নিহত রুবিনার ছেলে আর ভাই বোনের কান্না থামছে না, যেভাবে টেনে নিচ্ছিল গাড়িটি (ভিডিও)
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১:৩৯:৫৩ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চাকরিচ্যুত শিক্ষক আজহার জাফর শাহর গাড়ির চাপায় শুক্রবার বিকেলে নিহত হন মা রুবিনা আক্তার। মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই বাবাহারা একমাত্র সন্তান আরাফাত রহমানের (রোহান) কান্না থামছে না। শনিবার সন্ধ্যায় আজিমপুর কবরস্থানে রুবিনার দাফনের পর এ কথা বলে ডুকরে কেঁদে ওঠেন রুবিনার বড় ভাই রোহানের মামা জাকির হোসেন।
তিনি বলেন, ‘করোনায় রোহানের বাবা মারা যান। এরপর মা-ই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়স্থল। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে ভাগিনা আমার একা হয়ে গেল।’
জাকির হোসেন বলেন ‘কাল থেকে ভাগিনার কান্না থামছে না। কী বলে সান্ত্বনা যে দেব। ছেলেটা বাবা হারাল, মাও হারাল। এতিম হয়ে গেল। আর এত নিষ্ঠুর মৃত্যু হলো বোনের।’ তবে ভাগিনা তার সন্তান হয়ে থাকবে জানিয়ে জাকির হোসেন বলেন, ‘সে আমার সন্তান হিসেবে থাকবে।’
বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, ‘খুব নির্মমভাবে বোনটার মৃত্যু হয়েছে। আমার বোনকে বাঁচাতে পারলাম না। মোটরসাইকেলে আমার হাজারীবাগের বাসায় আসতেছিল রুবিনা। শাহবাগ পার হয়ে সড়কে তাকে প্রাইভেটকার ধাক্কা দেয়। তারপর নীলক্ষেত পর্যন্ত তাকে টেনে নিয়ে যায়। তার কী যে কষ্ট হচ্ছিল আমি অনুভব করি। আমার বোনটা বাঁচতে পারত। আমরা মামলা করেছি। সঠিক বিচার আমরা চাই।’
রুবিনার বোন সুলতানা লিপি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর রুবিনা একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। সেও যে চলে যাবেন, এটা কখনো ভাবতে পারিনি।
কাঁদছেন রুবিনার বড় ভাই জাকির হোসেন মিলন
রুবিনা আর আসবে না সাত ভাই-বোনের মিলনমেলায়
পাঁচ ভাই, দুই বোনের মধ্যে রুবিনা আক্তার খান রুবি ছিলেন ষষ্ঠ। পাঁচ ভাইয়ের কেউ চাকরি করেন, কেউ ব্যবসা করেন। এ কারণে শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সবাই ব্যস্ত থাকেন। আর শুক্রবার এলেই সব ভাই-বোন একত্রিত হতেন রাজধানীর হাজারীবাগের বাসায়। সাত ভাই-বোন একত্রে খাওয়া-দাওয়া করতেন, খোশগল্প আড্ডায় মেতে উঠতেন।
পারিবারিক সেই মিলনমেলায় রুবিনা সব সময় উপস্থিত থাকত। এখন থেকে তাকে আর কোনোভাবেই পাওয়া যাবে না, সেই আড্ডায়। সাত ভাই-বোন থেকে একটি সংখ্যা চিরদিনের জন্য আমাদের নাই হয়ে গেল। বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন প্রাইভেটকারে টেনেহিঁচড়ে পিষে নির্মমভাবে নিহত রুবিনা আক্তারের বড় ভাই জাকির হোসেন মিলন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে মরদেহ নিতে এসে বোনের কথা বলতে বলতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন জাকির হোসেন। মর্গে আসা রুবিনার অন্যান্য ভাই-বোন, স্বজনদের কান্নায়ও এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কে কাকে সান্ত¡না দিবে, সঙ্গে আসা স্বজন, প্রতিবেশী তাদের সান্ত¡না দিতে গিয়ে তারাও শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন।
গত শুক্রবার বেলা ৩টার দিকে দেবর নুরুল আমিনের মোটরসাইকেলে চড়ে তেজকুনিপাড়ার শ্বশুর বাড়ি থেকে হাজারীবাগে বাবার বাড়িতে যাওয়ার পথে ঢাবির সাবেক শিক্ষকের গাড়ি চাপায় নিহত হন গৃহবধূ রুবিনা আক্তার খান রুবি। এ ঘটনায় শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাতে রুবিনার ভাই জাকির হোসেন বাদী হয়ে গাড়ি চালক মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। এতে ৯৮ ও ১০৫ ধারায় অভিযোগ করা হয়েছে। মামলায় ঢাবির সাবেক শিক্ষক মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহকে গ্রেপ্তার দেখানো হলেও আহত হওয়ার কারণে তাকে শনিবারও আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ জানান, সড়ক পরিবহন আইনে নিহত রুবিনা আক্তারের ভাই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন। এতে আসামি করা হয়েছে প্রাইভেটকারের চালক ঢাবির সাবেক শিক্ষক মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহকে। যিনি ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন। সুস্থ হলে তাকে আদালতে হাজির করা হবে।
এদিকে শনিবার বেলা ৩টায় ঢামেক হাসপাতাল মর্গে রুবিনার মরদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়। পরে তার মরদেহ পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। ঢামেক মর্গ থেকে রুবিনার মরদেহ প্রথমে নেওয়া হয় ৫৭/২ তেজকুনিপাড়ায় তার শ্বশুর বাড়িতে। সেখান থেকে সন্ধ্যা পাঁচটায় নেওয়া হয় পৈতৃক নিবাস হাজারীবাগের ভাগলপুর লেনের ৩ নম্বর বাসায়। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষমাণ ছিল নিহত রুবিনার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও ছোটবেলার খেলার সাথীরা।
মেইন রোড থেকে সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স পাড়ায় ঢুকতেই এলাকাবাসীর উপচেপড়া ভিড় জমে সেখানে। এক নজর রুবিনার মরদেহ দেখতে শিশু, বৃদ্ধা থেকে সব বয়সী মানুষ ভিড় করেন। কান্নায় ভেঙে পড়েন তারাও। সে সময় এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভাগলপুর লেনে রুবিনার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর চোখের জলে তাকে শেষ বিদায় জানায় ভাই, বোন, স্বজন ও এলাকাবাসী। পরে রাতে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয় রুবিনার মরদেহ।
রুবিনার ভাই জাকির হোসেন বলেন, আমার বোনটা অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির ছিল। আমরা প্রতি শুক্রবার সব ভাই-বোন একত্রিত হয়ে আড্ডা দিতাম। কী যে আনন্দ লাগত আমাদের। এখন থেকে শুক্রবারের আড্ডাখানায় আমার বোনকে আর পাব না।
স্বজনরা বলছেন, রুবিনার স্বামী মাহবুবুর রহমানের লিভারের সমস্যা ছিল। লিভারের সমস্যা ও করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন। মাহবুবুর রহমান মারা যাওয়ার পর মা রুবিনার কাছেই বড় হচ্ছিল একমাত্র ছেলে রুহান। রুবিনাও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। রুহানের সব আবদার তার মায়ের কাছেই করত। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে রুহানের শেষ অবলম্বন মাকেও হারাতে হয়েছে। তার এখন আর কেউ রইল না।
এদিকে ঘটনার দিন উত্তেজিত জনতার গণধোলাইয়ে আহত ঘাতক গাড়িচালক ও ঢাবির সাবেক শিক্ষক আজহার জাফরকে ঢামেক হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি রাখা হয়েছে। শনিবার দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, পুলিশি পাহারায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন তিনি। তার মাথায়, শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন।
নৈতিক স্খলনের অভিযোগে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে তার সহকর্মীদের কেউ কেউ বললেও ঢাবি’র প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী জানান, ক্লাসসহ একাডেমিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে ২০১৮ সালে আজহার জাফর শাহকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
এরপর থেকে আজহার জাফর বাসায় থাকতেন। গুলশানে তার একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। তবে ঘটনার দিন তিনি কোথায় যাচ্ছিলেন সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ বলছে, আজহার জাফর সুস্থ হওয়ার পর তাকে এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে এবং কোর্টে হাজির করা হবে।
সেই গাড়ি চালক ঢাবির সাবেক শিক্ষক আজহার জাফর এবং গাড়িটির নিচে পড়া রুবিনা আক্তার
হত্যাকান্ড বলছে পুলিশ
রুবিনার মৃত্যুর ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা নেওয়া হলেও এটিকে ‘হত্যাকান্ড’ উল্লেখ করেন পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, এটা অবশ্যই একটি হত্যাকান্ড। আমরা জানতে পেরেছি, নিহত মহিলা দেবরের সঙ্গে বাইকে করে শ্বশুরবাড়ি থেকে তার বাপের বাড়ি হাজারীবাগে যাচ্ছিলেন। পথে শাহবাগ থেকে টিএসসি যাওয়ার সড়কে কাজী নজরুলের মাজারের উল্টোদিকে পৌঁছান, তখন প্রাইভেটকারটি মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিলে রুবিনা পড়ে গিয়ে প্রাইভেট কারের সঙ্গে আটকে যান।
এরপরও উনি গাড়িটি না থামিয়ে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিতে থাকে। তাকে থামানোর অনেক চেষ্টা করা হয়। উনি টিএসসি পৌঁছালে আমাদের মোবাইল টিমও তাকে থামানোর চেষ্টা করে। তারপরও উনি না থামিয়ে আরও জোরে গাড়ি চালিয়ে নীলক্ষেত মোড়ে গেলে উত্তেজিত জনতা তাকে থামতে বাধ্য করে। এই সম্পূর্ণ সময় সেই নারীটি গাড়ির সঙ্গে ছেঁচড়ে গেছেন। তাই এটিকে হত্যাকান্ড বলা চলে।
https://youtu.be/tiKTHaurExQ