বিশ্ব ইজতেমায় যে ছয় বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩, ৯:১৫:১৫ অপরাহ্ন
নবীজি ইরশাদ করেন, অবশ্যই দান খয়রাত মানুষের হায়াত বৃদ্ধি করে। অপমৃত্যু থেকে বাঁচায় এবং অহমিকা দূর করে
অনুপম নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে প্রথমবারের মতো কাকরাইল মসজিদের ভেতরে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তাবলিগ জামাতের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দিন দিন লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগাড় গ্রামের কাছে (টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের নিকটে) একটি মাঠে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই ইজতেমায় বিদেশি কয়েকটি জামাতও অংশ নেয়। এখান থেকেই এর নাম হয় বিশ্ব ইজতেমা। ১৯৬৭ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদের পারে প্রথমবারের মতো বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তুরাগ পারের ১৬০ একর জমি তাবলিগ জামাতের জন্য বরাদ্দ দেয়।
সংরক্ষিত ইতিহাস অনুসারে মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি (রহ.)-এর হাত ধরে ১৯২৭ সালে উপমহাদেশে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের সূচনা হয়। মাওলানা আবদুল আজিজের মাধ্যমে ১৯৪৪ সালে বাংলাদেশে তাবলিগের কাজ শুরু হয়। তাবলিগ জামাতের কাজ প্রসার লাভ করলে তাবলিগ জামাতের অনুসারীদের এলাকাভিত্তিক সম্মেলনের সূচনা করেন মাওলানা ইলিয়াস (রহ.)। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দুই পাকিস্তান ও ভারতে সম্মিলিত ইজতেমার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
শেখ জনূরুদ্দীন (রহ.) দারুল কুরআন চৌধুরীপাড়া মাদ্রাসার শিক্ষক মুহাম্মদ এনায়েত কবীর ‘বিশ্ব ইজতেমায় কী শেখানো হয়’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখেছেন-
বিশ্ব ইজতেমা পাপমুক্ত নির্মল জীবন গঠনের উজ্জ্বল প্রাঙ্গণ। লাখো মানুষের নৈতিক ও মানবিক প্রেরণার উৎস। ধৈর্য, পরোপকার ও শৃঙ্খলার এক উজ্জ্বল নমুনা। এখানে এসে অগণিত মানুষ গ্রহণ করেন জীবন বদলের অঙ্গীকার। মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আদর্শের আঙিনায় রোপণ হয় নৈতিকতার বিজ। অগণিত মানুষ পায় আলোর দিশা। পথহারা বনি আদম গ্রহণ করে নবী ও সাহাবীদের আদর্শে জীবন রাঙানোর দৃঢ় শপথ। ধনী-দরিদ্র সাদা-কালোর বৈষম্যের দেয়ালকে দূর করে সবাই শামিল হন এক কাতারে।
তিনি জানান-
কুরআন ও সুন্নাহর ওপর চলার জন্য ইজতেমায় ছয়টি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
১ নাম্বার হলো ইমান। কেননা একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দামি জিনিস হচ্ছে ইমান। শত প্রতিকূলতা ও বাধার মুখেও একজন মানুষ ইমানের প্রশ্নে আপস করতে পারে না। প্রয়োজনে নিজের প্রিয় জীবন বিলিয়ে দিতেও প্রস্তুত থাকে। সাহাবায়ে কেরামের জীবনীতে এর ভূরি ভূরি নজির রয়েছে।
ইমানকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় কেন? কারণ ইমানহীন মানুষ উভয় জগতেই কষ্ট ও সংকীর্ণতার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়। কুরআনে কারীমে আল্লাহতায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি আমার হেদায়েত থেকে বিমুখতা প্রদর্শন করে অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত এবং কেয়ামতের দিন তাকে অন্ধ করে উপস্থিত করব। সূরা তহা: ১২৪
কুরআনে কারীমের অন্যত্র এসেছে, ইমানহীন ব্যক্তির নাজাতের জন্য দুনিয়াতে যা কিছু আছে তা এবং এর সমপরিমাণ জিনিস বদলা দিলেও তা গৃহীত হবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। সূরা মায়েদা: ৩৬
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, আর যারা ইমানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাদের জন্য পৃথিবী সমান স্বর্ণ দিয়েও দিলেও তা কবুল করা হবে না বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। সূরা আল ইমরান,আয়াত : ৯১
দ্বিতীয় যে বিষয়টির গুরুত্ব দেওয়া হয় তা হলো নামাজ। কারণ কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব হবে। কয় ওয়াক্ত নামাজ বাদ গেল, কয় ওয়াক্তের কাজা পড়া হলো, কয় ওয়াক্ত একেবারেই পড়া হয়নি এর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব হবে। তাছাড়া একজন ইমানদার ও বেইমানের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টিকারী অন্যতম বিষয় হলো নামাজ।
তৃতীয় বিষয় হলো ইলিম ও জিকির। জ্ঞান হলো আলো। অন্ধকারে আলো ছাড়া শুধু চোখে দেখে পথচলা যায় না। তেমনিভাবে ইলিম ছাড়া সঠিক ইবাদত করাও অসম্ভব। যেমন আপনি ঢাকা যাবেন। তাই যেকোনো বাসে চড়ে বসলেই হবে না। বরং ঢাকাগামী বাসের জ্ঞান আপনাকে থাকতে হবে। আর জিকিরের গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা নিজেই বলেন, তোমরা আমার জিকির করো আমিও তোমাদের স্মরণ করব। সূরা বাকারা, ১৫২
হাদিসে পাকে নবীজি বলেন, জান্নাতে প্রবেশের জান্নাতিরা দুনিয়ার কোনো কিছুর জন্য আফসোস বা আক্ষেপ করবে না। তবে আফসোস করবে ওই সময়টুকুর জন্য যে সময়টুকু সে আল্লাহর স্মরণ ছাড়া অতিবাহিত করেছে।
চতুর্থ বিষয় হলো ইকরামুল মুসলিমিন বা পরোপকার। মানুষ সামাজিক জীব। পরোপকারী হওয়া ছাড়া সামাজিক হওয়া যায় না। প্রকৃত সামাজিক মানুষ অন্যের দুঃখে পাশে দাঁড়ায়, সহমর্মী হয় এবং তার মুখে হাসি ফোটাতে চেষ্টা করে থাকে। এ বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করে নবীজি বলেন, তোমরা জগত বাসীর প্রতি সদয় হও, তাহলে আল্লাহতায়ালাও তোমাদের প্রতি সদয় হবেন। সুনানে তিরমিজি: ১৮৪৭
পরোপকার দ্বারা নিজের লাভই বেশি। বিপদ আপদ থেকে বাঁচার অন্যতম পথ হলো এই পরোপকার। নবীজি ইরশাদ করেন, অবশ্যই দান খয়রাত মানুষের হায়াত বৃদ্ধি করে। অপমৃত্যু থেকে বাঁচায় এবং অহমিকা দূর করে। আল-মুজামুল কাবীর: ১৩৫০৮
ইসলাম পরোপকার ও সহানুভূতির ধর্ম। পরোপকারী হওয়া ছাড়া কেউ আদর্শ মানুষ হতে পারে না। মানুষের আদর্শ গুণগুলোর অন্যতম একটি হলো এই পরোপকার। নবীজি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মানুষের বেশি উপকার করে, সেই সেরা মানুষ। আল-মুজামুল আওসাত: ৫৭৮৭
পঞ্চম বিষয় সহীহ নিয়ত। যেকোনো আমলের গ্রহণযোগ্যতার প্রথম শর্ত হলো সহীহ নিয়ত। নিয়তে সমস্যা থাকলে আমলের কোনো মূল্য নেই। অশুদ্ধ নিয়তের কারণে শুধু আমলই নষ্ট হয় না বরং ব্যক্তিকেও হুমকির মুখে পড়তে হয়। এক হাদিসে নবীজি বলেন, আল্লাহতায়ালা কারো বাহ্যিক সুরত ও সম্পদ দেখেন না। বরং তিনি দেখেন বান্দার অন্তর এবং আমল। সহীহ মুসলিম: ৬৫৪৩
এক হাদীসে নবীজি ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা শুধু সেই আমলটুকুই কবুল করেন, যা ইখলাসের সাথে তার সন্তুষ্টির জন্য করা হয়। সুনানে নাসাই, হাদীস নং ৩১৪২
অপরে এক হাদিসে নবীজি বলেন, নিশ্চয়ই কিয়ামত দিবসে মানুষেদের উঠানো হবে তাদের ইখলাসের ওপর। ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪২২৯
ইখলাসের সাথে শুদ্ধ নিয়তে আমলের প্রতিদান কী? নবীজির ইরশাদ করেন, ইখলাসের সঙ্গে আমলকারীদের সুসংবাদ দাও। কেননা তারা অন্ধকারে প্রদীপস্বরূপ। তাদের দ্বারা ফেৎনার অন্ধকার দূর হযে যায়। বায়হাকী, হাদিস: ৩৪৩
ষষ্ঠ বিষয় হলো দাওয়াত ও তাবলিগ। এ প্রসঙ্গে কুরআনে পাকে আল্লাহতায়ালা বলেন- হে রাসূল! আপনি তাবলিগ করুন বা পৌঁছে দিন, যা আপনার কাছে আপনার রবের তরফ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। যদি তা না করেন, তবে আপনি আল্লাহর পয়গাম পৌঁছালেন না। সূরা মায়েদা: ৬৭
এই আয়াত থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, দাওয়াত ও তাবলিগ ছিল নবীজির অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। নবীজির পর উম্মতে মুহাম্মদী যে এ দায়িত্ব পালন করবে তা কুরআনের ওপর আয়াত দ্বারা পরিষ্কার বুঝে আসে। আল্লাহতায়ালা বলেন- তোমাদের মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভালো কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। সূরা আল ইমরান আয়াত :১১০’।