আপোষহীন ইমরান খানকে সেনাবাহিনী ও প্রতিদ্বন্দীরা ভয় পায়
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ নভেম্বর ২০২২, ২:২৬:১০ অপরাহ্ন
অনুপম আন্তর্জাতিক ডেস্ক: লংমার্চে বক্তব্য দেওয়ার সময় পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পায়ে গুলি চালায় অজ্ঞাত আততায়ী। গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনাকে তাঁর সমর্থকরা বলছেন, ‘হত্যাচেষ্টা’। এটি মূলত ছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরও একটি কালো দিন।
গত এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান। এ প্রক্রিয়াকে ‘বেআইনি’ বলছেন তাঁর সমর্থকরা। ঘড়িসহ দামি রাষ্ট্রীয় সম্পদ তোশাখানায় জমা না দিয়ে বিক্রির অভিযোগে গত মাসে পাঁচ বছরের জন্য ইমরানের নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নির্বাচন কমিশন। এ সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক প্রভাবিত’ সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন তাঁর আইনজীবীরা। এসব কথা বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফরেন পলিসি-র প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়, ইমরান একসময় পাকিস্তানের প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর প্রিয়ভাজন ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গত কয়েক মাসে তিনি বাহিনীর সবচেয়ে বড় সমালোচকে পরিণত হন। বহুবার এ সামরিক বাহিনী সরাসরি পাকিস্তান শাসন করেছে। মনে করা হয়, বেসামরিক সরকারের ওপর তাদের শক্তিশালী প্রভাব এখনও অব্যাহত আছে। যে জটিল সামরিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানের শাসনকাজ চলে, একসময় তার ভেতরের মানুষ ছিলেন ইমরান। কিন্তু সম্প্রতি তিনি এক ভিন্ন রূপে আবির্ভূত। এটা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ইমরান গণসমাবেশ ও বিক্ষোভ করে যাচ্ছেন। এসব সমাবেশের সরাসরি সম্প্রচার পাকিস্তানে এতটাই জনপ্রিয়, সরকার এগুলোকে বন্ধের চেষ্টাও করেছে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফুয়াদ চৌধুরি বলেছেন, তেহরিক-ই ইনসাফ পার্টি আগাম নির্বাচনের দাবি তোলায় ইমরান খান আবারো ক্ষমতায় আসতে পারেন বলে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এ কারণে ইমরানের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে এবং তিনি যাতে আর কখনোই ক্ষমতায় আসতে না পারেন সেজন্য তাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে।
ইরানের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক সুরুশ আমিরি এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও সামরিক কর্মকর্তারা এজন্য চিন্তিত যে ইমরান খান কোনো আপোষ করেন না। তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখনই এটা প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তাব্যক্তিদের কোনো কথা না শুনে বরং সেদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে স্বাধীন নীতি গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী।’
এদিকে বন্দুক হামলার জন্য তিন ব্যক্তিকে দায়ী করেছেন ইমরান খান। ওই তিন ব্যক্তি হলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ এবং সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ফয়সাল। লংমার্চে চালানো সশস্ত্র ব্যক্তির গুলিবর্ষণে ইমরান খানের একটি পা গুলিবিদ্ধ হয় এবং পায়ের হাড় ভেঙে যায়।
এটা পরিস্কার নয়, ইমরান খানকে গুলি চালানোর হোতা কারা। তবে সমর্থকরা মনে করেন, এ হামলা তাঁকে অপদস্ত করার আরও একটি পদক্ষেপ। ইমরানের অভিযোগ, হামলার পেছনে সরকার জড়িত।
পাকিস্তানে ক্ষমতার খেলার বিষয়টি নিয়ে সবারই ধারণা আছে। কিন্তু রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সচরাচর কেউকে মুখ খুলতে দেখা যায় না। এ নিয়ম ইমরানও অনুসরণ করেন। তাঁকে বলা হতো, ‘সামরিক বাহিনীর লোক।’
রাজনীতিতে ইমরান খান এসেছিলেন সংস্কারক রূপে। তবে তিনিও প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে আপসে বাধ্য হন। ক্ষমতায় গিয়ে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একমত হয়ে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ইনভেস্টমেন্টের সমর্থন করেন। সেই সঙ্গে পশ্চিমাদের নানা সমালোচনাও করেন। সামরিক বাহিনী চীনের প্রতি অনুরক্ত; ইমরানও তা-ই ছিলেন। তবে, দেরিতে হলেও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আপসের রাজনীতিতে মাথা ঢুকানোর তিক্ত অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন ইমরান।
তিনি একটি মৌলিক সত্য উন্মোচন করেছেন: পাকিস্তানে সেনাবাহিনী নির্বাচক হিসেবে রাজনীতিতে ভূমিকা রাখে; তারা অর্থনৈতিক শক্তিও। সামরিক বাহিনী সিমেন্ট কারখানার মালিক। তাদের আছে খাদ্যপণ্য উৎপাদনের কারখানাও। দেশের প্রায় প্রতিটি অবকাঠামো প্রকল্পে তারা জড়িত। কেবল ইমরান খানই নন, সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া কেউই দেশের শীর্ষ পদে পৌঁছাতে পারেন না বা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন না। পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের ৭৫ বছরে এ চিত্রই দেখা গেছে।
কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। ইমরানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) কোনো আঞ্চলিক দল নয়, এটি জাতীয়। এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বর্তমানে পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখোয়া ও গিলজিট-বাল্টিস্তানের প্রদেশিক ক্ষমতায় আছে দলটি। এটা তাঁর কর্মসূচিতে জনসমাগম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমাবেশের সরাসরি প্রচারের প্রতি জনগণের আগ্রহ দেখেই বোঝা যায়।
ইমরানের জনপ্রিয়তাই সামরিক বাহিনীকে হুমকি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, যদিও তারা তাদের লোককে (শাহবাজ শরিফ) ক্ষমতায় বসিয়েছে। সামরিক বাহিনীর ধারণা ছিল, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইমরান প্রচলিত নিয়ম মানবেন। সেনাবাহিনীতে হয়তো কেউ কেউ ভেবেছিলেন, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি দেশ ছাড়বেন; হারিয়ে যাবেন বিশ্বের ধনাঢ্যদের কাতারে। কিন্তু ইমরান তাঁর তারকাখ্যাতি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতার বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন।
বেশ কয়েকটি জনসমাবেশে ইমরান দেশজুড়ে নতুন নির্বাচনের দাবি জানান। এতে ভয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। গত ২১ আগস্ট পাকিস্তান সরকার তাঁর বক্তব্য সম্প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অবশ্য পরের সপ্তাহে আদালত এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছিলেন। ইমরানের বিরুদ্ধে পুলিশ ও বিচারককে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়। ঘনিষ্ঠ শাহবাজ গিলসহ তাঁর অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।