হজ: মরার আগে মরার শিক্ষা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জুলাই ২০২২, ১:৩৮:০৮ অপরাহ্ন
আপনাদের সবার কাছে একটি কথাই জিজ্ঞেস করতে চাই, হজের আগের জীবন আর হজের পরের জীবনের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য না থাকে, তবে হজের বিশেষত্ব কী রইল? হজ মানে কী বছর বছর দুর্নীতি আর অন্যায়ের সমুদ্রে ডুবে থেকে মক্কা ঘুরে এলাম আর সব গোনাহ মাফ হয়ে গেল? – মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: নূর আহমাদ
প্রতি বছর লাখো মানুষ সাদা কাফন গায়ে জড়িয়ে হজের বিমানে পা রাখেন। কিন্তু হজের শুভ্র রং জীবনে ধারণ করতে পারেন না অধিকাংশ হাজিই। হজের মর্মকথা না জানার কারণেই জীবনে হজের প্রভাব দেখা যায় না।
কাবার মেহমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নসিহত করছেন বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটির চেয়ারম্যান এবং আউলিয়ানগরের পির সাহেব মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নূর আহমাদ
হজের ইতিহাস সম্পর্কে বলুন?
হাজার হাজার বছর আগে আল্লাহতায়ালা ইবরাহিম (আ.)কে ডেকে বলেন, ‘হে আমার প্রিয় বন্ধু ইবরাহিম! তুমি মানুষের মাঝে হজের আজান দিয়ে দাও। এ ঘোষণা শুনে তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে, জীর্ণ উটে চড়ে, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে।’ (সূরা হজ : ২৮)।
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যখন আল্লাহ ইবরাহিম নবিকে বললেন, তুমি হজের ঘোষণা দাও। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এই নির্জন এলাকায় আমি কার জন্য ঘোষণা দেব? এখানে তো আমরা ছাড়া আর কাউকে দেখছি না? তখন আল্লাহ বললেন, ‘তোমার দায়িত্ব ঘোষণা দেওয়া। আর আমার দায়িত্ব মানুষের কানে পৌঁছে দেয়। তখন ইবরাহিম (আ.) আবু কুবাইস পাহাড়ে ওঠে দুই কানে আঙুল চেপে চিৎকার করে হজের আজান দিলেন।
ডানে-বামে, উপরে-নিচে মুখ ঘুরিয়ে তিনি হজের ঘোষণা দিলেন। আল্লাহতায়ালা এ ঘোষণাকে পৃথিবীর মানুষের কানে কানে পৌঁছে দিলেন। এমনকি রুহের জগতে যারা ছিল তাদের কানেও। যারা ইবরাহিম নবির এ ঘোষণা শুনেছে, তারা সঙ্গে সঙ্গে লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছে। যারা ইবরাহিম নবির মুখে হজের আজান শুনে লাব্বাইক বলেছে, শুধু তারাই পৃথিবীতে আরাফার ময়দানে গিয়ে লাব্বাইকের কোকিল হয়ে প্রেমের গান গাওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছে।’ (তাফসিরে ইবনে আব্বাস।)
হজ সফরের প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত?
হজ সফরের প্রস্তুতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হজের মাসগুলো সবারই জানা। যারাই এ মাসে হজের নিয়ত করবে, তারা হজের সময় যৌনাচার, অন্যায়, দুর্ব্যবহার এবং ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকবে। আর যাত্রাকালে সঙ্গে পাথেয় নিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই তাকওয়াই উত্তম পাথেয়।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৯৭।)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মানুষ হজের উদ্দেশ্যে বের হলে কোনো পাথেয় নিত না। পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া কিছুই সঙ্গে নিত না। তারা বলত, আমরা আল্লাহতায়ালার উদ্দেশে হজ করছি। আল্লাহই আমাদের খাওয়াবেন। আমাদের কোনো পাথেয়র প্রয়োজনও নেই।
এ ধরনের ভুল চিন্তা ভেঙে দিয়ে আল্লাহতায়ালা নাজিল করলেন, আর যাত্রাকালে সঙ্গে পাথেয় নিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সচেতনতাই উত্তম পাথেয়।’ দুনিয়ার পাথেয় উল্লেখের পর আল্লাহতায়ালা দ্বীনি পাথেয় সম্পর্কেও বান্দাকে জোর দিয়ে বলেছেন।
আল্লাহ বলেন, ‘দুনিয়ার চেয়ে দিনি পাথেয়ই শ্রেষ্ঠ। আর সেটা হলো তাকওয়া। তাকওয়ার ব্যাখ্যায় মুফাসসিররা বলেন, ‘ওয়া তাফসিরুহা আলআফাফু আম্মা হাররামাল্লাহ। অর্থাৎ তাকওয়ার পাথেয় মানে হলো, আল্লাহতায়ালা যা হারাম করেছেন সেসব বিষয় থেকে দূরে থাকা, সংযম অবলম্বন করা।’ তো এ সফরে আমরা যে পাথেয়ই নিই না কেন, তাকওয়া সঙ্গে নিতেই হবে।
কুরআনে হজকে ‘আল্লাহর অধিকার’ বলা হয়েছে কেন?
হজের মাধ্যমে বান্দার জীবনের সব গোনাহ সাফ করে আল্লাহতায়ালা আবার তাকে স্বচ্ছ-সুন্দর অন্তরওয়া মানুষ বানিয়ে দেন। আল্লাহতায়ালা অধিকার খাটিয়ে বলছেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা আমার ঘরে আসার সামর্থ্য রাখে, তাদের অবশ্যই কর্তব্য তারা যেন আমার ঘরে এসে লাব্বাইক বলে যায়। এটি তাদের প্রভুর অধিকার।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭।)
আল্লাহ বান্দাকে হজ করতে বলেছেন, আল্লাহর জন্য নয়। বান্দার জন্য। একই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলছেন, ‘জেনে রেখ বান্দা! তুমি যদি আমার ঘরে এসে লাব্বাইক না বলো, তাহলে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আমি জগতের কারও মুখাপেক্ষী নই।’
হজের শিক্ষা সম্পর্কে বলুন?
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা মরার আগেই মর’ অর্থাৎ মৃত্যু পরবর্তী প্রস্তুতি গ্রহণ কর। হজের পুরো আনুষ্ঠানিকতাই মানুষকে শুদ্ধ, পবিত্র ও পরকালমুখী করে।
একজন হাজি প্রথমেই সেলাইবিহীন দুটি কাপড়ে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। অর্থাৎ সে দুনিয়াবাসীকে নীরবে জানিয়ে দেয়, দুনিয়ার ভালো-মন্দ, লাভ-লোকসান, মজা-আহ্লাদের সঙ্গে একজন মৃত মানুষের যেমন কোনো সম্পর্ক নেই, আমিও তেমনি একজন মৃত মানুষ হয়ে পড়েছি। এ কথার মানে হলো, তোমাদের অস্থায়ী দুনিয়া থেকে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি।
এরপর সে যখন শয়তানকে পাথর মারতে যায়, তখন সে এটাই বোঝাতে চায়, হে শয়তান! বহু বছর আগে আল্লাহপ্রেমে পাগল ইবরাহিম খলিলুল্লাহকে এ পথে বাধা দিয়েছিলে। ইবরাহিম তোমাকে পাথর মেরে বিদায় করেছিল। আমিও এখন খলিলুল্লাহর পথ ধরেছি। আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য আল্লাহর রঙে রঙিন হওয়ার হজ করছি। এখন থেকে তুমি আমাকে ওয়াসওয়াসা দিতে এলেই পাথর মেরে তোমাকে তাড়িয়ে দেব। তারপর যখন সে মিনায় গিয়ে পশুর গলায় ছুরি চলায়, তখন সে এই ব্রত করে যে, প্রভুর যে কোনো নির্দেশের সামনে এভাবেই আমি মাথা নিচু করে দেব। প্রভুর নির্দেশ মানতে গিয়ে যদি আমার জীবনও কুরবান করতে হয়, তাতেও আমি রাজি আছি।
বাইতুল্লাহর মেহমানদের উদ্দেশে আপনার নসিহত কী?
আপনাদের সবার কাছে একটি কথাই জিজ্ঞেস করতে চাই, হজের আগের জীবন আর হজের পরের জীবনের মধ্যে যদি কোনো পার্থক্য না থাকে, তবে হজের বিশেষত্ব কী রইল? হজ মানে কী বছর বছর দুর্নীতি আর অন্যায়ের সমুদ্রে ডুবে থেকে মক্কা ঘুরে এলাম আর সব গোনাহ মাফ হয়ে গেল?
যদি তাই হতো তাহলে নবিজি (সা.) কেন আরাফার ময়দানে লাখো উম্মত থেকে পাপ না করার ওয়াদা নিয়েছিলেন? কেন তিনি সুদ, দুর্নীতি, মানবতার অপমানের মতো অন্যায়ের ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন? তিনি তো বলতে পারতেন, তোমরা হজ করে ফেলছ, এখন আর তোমাদের কোনো গোনাহ নেই, যেমন খুশি পাপের জীবনযাপন কর। কিন্তু নবিজি (সা.) বলেছেন, এতদিন পর্যন্ত যা অন্যায় করেছ সব মাফ। (যুগান্তরের সৌজন্যে)