সিদ্ধান্তের কথা ৩ মে জানানো হয়েছে বলে মার্কিন বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ভোট জালিয়াতি, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, জনগণকে স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত হওয়ার অধিকার থেকে বিরত রাখতে বল-প্রয়োগ বা সহিংসতা। এছাড়া আছে রাজনৈতিক দল, ভোটার, নাগরিক সমাজ এবং মিডিয়ার স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরির যে কোনো পদক্ষেপ!
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, আইনশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, নাগরিক সমাজ এবং মিডিয়া- প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে। ব্লিংকেন বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যারা এগিয়ে নিতে চান, তাদেরকে সমর্থন দিতে ওই নীতি প্রণয়ণ করা হয়েছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রেস ব্রিফিং
এদিকে রাতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রেস ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে জনগণকে সমর্থন দিতে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ব্রিফিংয়ের শুরুতে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনের বিবৃতি পড়ে শোনান।
এরপর একজন সাংবাদিক জানতে চান, এটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কি-না? জবাবে মিলার বলেন, এটা নিষেধাজ্ঞা নয়, তবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যারা বাধা সৃষ্টি করবে তাদের বিরুদ্ধে ভিসায় বিধি-নিষেধ দেয়া হবে। তাদের সুনির্দিষ্ট নাম গোপনীয়? সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- হ্যাঁ, এটা গোপনেই করা হবে। নির্বাচনে বাধা সৃষ্টিকারী যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।
অন্য একজন সাংবাদিক জানতে চান, এটা কি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সতর্কতা অথবা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনার জন্য কিনা? জবাবে মিলার বলেন- না, এটা আমাদের পক্ষ থেকে একটি সিগন্যাল। যাতে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। এ জন্য দায়ী যেকোনো ব্যক্তিকে জবাবদিহিতায় নেয়ার সক্ষমতা আমাদের আছে। এটা সব বাহিনী, বিচারবিভাগ সহ সবার জন্য একটি সতর্কতা। যদি নির্বাচনে কোনো অনিয়ম দেখতে পাই তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।
নতুন ভিসা নীতি নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন এবং দূতবাসের জবাব:
ওদিকে বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে নতুন ভিসা নীতি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক যে সব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তার জবাব দিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। রাতে দূতাবাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রশ্নোত্তর আকারে তা প্রকাশিত হয়। প্রশ্নোত্তরগুলো পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: মার্কিন ভিসার ওই বিধি-নিষেধ (সীমাবদ্ধতা) কার কার জন্য প্রযোজ্য হবে?
উত্তর: নতুন ভিসা নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এর মধ্যে বর্তমান বা প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী দলের সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত।
প্রশ্ন: এই ভিসা নীতিটি কবে কার্যকর হবে অর্থাৎ এখনই কি বিধি-নিষেধ আরোপিত হবে?
উত্তর: না, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্থনি জে ব্লিংকেন জোর দিয়ে বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্ত করা অঙ্গীকারকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানায়।
প্রশ্ন: ভিসার ওপর ওই বিধি-নিষেধ কি সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে?
উত্তর: না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। এই নতুন নীতির অধীনে নিষেধাজ্ঞাগুলো এমন আচরণে জড়িত ব্যক্তিদের টার্গেট করে, যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এটা দলমত নির্বিশেষে।
প্রশ্ন: আপনি কি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের অবহিত করবেন যে তাদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে?
উত্তর: যাদের ভিসা প্রত্যাহার বা বাতিল করা হয়েছে তাদের জানানো একটি সাধারণ অভ্যাস।
প্রশ্ন: উচ্চ স্তরের আদেশ অনুসরণ করার পরে যারা অপরাধ করে তাদের জন্য ভিসা বিধি-নিষেধ কীভাবে প্রযোজ্য হবে? উচ্চ স্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সঙ্গে যারা আদেশ পালন করছেন তাদের সাথে লিঙ্ক করা কঠিন হলে কী হবে?
উত্তর: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী (অর্থাৎ নির্দেশদাতা এবং বাস্তবায়নকারী) উভয়ের জন্য নীতিটি প্রযোজ্য হবে।
প্রশ্ন: রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নিরাপত্তা (এসকর্ট) কমানো সংক্রান্ত বাংলাদেশ সরকারের ১৪ মে সিদ্ধান্তের প্রতিশোধ হিসেবে কি এটি করা হলো?
উত্তর: না, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩রা মে এই নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা সরকাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সিদ্ধান্তটি এসকর্ট প্রত্যাহারের আগেই নেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেন এত মাথা ঘামায়?
উত্তর: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে সমর্থন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকার বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সমর্থনে অঙ্গীকারবদ্ধ। নতুন ভিসা নীতিটি সেই প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশী জনগণকে সমর্থন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে তারা তাদের পছন্দের নেতা নির্বাচন করতে পারে।
সরকার চিন্তিত নয়: পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
এদিকে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সরকার ‘বিচলিত নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
বুধবার রাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়। এতে সরকার বিচলিত নয়, যেহেতু আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এটা বিএনপির জন্যই দুশ্চিন্তার দাবি করে তিনি বলেন, বিএনপিকে দুশ্চিন্তা করা উচিত, কেননা নির্বাচনের আগে বা পরে সংঘাত রয়েছে ভিসা বিধিনিষেধের আরেকটি মানদণ্ড হিসাবে।