অচলাবস্থায় মেটে তাঁতশিল্পঃ মেটে তাঁত ও তাঁতিদের একাল-সেকাল
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১২:২০:২২ অপরাহ্ন
মো. মুরাদ হোসেন,পাবনা: দেশে কয়েকটি জেলায় এখনো ছড়িয়ে রয়েছেন তাঁতিসম্প্রদায়। নানান প্রতিকূলতায় অনেকে ছেড়েছেন আবার অনেকে এখনও আঁকড়ে ধরে আছেন পূর্বপুরুষের পেশা। তাদের কর্মক্ষেত্রও নিজ নিজ বসতভিটায়।
বিভিন্ন সময় প্রতিকূলতা ও বিভিন্ন সমস্যায় বিলীন হওয়ার পথে মেটে তাঁত শিল্প।কাঁচামালের সংকট, সুতার ঊর্ধ্বগতিতে মূল্য বৃদ্ধি, অতিরিক্ত খরচ বহন, শ্রমিক সংকট, ভারী কাজের মতো সমস্যার কারণে দিন দিন মেটে তাতেঁর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করেছ। করোনা অতিমারীর সময়ে লুঙ্গির সরবরাহ কমে যাওয়ায় মেটে তাতঁ প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের পক্ষ থেকে সরকারি ঋণ প্রদান করা হলেও প্রান্তিক তাঁতিরা তার কতটুকু পায়, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছ বারবার। যদিও তাদের(বাতাবো) দাবি তারা নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তা দিচ্ছেন তাঁতিদের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তাঁতশুমারি-২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ পর্যন্ত আগের ২৮ বছরে দেশে তাঁত ছেড়েছেন ৭ লাখের অধিক তাঁতি। তাঁতবোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯০ সালে তাঁতির সংখ্যা ছিল ১০.২৭ লাখ, ২০০৩ এ কমে তা ৮.৮ লাখে দাঁড়ায়। ২০১৮ তে তাঁতির সংখ্যা ছিল ৩.০১ লাখ। বর্তমানে ১ লাখের কাছাকাছি চলে এসেছে। ১৯৯০ সালে যেখানে তাঁতের সংখ্যা ছিল ১.৯২ লাখ ২০১৮ তে সে সংখ্যায় মেটে তাঁত কমলেও কলের তাঁত বেড়েছে কয়েকগুণ।
সহজ ও দ্রুততম সময়ে বেশি লুঙ্গি উৎপাদনে সক্ষম মেশিনের তাঁতের দিকে ঝুঁকেছেন মেটে তাঁতের প্রায় দুই-পঞ্চমাংশ শ্রমিক। ফলে দ্রুত তাঁত কমার বিপরীতে তাঁতিও কমতে শুরু করেছে।
শিক্ষিত বা দক্ষ তাঁতির নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের ৭ টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও দেখা মিলেনা কোনো প্রশিক্ষকের বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার। ব্যবস্থা থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই। ফলে যেকোন সমস্যায় পড়লে সেটা পাশ কাটিয়ে উঠতে খুবই বেগ পেতে হয় একজন প্রান্তিক তাঁতির।
অন্যদিকে, এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নিয়মিত সূক্ষ্ম সূতার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার ফলে ৩০-৩৫ বছর বয়স থেকেই দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। বর্তমানে এ সমস্যা প্রতিটি তাঁতির জন্য বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাঁতিদের শ্রম আর মহাজনদের মুনাফা সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি বা চলমান থাকলে তাঁতিদের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে চলেছে। যার প্রভাব তাঁতশিল্পেও পড়েছে। তাঁতিদের তাশুন-মাজন-মাড় দেওয়া, সুতা পেঁচানোর মতো কাজে যেখানে অনেক জায়গার প্রয়োজন হয়, সেখানে মানুষ জন বৃদ্ধির ফলে জায়গার সংকট হচ্ছে, তদুপরি কর্মক্ষেত্রের জায়গা কমে যাচ্ছে। এতেও অনেকে তাঁত-খুঁটি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁতিদের চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামালের যোগান এবং সেগুলোর মূল্য হ্রাস ও স্থিতিশীল করণ, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, লুঙ্গির মূল্য বৃদ্ধি, তৈরি কাপড়ের নিয়মিত সরবরাহ ব্যবস্থা, মহাজনদের বাড়তি মুনাফা না নেওয়া, তাঁতি সমিতির সদস্যদের সংগঠিত করা ও তাঁতিদের উদ্বুদ্ধকরণ সহ বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যার সমাধানে কাটতে পারে সংকট, রক্ষা পেতে পারে দেশের বিলুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্য।




