পৃথিবীর বিশাল ক্ষতি ঠেকাবে কে, আরেকজন চল্লিশ লক্ষ মানুষ হত্যাকারী?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০২২, ৬:১০:০৭ অপরাহ্ন
চেঙ্গিসের দ্বারা হত্যাকান্ডের ফলে ৭০০ মিলিয়ন কার্বন সরে গিয়েছিল দুনিয়া থেকে। ফলে গ্লোবাল কুলিং রেকর্ড হয়েছিল
সারওয়ার চৌধুরী
বড় ধরনের ক্ষতি হলো পৃথিবীর গত বছর। পৃথিবীর বনাঞ্চল উজাড় হয়েছে ব্যাপকভাবে। বনাঞ্চল শোষণ করে কার্বন ডাই অক্সাইড। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় বনাঞ্চল। বনাঞ্চল না থাকলে পৃথিবীতে মানুষ বসবাস অসম্ভব প্রায়। বনভূমি সেফগার্ড। যুক্তরাজ্য দেশটির সমান ভূখণ্ডের বন ধ্বংস হয়েছে গত বছর। বিশ্বের নেতাদের কথায় কাজে মিল নেই। বিশাল আয়োজনের জলবায়ু সম্মেলনে কেবল কথার ফুলঝুরি ছিল। বন উজার চলছে বেপরোয়া। প্রাকৃতিক কারণে বিপদ তো আছেই।
পুরো বিশ্বে গত বছর আড়াই লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি বন উজাড় হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে ধ্বংস হয়েছে এসব বনভূমি। বৈশ্বিক বনভূমি পর্যবেক্ষক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। খবর আল জাজিরা, রয়টার্স।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে ২ লাখ ৫৩ হাজার বর্গকিলোমিটার বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। রাশিয়ার দাবানল ও ব্রাজিলের আমাজন বনভূমি ধ্বংসের কারণে বিশ্বে বন উজাড়ের হার রেকর্ড পরিমাণ বাড়তে দেখা যায়। মানবসৃষ্ট কারণে বা বনভূমি উজাড় করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ব্রাজিল। দেশটিতে ৪০ শতাংশ বনভূমি ধ্বংস ইচ্ছাকৃত।
দুই.
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চীন, রাশিয়া, বর্তমান দুই কোরিয়া, পশ্চিম দিকে তুরস্কসহ পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, প্রায় চল্লিশ মিলিয়ন মানুষ হত্যাকারী ছিলেন চেঙ্গিস খান। তিনি গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের চেয়ে চারগুণ বেশি দুনিয়া দখল করেছিলেন।
চেঙ্গিসের দ্বারা হত্যাকান্ডের ফলে ৭০০ মিলিয়ন কার্বন সরে গিয়েছিল দুনিয়া থেকে। ফলে গ্লোবাল কুলিং রেকর্ড হয়েছিল। জেলার পর জেলা মানবশূন্য হওয়াতে গাছপালা বৃক্ষ লতাপাতায় ছেয়ে গিয়েছিল। তাই ডেস্ট্রয়ার হয়েও চেঙ্গিস হয়ে গেলেন ‘গ্রেট গ্রীন খান’।
১৯৯৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর আমেরিকার নেতৃস্হানীয় সংবাদপত্র ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ এবং টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল সিএনএন গত এক হাজার বছরের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে চেঙ্গিস খানকে “ম্যান অব দ্য মিলেনিয়াম” হিসাবে নির্বাচিত করে। আধুনিক ইতিহাসবিদরা মনে করেন তার দোষ ত্রুটির তুলনায় সাফল্যের পরিমাণ অনেক অনেক বেশী ছিল।
তিন.
বর্তমান পৃথিবীর মানুষ কি আরেকজন চেঙ্গিস খানের অপেক্ষায়? কথাটা শুনতে ভাল লাগে না। কেউ এসে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলুক সুস্থ সুন্দর চিন্তার কেউ কি তা চায়? কিন্তু বিশ্বনেতৃবৃন্দ কী করছেন? তাদের অহংবোধের প্রতিযোগিতা, যুদ্ধের প্রস্তুতি আত্মঘাতি নয় কি?
গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) ও যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড ইউনিভার্সিটি। ডব্লিউআরআইয়ের বিশ্লেষকেরা এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের কারণে বন জলবায়ু পরিবর্তনের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দ্রুত বনভূমি ধ্বংসের কারণে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। যেকারণে পৃথিবীর কোথাও মাত্রাতিরিক্ত ঠাণ্ডা, কোথাও মাত্রাতিরিক্ত গরমে মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
গত বছর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের ১০০ নেতা জলবায়ু সুরক্ষায় যে পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির কোনো মিল নেই।
পরিবেশ বিশ্লেষকেরা বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি উজাড় বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি পালন করা হচ্ছে না। রক্ষকের ভক্ষকের ভূমিকায়। মিলিয়নিয়াররা চায় যেকোনোভাবে বিলিয়নপতি হতে।
ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের বৈশ্বিক বনভূমি কর্মসূচির পরিচালক রড টেলর ২০৩০ সালে বনভূমি-সম্পর্কিত বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে বলেন, আমরা বনভূমি ধ্বংস কমতে দেখছি না। বস্তুত আমরা তেমনটাই দেখার প্রত্যাশী ছিলাম।
তিনি বলেন, এটা চরম দুশ্চিন্তার বিষয়। আমরা দেখছি- বারবার আগুন ধরছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যা হতো, তার চেয়েও আরও তীব্র ও বিস্তৃত দাবানল তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে।
ডব্লিউআরআইয়ের বিশ্লেষকেরা আরও বলেন, গ্রীষ্মাঞ্চলের ৩৭ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার পুরোনো চিরহরিৎ বনভূমি যে পরিমাণ কার্বন ধরে রাখে, তা উজাড় হওয়া নানা দিক থেকে উদ্বেগের বিষয়। তবে আগের বছরের চেয়ে বনভূমি ধ্বংসের হার এ বছর প্রায় সমান হলেও কার্বন নির্গমনের বিষয়টি উদ্বেগের। বন ধ্বংসের ফলে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হয়, তা ভারত এক বছরে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ালে সেই পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি করে।
এদিকে, কানাডা, রাশিয়া ও আলাস্কার মতো অঞ্চলেও গত বছর ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। এর কারণ, রাশিয়ায় সৃষ্ট দাবানল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট শুষ্ক ও গরম আবহাওয়া কারণে এ দাবানল সৃষ্টি হয়।
চার.
প্রাকৃতিক বিপদের নিয়ন্ত্রণ মানুষের হাতে নেই। কিন্তু মানুষের তথাকথিত বড়ত্বের বড়াইসুলভ আচরণ আর, তথাকথিত শিল্পের সাফল্যের লাগাম টানবে কে? আর কত শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য দিয়ে বনভূমি জ্বালিয়ে দেয়া? গ্রিন হাউস গ্যাস, ইগজোস্ট গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, আর্সেনিকযুক্ত বর্জ্য, পারদ, ক্যাডমিয়াম, সিসা, বালাইনাশক, আগাছানাশক, ধোঁয়া, ধোঁয়াশা, ধূলিকণা, ময়লা-আর্বজনা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে। গ্রিন হাউস ইফেক্টের কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্যাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড ৫০%, মিথেন ২০%, সিএফসি ১০%, নাইট্রাস অক্সাইড ১০% এবং অবশিষ্ট ১০% কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন পারঅক্সাইড ও কিছু অন্যান্য গ্যাস থাকে। এসব বিপদ তো মানুষের সৃষ্ট। মানুষের বড়ত্ব প্রদর্শনেচ্ছা থেকে এসব অনাচার। মানুষ মানুষ হোক, মানুষের শিল্পোন্নত হওয়ার নষ্ট চিন্তা দূর হোক। অবাক ব্যাপার, ষাট হাজার বছর আগের ‘অসভ্য’ মানুষেরা বর্তমান ‘সভ্য’ মানুষদের মতো এতো আতংকিত জীবন যাপন করেনি। আধুনিক মানুষ রাসায়নিক আর পারমাণবিক মারণাস্ত্রের আতংকে সন্ত্রস্ত ভীষণভাবে।