মার্কিন মধ্যবর্তী নির্বাচন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ নভেম্বর ২০২২, ৬:৫৬:০৮ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে যখন সোমবার ৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬-৪৮, বাংলাদেশে তখন ৮ নভেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৬-৪৮। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে মঙ্গলবার আসতে এক রাত বাকি। ৮ নভেম্বর মঙ্গলবার মার্কিন সংসদীয় নির্বাচনটি হোয়াইট হাউসে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এবং তার দলের ভাগ্য নির্ধারণের পাশাপাশি গোটা জাতির দিকনির্দেশনার ওপর এক বিরাট প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে।
এই নির্বাচনে জো বাইডেনের ওপর কোন ব্যালট হচ্ছে না। তবে প্রেসিডেন্টের মেয়াদের মাঝামাঝি (যে জন্য এর নাম মিড টার্ম ইলেকশন) এই নির্বাচনে সিদ্ধান্ত হবে কংগ্রেসের পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আইনসভা এবং গভর্নরের অফিসগুলোকে কে নিয়ন্ত্রণ করবে।
তবে এই নির্বাচন প্রেসিডেন্টের কর্মকাণ্ড এবং দেশের বর্তমান হালচাল সম্পর্কে পরোক্ষভাবে ভোটারদের মতামত প্রকাশের সুযোগ এনে দেয়।
মার্কিন অর্থনীতির বর্তমান সমস্যা এবং অপরাধ ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে ভোটাররা যখন উদ্বিগ্ন, তার মধ্যে নির্বাচনের এই রায় বর্তমান প্রেসিডেন্টের জন্য বেশ কঠোর হতে পারে।
এছাড়াও, এই ফলাফল ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ভোটের প্রচারণার ক্ষেত্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করবে, বিশেষভাবে সেখানে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কোন সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এবারের এই নির্বাচনগুলি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তার পেছনে রয়েছে পাঁচটি কারণ:
১. গর্ভপাতের অধিকার বা বিধিনিষেধ
মার্কিন কংগ্রেসের আকারে পরিবর্তন ঘটলে তা সারা দেশে আমেরিকানদের দৈনন্দিন জীবনকে সরাসরিভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এর একটি ভাল উদাহরণ হলো নারীদের গর্ভপাতের অধিকার।
গত জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত নারীদের গর্ভপাতের অধিকার সংক্রান্ত আইনটিকে বাতিল ঘোষণা করে। মধ্যবর্তী মেয়াদের এই নির্বাচনে কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে পারলে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাট এবং বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি – দুটি দলই এনিয়ে দেশব্যাপী নতুন আইন তৈরি করবে বলে প্রস্তাব করেছে।
ডেমোক্র্যাটরা নারীদের গর্ভপাতের অধিকার বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যদিকে, রিপাবলিকানরা নারীর ১৫ সপ্তাহের গর্ভাবস্থার পর গর্ভপাতের বিরুদ্ধে জাতীয় নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব দিয়েছে।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, পেনসিলভেনিয়া, উইসকনসিন এবং মিশিগানের মতো ভোটের চিরাচরিত রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দা গুরুত্বপূর্ণ গভর্নর এবং স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যে ফলাফল উঠে আসতে পারে তার ফলে সেখানে গর্ভপাতের আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে।
কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ কোন দলের হাতে যাবে এবং অঙ্গরাজ্যগুলিতে কোন দল ক্ষমতা লাভ করবে তা গর্ভপাতের ইস্যুটি ছাড়াও অন্যান্য নীতিগুলিকে প্রভাবিত করবে। া যদি রিপাবলিকানরা বিজয়ী হয়, তাহলে অভিবাসন, ধর্মীয় অধিকার এবং সহিংস অপরাধ মোকাবেলাকে অগ্রাধিকার দেয়ার প্রত্যাশা করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, ডেমোক্র্যাটরা বিজয়ী হলে, পরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা, ভোটের অধিকার এবং আগ্নেয়াস্ত্রের নিয়ন্ত্রণের মতো ইস্যুগুলো তাদের এজেন্ডায় ওপরের দিকে থাকবে।
২. রিপাবলিকানদের হাতে ডেমোক্র্যাটদের তদন্ত করার পালা
তবে এবারের সংসদীয় নির্বাচন বিভিন্ন নীতির বাইরের কিছু বিষয়ের ওপরও প্রভাব ফেলবে। কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে সফল হলে বিভিন্ন বিষয়ে সংসদীয় তদন্ত কমিটি তৈরির ক্ষমতা হাতে চলে আসবে।
গত দু’বছর ধরে, হোয়াইট হাউস যে পরিমাণ যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন ছিল ডেমোক্র্যাটরা তা সীমিত করে রেখেছে এবং তারা ২০২১ সালে মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটলের ওপর ৬ই জানুয়ারির হামলাকে তাদের প্রাথমিক ফোকাসে পরিণত করেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতাসীন থাকার সময় ঐ আক্রমণ সম্পর্কে হোয়াইট হাউস আগে থেকে কী জানত এবং কীভাবে তারা ঐ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল তা খুঁজে বের করতে ডেমোক্র্যাটরা শত শত লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে এবং ঐ দিন ঠিক কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে তাদের শুনানি প্রাইম টাইম টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করেছে। চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই তারা এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কিন্তু এই সবকিছু বদলে যেতে পারে। রিপাবলিকানরা – যারা ইতোমধ্যে কংগ্রেসের নিম্ন-কক্ষ হাউস অফ রেপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণের প্রত্যাশা করছে – তারা বলছে, ৬ই জানুয়ারির তদন্ত কমিটি তারা বন্ধ করে দেবে এবং, এর পরিবর্তে, জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনের সাথে চীনের কী ধরনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে তা নিয়ে তদন্ত শুরু করবে।
তারা একই সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের অভিবাসন নীতি, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহার এবং চীনে করোনভাইরাস মহামারির উৎসের দিকেও নজর দেবে।
আর যদি রিপাবলিকানরা মার্কিন সংসদের উচ্চ কক্ষ সেনেটের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে, তবে আশা করতে পারেন যে ফেডারেল আদালতে কাজ করার জন্য বাছাই করা লোকদের নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সংস্থাগুলিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়বে।
৩. জো বাইডেনের ভবিষ্যৎ
মধ্য মেয়াদী এই নির্বাচনকে সাধারণত প্রেসিডেন্টের মেয়াদের প্রথম দু’বছরের ওপর গণভোট হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যাতে ক্ষমতাসীন দলটি প্রায়শই মার খায়।
গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে জনমত জরিপে মি. বাইডেনের রেটিং বেশ খারাপ ছিল। যদিও গ্রীষ্মকালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সৌভাগ্য কিছুটা ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু এই নির্বাচনের প্রচারের চূড়ান্ত পর্বে মুদ্রাস্ফীতির উঁচু হার এবং অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা আবার ফিরে এসেছে। এর ফলে কংগ্রেসের উভয় কক্ষতে ক্ষমতা ধরে রাখা ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটি কঠিন লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম দু’বছরে, কংগ্রেসে তার সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরও মি. বাইডেন জলবায়ু পরিবর্তন, আগ্নেয়াস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ এবং দরিদ্র শিশুদের জন্য নতুন আইন চালু করতে পেরেছেন।
যদি মার্কিন সংসদের দুটি কক্ষের মধ্যে কোন একটি রিপাবলিকানদের হাতে চলে যায়, তাহলে ডেমোক্র্যাটদের আনার বিলগুলি কংগ্রেসে পাস হওয়া তারা ঠেকিয়ে দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করবে। এবং এর ফলে জটিলতা তৈরি হবে।
ডেমোক্র্যাটদের জন্য এই নির্বাচনের একটি খারাপ রাতকে মি. বাইডেনের রাজনৈতিক দুর্বলতার লক্ষণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হবে, এবং ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারের মৌসুম শুরু হলে অন্য ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর স্বার্থে মি. বাইডেনকে সরে দাঁড়ানোর ডাক নতুন করে উঠতে পারে।
প্রেসিডেন্ট এবং তার উপদেষ্টারা জোর দিয়ে বলছেন যে তিনি পুনঃ নির্বাচনে লড়বেন। তবে কোন কোন প্রাইমারি নির্বাচন – যেখানে একই দলের প্রার্থীরা মনোনয়নের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন – তার মাধ্যমে একজন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধুমাত্র একবারই ঘটেছে।
৪. ট্রাম্প যদি আবার দৌড়ে যোগদান করেন
সাম্প্রতিক কালে অন্যসব পরাজিত প্রেসিডেন্ট রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু মি. ট্রাম্প তেমনটা করেননি। তিনি এখনও ২০২৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার ব্যাপারে আগ্রহী বলে দৃশ্যত মনে হচ্ছে। ফলে সংসদের এই মধ্যমেয়াদী নির্বাচন তার হাতকে হয় শক্তিশালী করবে বা তার সব আশা গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
যদিও এই নির্বাচনে তার ওপর কোন ভোট হচ্ছে না, কিন্তু তার নির্বাচিত কয়েক ডজন প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
প্রবীণ রিপাবলিকান নেতাদের আপত্তি সত্ত্বেও প্রথাগত রিপাবলিকান রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জিয়ার প্রাক্তন রাগবি খেলোয়াড় হার্শেল ওয়াকার, পেনসিলভেনিয়ায় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ডা. মেহমেত ওজ এবং ওহাইও’র জনপ্রিয় লেখক জেডি ভ্যান্সের মতো কিছু সিনেট পদপ্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
নির্বাচনে এরা জয়লাভ করলে এটা প্রমাণিত হবে যে তার রাজনৈতিক সহজাত প্রবৃত্তি বেশ সুতীক্ষ্ণ এবং জাতীয় পর্যায়ে তার তৈরি রক্ষণশীল রাজনীতির ব্র্যান্ডের একটা আবেদন রয়েছে। কিন্তু যদি কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সংখ্যা কমে যায় – এবং যদি এটি ঘটে মি. ট্রাম্পের হাতে গড়া প্রার্থীদের ব্যর্থতার কারণে – তাহলে সব দোষ গিয়ে পড়বে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘাড়ে।
এই ধরনের ফলাফল দলের মধ্যে মি. ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মনে আশা বাড়িয়ে তুলবে। ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডিস্যান্টিস এবং টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট – দু’জনেই নভেম্বরে পুন:নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, এবং ২০২৪ সালে রিপাবলিকান মনোনয়ন জয়ের জন্য তাদের নিজস্ব প্রচারণায় তারা এই ফলাফলকে একটা স্প্রিংবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন।
৫. নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকারকারীরা কি ভোটে অংশ নেবে?
মার্কিন ক্যাপিটলে ৬ই জানুয়ারির হামলা – যেটিতে ট্রাম্প সমর্থকরা জো বাইডেনের নির্বাচনী বিজয়কে কংগ্রেসের অনুমোদন আটকে দেয়ার চেষ্টা করেছিল – তার পর এবারের সংসদীয় নির্বাচন হবে প্রথম কোন ফেডারেল নির্বাচন।
ঐ দাঙ্গার পর চুপ থাকা তো দূরের কথা, মি. ট্রাম্প অনবরত ঐ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং সক্রিয়ভাবে সেই সব রিপাবলিকান প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন যারা বলেছেন যে চুরি করে মি. ট্রাম্পের বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
এই প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই – যেমন, অ্যারিজোনায় রাজ্য মনোনীত সেক্রেটারি মার্ক ফিনচেম এবং নেভাডায় জিম মার্চেন্ট এবং পেনসিলভেনিয়ার গভর্নর পদপ্রার্থী ডগ মাস্ট্রিয়ানো, এমন সব পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন যেখানে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় তাদের রাজ্যের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর তাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
নির্বাচিত হলে এই রাজনীতিবিদরা একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে তাদের রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যয়িত করতে অস্বীকার করতে পারেন।
নির্বাচনে দুর্নীতির অভিযোগে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় এরা যোগ দিতে পারেন। ডাক কিংবা ব্যালট ড্রপ বাক্স পদ্ধতির মতো ভোটের কিছু সুনির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতি বদলে দিয়ে এরা নতুন নিয়ম ও আইন তৈরি করতে পারেন।
দু’হাজার বিশ সালের নির্বাচনে কিছু ফলাফল উল্টে দেয়ার জন্য মি. ট্রাম্পের চাপ থাকা সত্ত্বেও একাধিক রাজ্যের রিপাবলিকান নির্বাচনী কর্মকর্তারা তার দাবির কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এখন থেকে দু’বছর পর একইভাবে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা-পূর্ণ নির্বাচন হলে, এধরনের চ্যালেঞ্জের ফলাফল সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। সূত্র: বিবিসি