জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আজ ১২৩তম জন্মবার্ষিকী
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০২২, ৬:১১:৫৯ অপরাহ্ন
অনুপম প্রতিবেদক : তিনি প্রেম, দ্রোহ, মানবতা আর সাম্যের কথা বলতেন কবিতায় গানে গল্পে প্রবন্ধে। তাঁর এক হাতে রণতূর্য, আরেক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী ছিল। সেই মহান পুরুষ কাজী নজরুল ইসলাম, আমাদের জাতীয় কবি। আজ তাঁর ১২৩তম জন্মবার্ষিকী।
কাজী নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে ২৫ মে, বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। দারিদ্র্যপীড়িত শৈশব-কৈশোর কাটানো এই কবির পরিচিতি ছিল দুখু মিয়া নামেই। কৈশোরেই জীবনযুদ্ধে নামতে হয়েছিল। মসজিদের মুয়াজ্জিন, রুটির দোকানের কর্মী— কী পেশা নিতে হয়নি! সব সংগ্রামকে ছাপিয়ে, বাউন্ডুলে-ছন্নছাড়া এক জীবন নিয়েও বাংলা সাহিত্যের আকাশে তার আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো, তারুণ্যের তেজদীপ্ততায় সবাইকে চমকে দিয়ে। তবে ধূমকেতুর মতো ক্ষণস্থায়ী নয়, ধ্রুবতারার মতো এক স্থায়ী আসন তিনি গড়ে নিয়েছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে, বাংলার মানুষের মন ও মননে।
তিনি ছিলেন শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক দৃপ্ত কণ্ঠস্বর। মানুষের প্রতি, মানবতার প্রতি অন্যায়-অনিয়ম আর বঞ্চনায় যে রক্তক্ষরণ, সেগুলোই একে একে তীব্র প্রতিবাদ হয়ে ঝরেছে তার লেখনিতে। ব্রিটিশরাজ তখন ক্ষমতায়, তার বিরুদ্ধেও সমান সোচ্চার নজরুলের কলম। তাই বারবার শোষকের কোপানলে পড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন কারাগারে। কিন্তু আপসহীনতার আদর্শে অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি, প্রতিবারই ফিরে এসেছেন আপন মহিমায়।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন।রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহ-সৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে থাকাকালীন নজরুল রচনা করেন, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা। গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
দ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের সাহিত্যে সমানভাবে মিশে আছে সাম্য ও মানবতাবাদ। মানুষে মানুষে সাম্যের বাণী এমন করে আর কেউ বলেনি তার আগে। তবে ছন্নছাড়া এই চিরতরুণের বুকের ভেতরে এক কোমল হৃদয়ের বসবাসও ছিল, অভিমান আর আবেগ তাতে জলসিঞ্চন করত। প্রেমের অপরূপ বাণী তাই নিঃসৃত হয়েছে তার কলম থেকেই।
বিদ্রোহী কবি হিসেবেই কাজী নজরুলের পরিচিতি তার অন্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গিয়েছে। তারপরও সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা— এমন অসংখ্য পরিচয়ের প্রতিটিতেই স্বমহিমায় ভাস্বর নজরুল। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, দোলন চাঁপা, ছায়ানট, ইত্যাদি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা তার উপন্যাস। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা ইত্যাদি তার বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ।
এর বাইরে বিশেষ করে বাংলা গানে কাজী নজরুলের অবদান অনন্য। তার হাত ধরে অসংখ্য রাগ-রাগিনীর সৃজন বাংলা গানের ভাণ্ডারকে করে সমৃদ্ধ। লোকজ বিভিন্ন ধাঁচে করা তার গানগুলোও আবহমান বাংলা ও বাংলার মানুষের রঙ-রূপ-আবেগ-অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলেছে অপরূপ রূপে। লিখেছেন শ্যামা ও কীর্তনাঙ্গের গান, বাংলায় গজল ও ইসলামি গানের ধারার সূচনাও তার হাতেই। তিন হাজারেরও বেশি গানের রচয়িতা নজরুলের কাছে বাংলা গান অনেকখানি ঋণী।
শৈশব থেকেই এক সংগ্রামী জীবন কেটেছে কাজী নজরুল ইসলামের। ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১০ বছর বয়সেই উপার্জনে নামতে হয় তাকে। মক্তবের শিক্ষক, মুয়াজ্জিন ও মাজারের খাদেম, লেটোর দলের হয়ে গান বাধা, নাটকে অভিনয় করা— জীবন ও জীবিকার জন্য কী করেননি তিনি! রেলের ইংরেজ গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে। আর জীবন সংগ্রামের এই যুদ্ধে কোথাও থিতু হয়েও বসতে পারেননি।
এর মধ্যেই কাজী নজরুলের শিক্ষা জীবন কেটেছে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরাম স্কুলে। দারিদ্র্যের কষাঘাত কবিবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে দেয়নি। সিয়ারসোল রাজ স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে নিয়ে আসেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয়। তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মান দেন। দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মাত্র চল্লিশেই সাহিত্য সাধনা স্তব্ধ হয়ে যায় কাজী নজরুল ইসলামের। স্মৃতিবিভ্রাটের শিকার হন, শয্যাগত হয়ে পড়েন। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট সব জাগতিক বাঁধন ছিন্ন করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নজরুল। নজরুল লিখেছিলেন— মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই। তার সেই ইচ্ছা পূরণ করতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
জাতীয় কবির ১২৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, সাম্য, মানবতা, প্রেম ও প্রকৃতির কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক অন্যতম পুরোধা। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও সৃজনশীল কর্ম জাতির অন্তহীন অনুপ্রেরণার উৎস। কবির ক্ষুরধার অগ্নিঝরা লেখনি শোষিত-নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার করে, শিক্ষা দেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী কবি। তিনি শুধু নিজের ধর্ম, সমাজ-সম্প্রদায়, দেশ ও কালের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি, ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতার জয়গান গেয়েছেন, নারীর অধিকারকে করেছেন সমুন্নত। তার সৃষ্টি সর্বজনের, সর্বকালের।
জাতীয় কবির জন্মজয়ন্তীতে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কালজয়ী প্রতিভার অধিকারী কবি নজরুল তার লেখনির মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার সাহিত্যকর্মে উচ্চারিত হয়েছে পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের বাণী। অসামান্য ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কবি নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও জাতীয়তাবোধের মূর্ত প্রতীক।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে— ‘বিদ্রোহী’র শতবর্ষ। দিবসটি ঘিরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বুধবার (২৫ মে) সকাল সাড়ে ৬টায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের নেতৃত্বে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, কবি নজরুল ইনস্টিটিউটসহ মন্ত্রণালয়ের অধীন ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দফতর ও সংস্থা কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এ বছর জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে নজরুল স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লায়। সেখানে বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন প্রাঙ্গণে (টাউন হল) সকাল ১১টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। অন্যদিকে, ঢাকাসহ জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহের ত্রিশাল, কুমিল্লার দৌলতপুর, মানিকগঞ্জের তেওতা, চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গা এবং চট্টগ্রামে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নজরুলের জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে নজরুল মেলা, নজরুল বিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আয়োজন করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
এসব কর্মসূচির অংশ হিসেবে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার দরিরামপুরে জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার প্রথম দিনের আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আশরাফ আলী খান খসরু। দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। সমাপনী দিনে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। কুমিল্লায় দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার।
বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আয়োজন করেছে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ও উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকছেন কবি কামাল চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ জাকীর হোসেন। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট বাংলা একাডেমির সহযোগিতায় জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করেছে। নজরুল ইনস্টিটিউটসহ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন সব দফতর ও সংস্থা এ উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবে।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ঢাকাসহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, রচনা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করবে। নজরুল জন্মবার্ষিকীর জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারি বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করবে।