১০০ টাকা বেতন পেতেন, এখন ৮০০ কোটি ট্যাক্স দেন, সুফি শিল্পপতি তিনি
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২২, ৮:০৮:২৯ অপরাহ্ন

অনুপম প্রতিবেদক : সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়েছেন কাজ ভালোবেসে, মানুষকে ভালোবেসে, তিনি জানান। কর্মবীর একজন সুফি তিনি। ১০০ টাকা বেতনে জুট মিলে চাকরি করতেন। এখন দশ হাজারের বেশি লোকের চাকরিদাতা। সাত ছেলে তাঁর বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে এসে বাবার গড়া পিএইচপি গ্রুপের পরিচালক একেকজন।
প্রায় ৫০ বছর আগে তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাত্র ১ হাজার ৪৮৩ টাকায়। এখন ছয় হাজার কোটি টাকার শিল্প গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। সবাই তাকে সুফি মিজান বলেই চিনেন। পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যন। ইংরেজী পি মানে পিস, এইচ মানে হ্যাপিনেস, আর পি মানে প্রসপারিটি। যার বাংলা অর্থ শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধি। সত্যিই তার জীবনে এখন সুখ আর সুখ। কিন্তু একদিন এ সুখ ছিল না। ছিল অজানা অন্ধকার। এই অন্ধকার ঠেলেই তিনি আজ আলোর দিশারি।
তার ধ্যানে জ্ঞানে শুধু কাজ আর কাজ। আর তাই দেখা মাত্রই গড়গড়িয়ে বললেন, শুধু চাই কাজ করে যেতে। মানুষের উপকার করতে। দেশের জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগে। বহু লোক এখন আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। তাদের দেখে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে। একদিন আমিও তাদের কাতারে ছিলাম।
তিনি বলেন, ‘কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে যেকোন মানুষ একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। অন্তত আমি তাই মনে করি। পরিশ্রম করলে আজ না হোক, কাল ঠিকই সাফল্য ধরা দেবে। আমার সন্তানদেরও আমি এসব কথা বলি। হয়তো তারা সেই কারণে আমাকে অনুসরণ করছে। প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে নিরলসভাবে।’
২০২০ সালে একুশে পদক নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে
শূন্য থেকে অন্যতম সফল শিল্পপতি হওয়ার গল্প বলেছেন বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা ও আর মেধার সমন্বয় ঘটিয়ে কিভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় তার চমৎকার নজির এই ব্যক্তিটি সিনেমার কাহিনীর মতো।
গড়গড়িয়ে বললেন, শুধু চাই কাজ করে যেতে। মানুষের উপকার করতে। দেশের জন্য কিছু করতে পারলে ভাল লাগে। বহু লোক এখন আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। তাদের দেখে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে। একদিন আমিও তাদের কাতারে ছিলাম
আপনার বয়স এখন কত চলছে? প্রশ্নটির জবাবে বললেন, কেন বয়সের ভারে বেঁধে ফেলতে চাও নাকি আমাকে? ১৯৬৪ সালে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তাম। হিসেবে করে নাও। প্রতিষ্ঠানটি ছিল নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজ। ওই শহরের রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন গ্রামে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, শৈশব, কৈশোর।
তাঁর মতে ‘জীবনে উন্নতি করতে হলে অধ্যাবসায়ের বিকল্প নেই। কখনো হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না। ৩০-৪০ বছর আগে অনেক ছোট কাজও আমি করেছি। কোন কাজকেই অবহেলার চোখে দেখিনি। আজ আমার অনেক প্রতিষ্ঠান। সেখানে ১০,০০০ লোক কাজ করে। সবাইকে এক কথা বলি। কাজকে ছোট করে দেখো না।’
সাত পুত্র এক কন্যা ও স্ত্রীর সাথে সুফি মিজানুর রহমান
তিনি আরও বলেন, ‘কলেজে পড়া অবস্থায় কাজ নিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জের জালাল জুট ভ্যালি কোম্পানিতে। তখন মাইনে পেতাম মাত্র ১০০ টাকা। কলেজে পড়া অবস্থায় আমার মধ্যে একটা জেদ কাজ করতো। ভাবতাম আর কতদিন গেলে আমার একটা প্রতিষ্ঠান হবে। ছোট্ট একটা অফিস থাকবে। তবে দিন-রাত পরিশ্রম করেছি। মাঝেমধ্যে বউ, ছেলে-মেয়েদেরও সময় দিতে পারিনি।’
বহু জায়গায় কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে সুফি মিজানের। আসলে কাজের সন্ধানে তিনি ছুটে গেছেন অনেক প্রতিষ্ঠানে। সেই কারণেই হয়তো অভিজ্ঞতার মাঝে ডুবে আছেন সবসময়। জানালেন, বি কম পড়ার সময় কাজ পান ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (সোনালী ব্যাংক) চট্টগ্রামের লালদীঘি শাখায়। মাইনে ১৬৭ টাকা।
পদটি ছিল জুনিয়র ক্লার্কের। তবে সরকারি চাকরি। তার দুই বছর ১৯৬৭ সালে চলে তৎকালীন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে। বর্তমানে যেটি পূবালী ব্যাংক। তখনকার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় যোগ দেন জুনিয়র অফিসার হিসেবে। বেতন কিছু বেড়ে ৮০০ টাকা। মন্দ না! এরপর একসময় ভাবনা এলো এভাবে চাকরি-বাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যাবে না। ব্যবসায় জড়াতে হবে। হিসাব বুঝতে হবে। টুকটাক হিসাব করতে গিয়ে কখন যে এভাবে ব্যবসায়ী হয়ে যাবেন তা টেরই পেলেন না বর্ষীয়ান এই ব্যক্তি।
তিনি বলেছেন, ‘ব্যবসা করতে গেলে টাকা লাগে। কারণ টাকায় টাকা আনে। কিন্তু আমার তো হাত খালি। অতো টাকা পাবো কোথায়। ছোটখাটো একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতেও বহু অর্থের দরকার। আমাকে টাকা দেয়ার কোন মানুষ নেই। চাকরি করার সময় পরিচয় হয়েছিল বেশ কিছু বড় আমদানি-রপ্তানিকারকের সঙ্গে। একদিন তাদেরই কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হলো আবার। তারা আমাকে বাকিতে পণ্য দিতে রাজি হলেন। আমি পণ্য নিয়ে পরে সময়মতো টাকা শোধ করতাম। এতে ব্যাংকের সঙ্গেও আমার একটি ভাল সর্ম্পক তৈরি হয়ে যায়।’
বই পড়া তাঁর অন্যতম কাজ
সুফি মিজান এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামের অনেক পুরনো কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অবশ্য এখন রমরমা আগের মতো ব্যবসা নেই। দু-একটি কোম্পানির কথা না বললেই নয়। ইলিয়াছ ব্রাদার্স, জাকারিয়া ব্রাদার্স, মেসার্স ইমাম শরীফ, ডায়মন্ড করপোরেশন ছিল তার অন্যতম। তারা সহজ শর্তে চাল, ডাল, তেল, চিনি, লবণ, গম ট্রাকে করে বিক্রির সুযোগ দেয়। আমি সেইসব পণ্য ঢাকার পাইকারি বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতাম। বিক্রি শেষে নিজের লাভের টাকা রেখে দিতাম। বাকিটা দিয়ে পণ্যের দাম পরিশোধ করতাম।’
পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যবসা হচ্ছে এমন এক জিনিস যেখানে ধৈর্য্যের কোন বিকল্প নেই। এই ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করছি। তার কৃপা ছাড়া কিছুই করতে পারতাম না। জীবনে আমদানি করা প্রথম জিনিসটি ছিল ব্রিজস্টোন টায়ার। সালটা ছিলো ১৯৭২। বিনিয়োগ হয়েছিল চার হাজার ডলার। প্রতি ডলারের মান ছিল ১১ টাকা। বর্তমান বাজার দর অনুসারে যার দাম ৪৪ হাজার টাকা। লাভ করেছিলাম এক লাখ টাকা। ব্যস। শুরু হলো প্রতিযোগিতার বাজারে নাম লেখানো। সাহস করে এগিয়ে যেতে থাকলাম।’
তিনি বলেন, ‘দিন-রাত পরিশ্রম করার পর একসময় দেখলাম আমার হাতে কয়েক কোটি টাকা জমে গেছে। টাকাগুলো কাজে লাগানোর জন্য ভেতরে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কারণ, সবাই যেখানে টাকা জমায় সেখানে আমি তা ব্যয় করার চিন্তা-ভাবনা করছি। একসময় সীতাকুণ্ডের বঙ্গোপসাগর উপকূলে শিপইয়ার্ড দিলাম। সেখানে পুরনো জাহাজ কেটে আসবাবপত্র বিক্রি করতাম। বিক্রির টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করলাম রি-রোলিং মিল। তারপর আসলো ১৯৮৪ সাল। মংলা ইঞ্জিনিয়ার্স ওয়ার্কস নামে বিলেট তৈরির কারখানা দিয়ে লাভ পেতে শুরু করলাম। সম্ভবত ওটিই ছিল দেশের প্রথম বিলেট কারখানা। এভাবে লাভ পাওয়ায় আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘সারা দেশে পিএইচপির ২৫০ জন ডিলার আছেন। কেবল মাত্র আমাদের পণ্য বিক্রি করেই বলতে পারেন তাদের বেশির ভাগ এখন কোটিপতি। পিএইচপির সঙ্গে জড়ানোর আগে তাদের অনেকের পকেটে টাকা ছিল না। কাজ পাওয়ার পর পরিশ্রম করে তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন। এই বিষয়টিকে আমি খুব পছন্দ করি। কারণ মানুষই নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে।
সুফি মিজানকে নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে প্রচলিত একটি প্রবাদ এ রকম যে, তিনি যেখানে হাত দেন তা সোনা হয়ে যায়। তবে তিনি বলেন, ‘না না বিষয়টি আসলে তেমন কিছু নয়। যারা এমন বলেন হয়তো শ্রদ্ধা থেকেই বলেন। তবে এই কথা সত্যি ব্যবসার সবকটি শাখাতেই বিচরণ করার নেশা আমার। বলতে পারেন লাভ লোকসানের দিকে না তাকিয়ে ব্যবসার ভেতরটা আমার জানা চাই। একজীবনে বহু ব্যবসায় জড়িয়েছি। যেখানে গেছি সবখানেই সফল হওয়ার চেষ্টা করেছি। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় ঢেউটিনের কারখানা দিলাম। বলতে পারেন এখনও আমার প্রতিষ্ঠানের ঢেউটিন শীর্ষে। এরপর সীতাকুণ্ডের কুমিরায় দিলাম সিআর কয়েল কারখানা।
তারপর আরও নানা ব্যবসায় জড়িয়েছি। এসব ব্যবসা করতে গিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে অনেক ঝামেলা হজম করতে হয়েছে। কোথাও কোথাও সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে খাটো করে রাখা হয়েছে। সেইসব কথা অবশ্য বাড়ি ফেরার পথে ভুলে যেতাম। আজ কি হলো তা না ভেবে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীকালের জন্য চিন্তা করা উচিত।’
নিজের স্ত্রীকে ভীষণ ভালবাসেন সুফি মিজানুর রহমান। আর তাই স্ত্রী তাহমিনা রহমানের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে কখন যে পিএইচপি গ্রুপ প্রতিষ্ঠা পেলো তা টেরই পেলেন না তিনি। এই বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের কাছে পিএইচপি এখন একটি আস্থার নাম। ভাবতে ভাল লাগে। তবে একদিনে হয়নি এই গ্রুপ। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে এখান থেকে। বলতে পারেন ডালপালা বেড়েছে। অনেক মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর জীবন নির্বাহ করছেন।
১৯৯৭ সালে আমার স্ত্রী আমাকে চট্টগ্রামে কিছু করার জন্য উৎসাহ দিতে শুরু করলেন। সেই সময় কয়েল কারখানা তৈরি করতে গিয়ে একা হয়ে পড়লাম। ওই বছরের ২২ জুলাই জন্ম নিলো পিএইচপি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে পিএইচপির ২৫০ জন ডিলার আছেন। কেবল মাত্র আমাদের পণ্য বিক্রি করেই বলতে পারেন তাদের বেশির ভাগ এখন কোটিপতি। পিএইচপির সঙ্গে জড়ানোর আগে তাদের অনেকের পকেটে টাকা ছিল না। কাজ পাওয়ার পর পরিশ্রম করে তারা স্বাবলম্বী হয়েছেন। এই বিষয়টিকে আমি খুব পছন্দ করি। কারণ মানুষই নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে।’
ব্যবসায়ী হতে গিয়ে নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে আজকের সুফি মিজানকে। এসব পরিস্থিতি তিনি হজম করেছেন কাজের অংশ হিসেবে। যার কোনটি সুখকর। কোনটি আবার আফসোসের। তবে একটি ঘটনা তিনি কখনও ভুলেন না। কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘চট্টগ্রামে আরএম গ্রুপ নামে আমার অংশীদারিত্ব ব্যবসায় লাভ ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এক হাজার ৫০০ বিঘা জমি ছিল এই গ্রুপের। কয়েক হাজার টাকায় কেনা প্রতি বিঘা জমির দাম এখন অনেক। নিজের মতাদর্শের সঙ্গে না মেলায় অভিমান করে নিজের লাভের ভাগ না নিয়েই সেখান থেকে চলে এসেছি। এই নিয়ে অবশ্য আফসোস নেই। কারণ সেখান থেকে চলে আসার পর ব্যবসায় উন্নতি করার জন্য ভেতরে ভেতরে আরও মনোবল জমা হচ্ছিল।’
তবে মজার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে ২০০৩ সালের একটি ঘটনা তিনি মনে করিয়ে দেন। বেস্ট বিজনেস অ্যাওয়ার্ডের পুরস্কার নিতে গিয়ে তৎকালীন সময়ে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সবার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘দেখুন ১০০ টাকা বেতনে চাকরি করে কত বড় অ্যাওয়ার্ড নিয়ে যাচ্ছে।’
ভব্যিষৎ স্বপ্নের কথা উঠতেই পিএইচপি গ্রুপের এই কর্ণধার বলেন, ‘যতদিন বাঁচি মানুষের জন্য, দেশের জন্য সেবা করে যেতে চাই। যদি কখনও শুনি সুফি মিজানের জন্য আমার ভাগ্য বদল হয়েছে সেদিন আমার অনেক আনন্দ হবে। আমি খোদাভক্ত একজন মানুষ। বিশ্বাসটাকে পুঁজি করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই আমার কাজ।’
ব্যক্তি জীবনে সাত ছেলে এক মেয়ের সম্মানিত পিতা সুফি মিজানুর রহমান। বাংলা ভাষা ছাড়াও একাধারে হিন্দি, উর্দু, ফার্সি, আরবি, ইংরেজিসহ বিশ্বের কয়েক ভাষায় কথা বলতে পারেন তিনি। বাবার এমন সাফল্যে গর্বিত তার সন্তানরাও। বড় সন্তান মো. মোহসিন পিতার মতোই দেশসেরা একজন শিল্পোদ্যোক্তা। তার অন্য ভাইবোনেরা হলেন ইকবাল হোসেন, আনোয়ারুল হক, আলী হোসেন, আমির হোসেন, জহিরুল ইসলাম ও আক্তার পারভেজ হিরু ও ফাতেমা তুজ-জোহররা। তাদের মা তাহমিনা রহমান।
ঢাকার কাঞ্চননগর গ্রামে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে ৩২ বছর আগে। মাত্র পাঁচ টাকায় সেখানে রোগীদের দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। চট্টগ্রাম শহরের আসকারদীঘি পাড়ে মাউন্ট হাসপাতালসহ শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে উচ্চশিক্ষার জন্য ‘ইউআইটিএস’ গড়ে তুলেছেন তিনি।
বাবার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বড় সন্তান মো. মোহসিন বলেন, ‘জানিনা তার মতো হতে পারব কি না। তবে বাবা সবসময় একটি কথা বলেন যখন যে কাজই করিনা কেন তা যেন সম্মানের সঙ্গে করি। কোন কাজকে অবহেলা বা খাটো করে দেখতে চাই না। বাবার স্বপ্ন আছে অনেক। তিনি মুখে না বললেও আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারি। পারিবারিকভাবে ঢাকার কাঞ্চননগর গ্রামে ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে ৩২ বছর আগে। মাত্র পাঁচ টাকায় সেখানে রোগীদের দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। চট্টগ্রাম শহরের আসকারদীঘি পাড়ে মাউন্ট হাসপাতালসহ শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে উচ্চশিক্ষার জন্য ‘ইউআইটিএস’ গড়ে তুলেছেন তিনি। কেবল তাই নয়, সুন্নিয়া মাদরাসাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আর্থিক অনুদান দিচ্ছেন। তার আরেকটি স্বপ্ন আছে দেশের ভেতর একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার। পাশাপাশি নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠার জন্য ‘জাপান বাংলাদেশ চেম্বার অ্যান্ডস কমার্স’ গড়ে তোলার ইচ্ছে আছে।
সুফি মিজানের পিএইচপি দেশে ২৪টির বেশি খাতে বিনিয়োগ করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে কোল্ড, স্টিল, ফিশারিজ, স্টকস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, পাওয়ার জেনারেশন প্লান্ট, কন্টিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং মিলস, শিপিং এজেন্সি, ফ্লাট গ্লাস, লেটেক্স অ্যান্ড রাবার প্রোডাক্টশন, টার্মিনাল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, প্রপার্টিজ, রোটারি ক্লাব, পেট্রো রিফাইনারি, এগ্রা প্রোডাক্ট, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স, কোল্ডস্টোরেজ, শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং, ওভারসিজ, হাসপাতাল, এয়ারলাইন্স ও ইলেক্ট্রিক খাত। সফল ব্যবসায়ী হওয়ার পর সুফি মিজান লাভ করেছেন ২০০৩ সালের ‘দ্য ডেইলি স্টার অ্যান্ড ডিএইচএল বেস্ট বিজনেস অ্যাওয়ার্ড, ২০০৭ সালে ব্যাংক বীমা অ্যাওয়ার্ড, ২০০৯ ও ২০১১ সালের ব্যাংক বীমা অর্থনীতি অ্যাওয়ার্ড।
প্রাইমারিতে পড়ার সময় লেবু চুরির একটি ঘটনা থেকে জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা নিয়েছেন সুফি মিজান। আজও সেই শিক্ষা তার চলার পথের পাথেয়। মজার সেই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘গরমের দিন। বৈশাখ-চৈত্র মাস। বাড়িতে শুঁটকির ভর্তা বানানো হয়েছে। আমাদের কাছে তখন শুঁটকি ভর্তার সঙ্গে লেবু খুব উপাদেয় খাদ্য ছিল। তো বাবার সামনে লেবু কেটে দেওয়া হলো। বাবা খেতে গিয়ে বললেন, আজকে তো লেবু কিনি নাই। লেবু কোত্থেকে এলো? আমি মনে মনে ভাবলাম বাবাকে যদি বলি আমরা বন্ধুরা মিলে পাশের জমিদারবাড়ি থেকে লেবু চুরি করে এনেছি তাহলে বুঝি বাবা খুব খুশি হবেন। বলেও ফেললাম তাই।
আব্বা বিদ্যুতের মতো গর্জন দিয়ে উঠলেন। বললেন, কী বললে! তুমি মানুষের বাড়িতে লেবু চুরি করতে গেছ! আমি তোমাকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি ভালো মানুষ করার জন্য আর তুমি লেবু চুরি করতে গেছ! কাঠের পিঁড়িতে বসে খাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা পিঁড়ি হাতে নিয়ে আমাকে মারতে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌড়ে বের হয়ে গেলাম। আমাকে বললেন, সব লেবু নিয়ে ওদের বাড়িতে দিয়ে এসো। মনে আছে, অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে এক হাতে লেবু, আরেক হাতে চোখের পানি মুছছিলাম। ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ার সময় বাবা এই যে একটা অনুশাসন দিলেন তা সারা জীবনের মতো মনে গেঁথে গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম বাবা বুঝি খুব নিষ্ঠুর। কিন্তু না। এখন মনে করি ওইটা আমার শ্রেষ্ঠ শাসন ছিল। দয়া ছিল।
আর সে কারণেই আজ এই ৭৫ বছর বয়সেও (৬ বছর আগে, এখন তাঁর বয়স ৮১) কোনো মানুষের জিনিসে হাত দিই না। অবৈধ কোনো কিছু মনেও আসে না। কেবলই বাবার সেই অনুশাসনের কথা মনে হয়। যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছেন আমার বাবা।’
সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘টোকিও থেকে ভ্যানকুভার, উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ অনেক জায়গায় গিয়েছি। ব্যবসায়িক জীবনে বহু মানুষের সঙ্গে লেনদেন করেছি। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না, মিজান সাহেবের কাছে ৫টা টাকা পাওনা আছে। মানুষের হক, বান্দার হক, দেশের হক, প্রতিষ্ঠানের হক সবকিছুই বিবেচনার সঙ্গে নিই, যা আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি। আর সে কারণেই হাসিমুখে আল্লাহর কাছে ফিরে যাব বলে আশা করি।’
একুশে টেলিভিশনের রফিকুল বাহার লিখেছেন, ‘‘নিজের বাড়ি রূপগঞ্জকে ভুলে যান নি সুফি মিজান। সবশেষে সে সঙ্ক্রান্ত আমার নিজের ছোট্ট একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করতে চাই। ধান চাষ করেছেন গ্রামের বাড়ি রূপগঞ্জে। ফলন ভালো হয়েছে। তা দেখার জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়েই চট্টগ্রাম থেকে রওনা হন ফজরের নামাজ পড়ে। রূপগঞ্জে গিয়েই সোনালী ধানের ফলন দেখে আমি মুগ্ধ। আর সুফি মিজানের মুখে শুনতে পেলাম অন্য একটি কথা। যা একজন শিল্পপতির মুখে শুনবো বলে ভাবিনি। তিনি বললেন, ‘শিল্পপতিরা যদি চাষবাদে এগিয়ে আসেন তাহলে বাংলাদেশের খাদ্য ও পুষ্টি সংকটসহ অনেক কিছুরই সমাধান হয়ে যাবে।’
১৩ বছর আগের ঘটনা এটি। বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সুফি মিজানের নানা উদ্যোগের অবদান রয়েছে তাতে।
সুফি মিজানের যে অফুরন্ত দম তিনি যে অসম্ভব পরিশ্রমী সেটি বুঝতে পেরেছি সেদিন। ধান ক্ষেত দেখে আমি ফিরি চট্টগ্রামে। তিনি চলে যান ঢাকায়। আমি ফিরে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে রাতে আর প্রতিবেদন তৈরি করতে পারিনি, করেছি পরেরদিন। আসার আগে আমাকে মায়া করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। তাকে খেতে বললে তিনি বলেন ‘আমি রোজা রেখেছি’। পরে জানতে পারলাম তিনি ঢাকায় গিয়ে অফিস করেছেন। বিদেশ থেকে আসা অতিথিদের সঙ্গে মাহফিল করেছেন। তখন সুফি মিজানের বয়স ছিল ৬৩ বছর। আর তখন আমার বয়স ছিল ৩৮ বছর। সুফি মিজান এমনই, একজন যুবকও যার সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠেন না।’’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস মোহাম্মদ কায়কোবাদ প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেন-
‘‘সবাইকে জানাতে ভোলেন না যে তিনি ১০০ টাকা মাসিক বেতনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন এবং সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মও গ্রহণ করেননি। তাঁর জীবনের ইতিহাস সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার ইতিহাস, যা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে গুলশানে একটি হোটেলে বড় আয়োজন করেছেন। সেখানে বিদায়ী রাষ্ট্রদূত এবং সম্ভবত মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত তাঁকে রীতিমতো পিতা বলে সম্বোধন করলেন। একটি দেশের এটা যে কত বড় প্রাপ্তি, একজন মানুষ অন্য দেশের একাধিক রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে সম্মান পেয়েছেন। সেই সম্মানটি আমাদের দেশের। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনন্য সব ব্যক্তিত্বকে।
একবার নিয়ে এলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করার এ রকম প্রচেষ্টার কোনো জুড়ি নেই। ২০১৪ সালের এমন একটা সময়ে আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে এলেন, যখন বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছিল, সর্বত্র ছিল অনিশ্চয়তা। কিন্তু নিশ্চয়ই সুফি মিজানুর রহমানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হয়নি প্রায় ৯০ বছর বয়সী এই নেতার। সুফি সাহেবের বক্তব্য এতই হৃদয়গ্রাহী, শক্তিশালী। ওই সময়ে মাহাথির মোহাম্মদের আগমন নিশ্চয়ই আমাদের দেশের ভাবমূর্তিতে একটি বড় অবদান রেখেছে। ২৪টির বেশি কোম্পানিসমৃদ্ধ গ্রুপের নাম দিয়েছেন পিএইচপি-শান্তি, সুখ-সমৃদ্ধির ইংরেজি শব্দের আদ্যক্ষর দিয়ে। তাঁর কোনো এক কোম্পানির একজন কর্মকর্তা দৃষ্টিশক্তি হারালেন। তাঁকে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, তাঁর চলাচলকে নির্বিঘ্ন করে চাকরিতে বহাল রেখেছেন।
সুফি মিজানুর রহমানকে নিয়ে এনটিভির প্রগ্রামটি নিচে-
সূত্র : পিএইচপিফ্যামিলিডটকম, এনটিভি, চ্যানেল আই, প্রথম আলো, একুশে টেলিভিশন, নিউজচট্টগ্রাম২৪, সারাবাংলা, ইউটিউব




