ঢাকা-টোকিও সম্পর্ক কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ এপ্রিল ২০২৩, ৯:৩৮:১১ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘ব্যাপক অংশীদারিত্ব’ থেকে ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফুমিও কিশিদা।
এ সম্পর্ক আগামীতে আরও শক্তিশালী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন দুদেশের প্রধানমন্ত্রী।
বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় টোকিওতে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুদেশের শীর্ষ প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক শেষে যৌথ বিবৃতিতে এ মন্তব্য করেন জাপান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এদিকে টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর ফলপ্রসূ হয়েছে।
যৌথ বিবৃতিতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বলেন, আমরা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত করেছি। আগামীতে এ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যৌথ বিবৃতিতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী কিশিদা এবং আমি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবকিছু নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা আনন্দিত যে বাংলাদেশ ও জাপান সফলভাবে বিদ্যমান সম্পর্ককে ‘ব্যাপক অংশীদারত্ব’ থেকে ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত করেছি।
এর আগে প্রথমবারের মতো চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হয়। ২০১৬ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফরে আসেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ এবং চীনের পক্ষে যৌথ বিবৃতিতে সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হওয়ার ঘোষণা দিয়ে একে অপরের পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সাত বছর পর দ্বিতীয় দেশ হিসাবে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের এ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলো।
কিশিদা বলেন, আজকের বৈঠকে তারা (ফুমিও কিশিদা-শেখ হাসিনা) ‘কৌশলগত অংশীদার’ হিসাবে আইনের শাসনের ভিত্তিতে অবাধ ও উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা সমুন্নত রাখার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন। এখন বিশ্ব ব্যবস্থার ঐতিহাসিক ‘টার্নিং পয়েন্ট’ চলছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গভীর করতে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে সহযোগিতা বাড়াতে দুদেশ একসঙ্গে কাজ করবে।
গত মাসে ঘোষিত অবাধ এবং উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক পয়েন্টের জন্য নতুন পরিকল্পনার কথা উলেখ করে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের বৈঠকে জাপান ও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে সম্মত হয়েছে। কিশিদা বলেন, আমরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাপানের সম্ভাবনা-বাংলাদেশ ইকোনোমিক অংশীদারত্ব চুক্তির বিষয়ে যৌথ সমীক্ষায় ব্যাপকভাবে এগিয়ে যেতে সম্মত হয়েছি। তিনি বলেন, উলেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা বাংলাদেশ একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য। আমাদের প্রত্যাশা অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি দুদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ফুমিও কিশিদা বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা এই ইস্যুতে সহায়তা অব্যাহত রাখব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেন, দুই (জাপান ও বাংলাদেশ) দেশের জনগণ এবং সরকারের মধ্যকার বিদ্যমান চমৎকার বোঝাপড়া, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা আগামী বছরগুলোতে আরও শক্তিশালী হবে।
দুই প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতির আগে তাদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ৮টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। দুদেশের মধ্যকার সহযোগিতা বাড়াতে চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রসঙ্গ উলেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন-কৃষি, শুল্ক, প্রতিরক্ষা, আইসিটি এবং সাইবার-নিরাপত্তা, শিপ আপগ্রেডিং, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, জাহাজ পুনর্ব্যহার এবং মেট্রোরেল বিষয়ে আমরা দুদেশ আটটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি। এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক আমাদের ভবিষ্যৎ সহযোগিতাকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। শেখ হাসিনা বলেন-আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, এই বছরের মধ্যে ঢাকা-নারিতা (টোকিওর অন্যতম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) সরাসরি ফ্লাইট চালু হতে যাচ্ছে।
বৈঠকে বঙ্গোপসাগর এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোকে সংযুক্ত করতে বাংলাদেশ দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়নের জন্য মহেশখালী-মাতারবাড়ি ইন্ট্রিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট উদ্যোগ এবং বিগ-বি উদ্যোগ নিয়েও আলোচনার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিগ-বি’র ধারণা জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের। তিনি ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সফর করেন।
বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হওয়ায় জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার হওয়ায় আমরা জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের সহযোগিতা চাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেছি। রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকাকে মারা ত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। আমরা জাপানকে অনুরোধ করেছি মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে এ সংকটের একটি টেকসই সমাধান খুঁজতে। সূর্যোদয়ের দেশ জাপানের আতিথেয়তার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী কিশিদা এবং জাপান সরকার আমাকে ও আমার প্রতিনিধি দলকে যে আতিথেয়তা দেখিয়েছে, তাতে আমরা গভীরভাবে মুগ্ধ।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা এ নিয়ে ষষ্ঠবার জাপান এলেন। প্রথমবার ১৯৯৭ সালে জাপান সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে তিনি ২০১৯ সালে জাপানে এসেছিলেন। দেশটি ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পরের বছর ১৮ অক্টোবর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সপ্তাহের সফরে জাপানে আসেন। তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ পুনর্গঠনে জাপানের সহযোগিতা কামনা করেন। এসময় দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তানাকা কাকুয়ে বাংলাদেশকে ৯শ কোটি জাপানি মুদ্রা সহজ শর্তে ঋণ হিসাবে দেওয়ার ঘোষণা প্রদান করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, সুন্দর দেশ জাপানে আসাটা আনন্দের। জাপান সব সময় আমাদের হৃদয়ে। দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি সম্পন্ন করার পর সরকারি সফরে টোকিওতে আসতে পেরে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাপান বাংলাদেশের মানুষের হৃ দয়ে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথমদিকে ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি যে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাপান তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজপ্রাসাদে (ইমপেরিয়াল প্যালেস) জাপানের সম্রাট নারুহিতোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার তার কয়েকজন মন্ত্রীসহ সম্রাটের অতিথি ভবন আকাসাকা প্যালেসে উঠেছেন। এর আগে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চতুর্থবার জাপান সফরে এসেও তিনি এই প্যালেসে উঠেছিলেন। বাকি চারবার শেখ হাসিনা পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ছোট বোন শেখ রেহানা ও আদরের ভাই শেখ রাসেলের স্মৃতিবিজড়িত নিউ ওতানি হোটেলে ওঠেন। এবার রাজকীয় অতিথি ভবন ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে না উঠতে পারলেও তার সফরসঙ্গীদের এ হোটেলেই (নিউ ওতানি) রেখেছেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার আমন্ত্রণে মঙ্গলবার দ্বিপাক্ষিক সফরে টোকিও আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানা তার সঙ্গে রয়েছেন। এ যাত্রায় তিন দেশ সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপান সফর শেষে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী টোকিও থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন যাবেন। যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করে ৪ মে বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যের লন্ডন যাবেন তিনি। তিন দেশ সফর শেষে ৯ মে মঙ্গলবার সকালে তার ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।




