বছরশেষের হিসাব: যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে রেকর্ড আঘাত ২০২২-এ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:১৯:২৭ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ২০২২ সাল যুক্তরাজ্যের বাজারের জন্য একটি নাটকীয় বছর বলা যায়। এ বছর দেশটির মন্দার সূত্রপাত হয়। এটি ৪১ বছরের ইতিহাসে প্রথম উচ্চ পরিমাণের মুদ্রাস্ফীতির কবলে পড়ে।
বিশ্বের শীর্ষ সারির অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশ যুক্তরাজ্য। সেই উপনিবেশবাদ থেকে শুরু করে আজও বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতির মোড়লের ভূমিকা পালন করছে দেশটি। তবে ২০২২ সাল শক্তিধর যুক্তরাজ্যের জন্য ছিল ভয়াবহ বছর। এ বছরই অর্থনীতিতে বেশ টালমাটাল অবস্থায় পড়ে দেশটি।
১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যের মন্দা কাটাতে মার্গারেট থার্চারের চেষ্টার পর আবার মন্দায় পড়া দেশটিকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন দুজন প্রধানমন্ত্রী। অর্থনৈতিক মন্দা সামলাতে না পেরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন বরিস জনসন ও লিজ ট্রাস।
মন্দা শুরু হয় যখন যুক্তরাজ্যে উন্নয়ন অর্থনীতির তুলনায় বসবাসের খরচ বাড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। খরচ বাড়ার অংশ হিসেবে বাড়ির জ্বালানি দাম বৃদ্ধি ও অস্থাবর সম্পত্তি সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধক রাখতে হয়। আগে এগুলোর মুখোমুখি কখনো হয়নি যুক্তরাজ্যবাসী। এদিকে, ব্রেক্সিট (ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ) কার্যকরের প্রভাবে কোম্পানিগুলোর নিয়মিত যোগানের ধারা বাধাগ্রস্তের অন্যতম কারণ।
স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত শেয়ার ও বন্ডের তথ্যানুযায়ী, মোট ৫৫০ বিলিয়ন পাউন্ড বাজার মূল্য নিঃশেষ হয়ে গেছে।
এডিনবার্গভিত্তিক আমটি বিশ্ব বিনিয়োগে ফান্ড ম্যানেজার আন্না ম্যাকডোনাল্ড বলেন, আসলে ২০২২ সাল অনেক কঠিন বছর। অর্থের মূল্য আমাদের বেশ দুর্বল চিত্র প্রকাশ করছে। পাঠকদের জন্য যেসব বিষয়ে জোরেশোরে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তা উল্লেখ করা হলো:-
সিংহাসনচ্যুত লন্ডন
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের তথ্যানুযায়ী, এ বছরে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজারে নিজেদের সিংহাসন হারিয়েছে যুক্তরাজ্য। প্রাথমিক তালিকাগুলোর সমন্বিত বাজার মূলধনে গত ১৫ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের ছিল ২.৯৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর প্যারিসের ইপিএএস ও এডিআরএস এর সমন্বিত মূলধন এখন ২.৯৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এ বছর শেয়ারবাজারের মূলধনে শুধু ফান্স নয়, ভারত ও সৌদি আরবের পেছনে পড়েছে যুক্তরাজ্য। এ বছর ব্রেন্ট ক্রুডের বিক্রি ১৪০ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছায় শেয়ারবাজারে লাভবান হয়েছে সৌদি আরব। সৌদির তেল কোম্পানি সৌদি আরমকো শেয়ার বাজারের অর্ধেকের বেশি মূলধন বহন করছে এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানির মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
জুপিটার এসেট ম্যানেজম্যানেটর জরুরি বাজারের সমতা বিনিয়োগ ব্যবস্থাপক নিক পেনি বলেন, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কম দামে কিনে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হয়েছে।
পাউন্ডের অশান্ত বছর
গত সেপ্টেম্বরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস ও তার অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্টেংয়ের কথিত মিনি বাজেটে এক গুচ্ছ কর মওকুফের ঘোষণা করা হয়। সেই সময় অর্থ্যাৎ সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ডলারের বিপরীতে উচ্চপর্যায়ের ব্রিটিশ মুদ্রায় ধস নামে। সেই ঘোষণার সঙ্গে মুদ্রার বাজারকে ধ্বংস করেছিল। কারণ, দেশ চালানোর জন্য সরকার অনেকে টাকা ঋণ করতে যাচ্ছি। ঐ সময় ডলারের বিপরীতে সর্বকালের সবচেয়ে কম পাউন্ড মূল্য ১.০৩৫- তে চলে আসে।
লিজ ট্রাসের পর যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন ঋষি সুনাক। তিনি এখনো অশান্ত পাউন্ডকে শান্ত করতে পারেননি।
এএক্সএ বিনিয়োগের ব্যবস্থাপক কোর বিভাগের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা ক্রিস ইগো বলেন, ব্রেক্সিটের কারণে যুক্তরাজ্যের আজকের চিত্র কলঙ্কিত হয়েছে। আমরা সেপ্টেম্বরে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখেছি।
নির্ধারিত সুদ নিরাপত্তার অবস্থার ঊর্ধ্বগতি
২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের ১০ বছরের নির্ধারিত সুদের বন্ধকের চেয়ে দুই শতাংশ বেড়েছে, যা ১৯৯৪ সালের পর সবচেয়ে বেশি। তিন দশকের চেয়ে বেশি সময়ে দ্রুত গতিতে সুদের হার বাড়ায় দ্য ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। এতে মন্দা ডাবল ডিজিটে প্রবেশ করেছে।
২০২৩ সালের অবস্থান সম্পর্কে ব্ল্যাকরক ইনকর্পোরেশন স্ট্রেসেজিসটিস্ট জানায়, মিনি বাজেট থেকে উৎপাদন কমছিল। কিন্তু আর্থিক বছরের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন হয়নি।
কর্পোরেট ঋণে খরা
চলতি বছরের অস্থিরতার বিভিন্ন লড়াইগুলোর মধ্যে অনেক খাঁটি বন্ড বিক্রি অব্যাহত ছিল। এটি চুক্তি ছাড়াই মিনি বাজেটের দুই সপ্তাহ পরও এটি ছিল। এটি আসন্ন বিনিয়োগ দায়িত্ব সংকট সৃষ্টি করেছিল।
সুদের নিরাপত্তাসহ প্রায় ১১৫ বিলিয়ন পাউন্ডসহ মুদ্রাপতন হয়। এটি ২০১৮ সালের পর ঘটে। তখন বেক্সিট চুক্তি নিরাপত্তার সময় যুক্তরাজ্যের সংগ্রামকে বিনিয়োগকারীরা ভয় পেয়েছিলেন।
এফটিএসই ১০০ মুহূর্ত
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে শেয়ারবাজারে মূলধন বাড়ার অভাবে ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার জন্য গণভোট করে যুক্তরাজ্য। এরপর থেকে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস স্টক এক্সচেঞ্জ (এফটিএসই) ১০০ সূচক থেকে উজ্জ্বল অবস্থা থেকে ছিটকে পড়ে দেশটি। যখন প্রফুল্ল ধরনের পণ্যের দাম অর্জন অনুপ্রাণিত হয় তখন দুর্বল পাউন্ড রফতানিকারকদের লাভবান করতে থাকে। তার মধ্যে রয়েছে গ্লেনকোর এবং শেল প্লেকের মতো প্রতিষ্ঠান। নন-সাইক্লিক্যান পণ্য- প্রধান ও স্বাস্থ্য বিষষক পণ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস স্টক এক্সচেঞ্জে গুরুত্ব পায়। কারণ তখন বিনিয়োগকারীরা নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে চেষ্টা করছিলেন।
যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ শেয়ারবাজারে সর্বনাশ
যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ শেয়ার বাজারের বাজে অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটগুলো নিজেদের গুটিয়ে নেয়। কারণ ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫০ মিডক্যাপ সূচি ও অন্যান্য সূচিতে দেশটির অভ্যন্তরীণ শেয়ারে লক্ষ্যবস্তু করে। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস স্টক এক্সচেঞ্জের স্থানীয় সূচিতে এ বছর ২০ শতাংশ মূলধন কমেছে। এটি ২০০৮ সালের পর বড় অর্থনৈতিক সংকট। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির মন্দার কারণে সুদের হার বাড়বে। বেক্সিট যুক্তরাজ্যের আবাসন খাত, ব্যাকিংখাত, রিয়েল স্টেটে বিনিয়োগ ও খুচরা খাতকে ধ্বংস করেছে।
শেয়ার কেনাবেচায় মন্দা
লন্ডন শুধু মার্কেটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তারা তাদের মূলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি প্রাইভেট কোম্পানি থেকে সাধারণ জনগণের কাছে শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়ার পন্থা কমে গেছে। ২০০৯ সাল থেকে ইউরোপীয়দের শেয়ার বিক্রির প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে এসে পড়েছে।
ব্লুমবার্গের তথ্যানুযায়ী, এবার লন্ডন মাত্র ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড শেয়ার জনগণের মধ্যে ছাড়তে পেরেছে।




