অসাধারণ ভালোবাসার গল্প, প্রধানমন্ত্রীও খোঁজ নিলেন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:৪০:৫৯ অপরাহ্ন
অনুপম নিউজ ডেস্ক : ভাইরাল হওয়া সোহেল-রওশনের নজিরবিহীন ভালবাসার গল্পটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তা নজর কেড়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাদের অবস্থার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে দেয়া হয়েছে নির্দেশনা। সেই পরিপেক্ষিতে বুধবার বিকেলে তাদের বাড়িতে যান ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আক্তারুজ্জামান।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক এনামুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ পাওয়ার পর আমি নিজে ওই দম্পতির সাথে কথা বলেছি।
পরে সরেজমিনে তাদের খোঁজখবর জানতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ওই দম্পতির বাড়িতে গিয়ে খোজঁখবর নেন ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী অফিসার। শুরুতেই সোহেল-রওশন দম্পতিকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও মেয়ে স্মরণীকে চকলেট উপহার দেন ইউএনও। পরে পরিবারটির নানা সমস্যা ও কষ্টের কথা শোনেন এবং সেগুলো দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জানিয়ে সমাধানের আশ্বাস দেন।
ইউএনও আক্তারুজ্জামান বলেন, ভালবাসার যে নিদর্শন তৈরি করেছেন সোহেল-রওশন দম্পতি, তা অতি বিরল। সরেজমিন এসে আমারা দেখলাম, জানতে পারলাম। একটি প্রতিবেদন তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাবো।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খোঁজখবর নেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন সোহেল-রওশন দম্পতি।
ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১৪ বছর আগে ভালোবেসে রওশনের হাত ধরেন সোহেল। তাদের এই চলার পথটা মোটেও সহজ ছিল না। কেননা অন্য আর দশটা মেয়ের মতো সুস্থ স্বাভাবিক নন ময়মনসিংহের ত্রিশালের রওশন আক্তার। ভালোবাসার প্রমাণ দিয়েছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সোহেল মিয়া। ভবিষ্যতে নানা সমস্যা আসবে জেনেও সকলের অমতে আবদ্ধ হন বিয়ের বন্ধনে।
ত্রিশালের গুজিয়াম টানপাড়া গ্রামে ছোট্ট মাটির ঘর আর একটি টং দোকানই সম্বল এ দম্পতির। শত কষ্টের মাঝেও ভালোবাসা আর পরস্পর আস্থা-বিশ্বাসই যেন তাদের কাছে সুখের পালক।
জানা গেছে, জন্ম থেকেই দুই পা অচল রওশনের। পায়ে ভর দিয়ে নেই চলার শক্তিটুকুও। স্বামীর পিঠে চড়ে চলাচল করেন এখানে-সেখানে। হয়েছেন সন্তানের মা। কঠিন এ জীবনসংগ্রামে মসৃণ পথ তৈরির মূলে ছিল প্রেম, ভালোবাসা, ভরসা আর বিশ্বাস।
৮ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট সোহেল মিয়া। ছোটবেলায় হারিয়েছেন বাবা-মাকে। ভাই-বোনের কাছে থেকে পড়াশোনা করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ভালো চাকরি নেন সোহেল। এক পর্যায়ে সচ্ছলতার জীবন ছেড়ে অভাবের সংসার মেনে নিয়েছেন অসহায় স্ত্রীর পাশে থাকতে। ভালোবাসা যেখানে অভাব অনটন দেখে দৌঁড়ে পালায়, সেখানে অভাবকে ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন এ দম্পতি।
সোহেল মিয়া বলেন, পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি করতাম। একদিন বিকেলে অফিস ছুটির সময় আমার টেবিলের ড্রয়ারে থাকা একটি ১০ টাকার নোটে একটি নম্বর লেখা দেখতে পাই। ওই নম্বরে একদিন কল করি। সেই কলের মাধ্যমেই রওশনের সঙ্গে আমার প্রথম কথা হয়। আস্তে আস্তে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে আমাদের প্রেমের শুরুটা হলেও ডিসেম্বরে গিয়ে বিয়ে করি।
তিনি আরও বলেন, শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম থাকলেও তার ভেতরে আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি আজ পর্যন্ত পাইনি। একজন স্বাভাবিক মেয়ে স্বামীর জন্য যতটুকু না করতে পারে সে তার চেয়েও বেশি কিছু করার চেষ্টা করে। সে আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। আর আমিও তার প্রতি পুরোপুরি দুর্বল।
রওশন আক্তার বলেন, আমি প্রতিবন্ধী হওয়ায় আমার পরিবার থেকেও বিয়েতে সম্মতি ছিল না। সেসময় সবাই বলাবলি করেছে, বিয়ের পর আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি যাকে ভালোবাসবো সেও আমাকে ভালোবাসবে। এই বিশ্বাসটাই আমি সোহেলের ওপর করতে পেরেছিলাম। সেজন্য সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে তার হাত ধরে আমি পালিয়ে যাই এবং বিয়ে করি। মেয়ে হওয়ার পর আমাদের ভালোবাসা যেন আরও বেড়ে গেছে।
রওশন আক্তার বলেন, কখনো কোথাও যেতে চাইলে আমি শুধু বলি আর সে তার পিঠে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া-আসা করে। আমার মনের চাহিদা পূরণের জন্য সে তার সাধ্যমতো চেষ্টা করে। তাকে আমি ধন-সম্পদ কিছুই দিতে পারিনি, শুধু আমার ভালোবাসাটুকুই দিয়েছি। আর সে আমার ভালোবাসা নিয়েই এখনো আমার সঙ্গে আছে। আমরা সুখেই আছি।
সোহেল মিয়া বলেন, আমাদের সময়ের ভালোবাসাটাই ছিল অন্যরকম। অচল-অক্ষম মেয়েকে যেভাবে অন্ধের মতো ভালোবেসেছি, তার মাঝেও তেমন ছিল অন্ধ প্রেম। এমন প্রেম এখন আর দেখা যায় না। এখনকার প্রেম হলো প্রথমে দেখা, তারপর কথা, পরে অন্যকিছু। এই আছে এই নেই। কিন্তু আমাদের প্রেম ছিল পবিত্র, সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে পাওয়া।
সোহেল-রওশনের এমন নজিরবিহীন ভালোবাসার বন্ধন রীতিমতো অবাক করে স্বজন ও প্রতিবেশীদেরও। তারা বলেন, আমরা প্রথম অবস্থায় সোহেলকে বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ের পর কিছুদিন পর তাকে চলে যাক এমনটা আমরা চাইনি। তখন তাদের মতামতেই তারা বিয়েটা করে। কিন্তু তাদের মধ্যে যে প্রেম, এতটা আকর্ষণ তা বুঝতে পারিনি। সত্যিকারের প্রেম যে কতটা গভীর তা তাদের দেখেই আমরা বুঝতে পারি। রওশনকে পিঠে নিয়ে সোহেল যেভাবে আনা-নেয়া করে তা দেখে আমরা সত্যিই অবাক হই।
ভালোবাসা মানে একজনের কাছে আরেকজনের দায়বদ্ধতা। সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে থাকা। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়ার নামই ভালোবাসা। তবে স্বার্থের দুনিয়ায় যেখানে ঠুনকো আঘাতে সম্পর্ক ভাঙনের ছড়াছড়ি, সেখানে একজনের দু-পায়ে ভর দিয়ে দুটি মানুষ কাটিয়ে দিয়েছেন ভালোবাসার ১৪টি বছর। (বিডি জার্নালের সৌজন্যে)




