বিশ্ব সত্যের কবি দরবেশ জমিদার হাসন রাজার জন্মদিন আজ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:১৩:৫৩ অপরাহ্ন
হাসন রাজার দর্শন সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে Indian Philosophical Congress এ বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।” এছাড়াও ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারে’ রবীন্দ্রনাথ ‘The Religion of Man’ নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সংগীতের উল্লেখ করেন
অনুপম প্রতিবেদক, সিলেট অফিস : তিনি বলতেন ‘ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর/আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার/লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার/কী ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার’।
তাঁর অন্তরদৃষ্টিতে পরিস্কার ধরা পড়েছিল ক্ষণস্থায়ী এ মুসাফির জীবন শূন্যের মাঝে রয়েছে। এখানে ভোগ বিলাস আর ক্ষমতার দাপটে মেতে থাকা উচিত না। ছেড়ে দিলেন ক্ষমতাদর্পী বিলাসী জীবন। অন্তরের অন্তঃস্থলে কে কথা কয় তার খোঁজে দেওয়ানা হলেন। তিনি হাসন রাজা। তিনি বিশ্ব সত্যের মরমি কবি, দরবেশ জমিদার হাসন রাজা। আজ ২১ ডিসেম্বর তাঁর ১৬৭তম জন্মদিন। বিস্ময়কর এক সত্য এই যে, জমিদারির রাজত্বের প্রভাববলয় ছেড়ে দিলেন কিন্তু পরে খোদার দেওয়ানা হওয়া মানুষটি হয়ে গেলেন প্রভাবশালী দরবেশ কবি। কোটি কোটি মানুষের হৃদ মাঝারে বাজে তাঁর গান-কবিতা বংশ পরম্পরায়।
সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে এই মরমি কবির জন্ম। ৭ পৌষ ১২৬১ ও ২১ ডিসেম্বর ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে (ইংরেজী সাল অনুযায়ী) দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী এবং মোসাম্মৎ হুরমত জান বিবির ঘর আলোকিত করে জন্ম হয় হাসন রাজার। হুরমত বিবি ছিলেন আলী রাজার খালাতো ভাই আমির বখ্শ চৌধুরীর নিঃসন্তান বিধবা। পরবর্তীতে হাসন রাজার পিতা আলী রাজা তাকে পরিণত বয়সে বিয়ে করেন। হাসন রাজা ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পুত্র।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে- ‘আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে’, ‘আমি না লইলাম আল্লাজির নাম রে’, ‘লোকে বলে বলে রে, ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার’, ‘আগুন লাগাইয়া দিল কনে? হাছন রাজার মনে’ ও ‘গুড্ডি উড়াইল মোরে, মৌলার হাতের ডুরি’।
হাসন রাজা যাদুঘরের একাংশ
হাসনের পূর্বপুরুষের আবাসভূমি ভারতের উত্তর প্রদেশের অয্যোধ্যা। বংশ পরম্পরায় তাঁরা হিন্দু ছিলেন সেখানে। পরে তাঁরা তৎকালীন দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলা হয়ে সিলেটে এসে স্থায়ী হন। তাঁর দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী সিলেটে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, দেশ, জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের একটি ধর্ম রয়েছে, যাকে মানবতা বা প্রেম বা দরদ বলে। এই দরদের সাধনা হাসন রাজার গান এবং দর্শনে পাওয়া যায়। তিনি সর্বমানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গানগুলো শুনলে মনের মাঝে আধ্যাত্মবোধের জন্ম হয়। হাসনের দাদার মৃত্যুর পর তাঁর বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলি রেজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রেজা মারা যান। নিয়তির ব্যাপার। মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন জমিদারির দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন।
হাসন রাজা সুদর্শন সুপুরুষ ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান এবং পংক্তি রচনা করেছেন। এছাড়াও আরবী ও ফার্সি ভাষায় ছিল বিশেষ দক্ষতা। ওই যুগে সিলেটে ঘরে ঘরে আরবী ও ফার্সির চর্চা চলতো।
হাসন যৌবনে ছিলেন ভোগবিলাসী এবং সৌখিন। বিভিন্ন সময় তিনি অনেক নারীর সাথে মেলামেশা করেছেন। প্রতি বছর, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ নৌবিহারে চলে যেতেন বিস্তারিত হাওরে। বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত রেখেছেন। এই ভোগবিলাসের মাঝেও হাসন রাজা প্রচুর গান রচনা করেছেন। বাইজী দিয়ে নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্রসহ এসব গান গাওয়া হত। সেই গানের মাঝেও অন্তর্নিহিত রয়েছে নশ্বর জীবন, স্রষ্টা এবং নিজের কৃতকর্মের কারণে অপরাধবোধের কথা। কে জানতো সেই অত্যাচারী, ভোগবিলাসী জমিদারই হবেন পরবর্তীকালের সবচেয়ে প্রজাদরদি এবং দরবেশ জমিদার। হাসন রাজা পশু পাখি ভালোবাসতেন। ‘কুড়া’ ছিল তার প্রিয় পাখি। ঘোড়াও পুষতেন হাসন। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার একটি হলো জং বাহাদুর, আরেকটি চান্দমুশকি। এরকম আরো ৭৭টি ঘোড়ার নাম পাওয়া গেছে। হাসন রাজার আর এক মজার শখ ছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জড়ো করে রুপোর টাকা ছড়িয়ে দেওয়া। বাচ্চারা যখন হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নিত, তা দেখে তিনি খুব মজা পেতেন তিনি।
হাসন রাজা মিউজিয়াম, তেঘরিয়া, সুনামগঞ্জ
পশু পাখির যত্ন ও লালন পালনের জন্যে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন তিনি। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন আসাম এবং সিলেট এলাকায় ৮.৮ রিখটার স্কেলের এক ভয়াবহ ভুমিকম্পে মানুষসহ অনেক পশুপাখি প্রাণ হারায়। হাসনের নিজের কুড়ে ঘরটিও ভেঙ্গে যায়। পরে এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন তাঁর অনেক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু হয়েছে। খাদ্যের অভাবে হাসনের প্রাণপ্রিয় অনেক পশু পাখির মৃত্যু তাঁর মনে জীবন সম্পর্কে গভীর বৈরাগ্যের জন্ম দেয়।
জানা যায়, একদিন তিনি একটি আধ্যাত্নিক স্বপ্ন দেখলেন এবং এরপরই তিনি নিজেকে পরিবর্তন করা শুরু করলেন। বৈরাগ্যের বেশ ধারণ করলেন। জীবনযাত্রায় আনলেন বিপুল পরিবর্তন। নিয়মিত প্রজাদের খোঁজ খবর রাখা থেকে শুরু করে এলাকায় বিদ্যালয়, মসজিদ এবং আখড়া স্থাপন করলেন। সেই সাথে চলতে লাগলো গান রচনা।
দরবেশ হওয়ার পর হাসন রাজা আল্লা বিনে অন্য কিছু চান নি। তাঁর গান- ‘আমি যাইমুরে যাইমু, আল্লার সঙ্গে,
হাসন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে’।
হাসন রাজার দর্শন সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ সালে Indian Philosophical Congress এ বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্য কবির মাঝে এমন একটি গভীর তত্ত্ব খুঁজে পাই, ব্যক্তি স্বরূপের সাথে সম্মন্ধ সূত্রে বিশ্ব সত্য।” এছাড়াও ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারে’ রবীন্দ্রনাথ ‘The Religion of Man’ নামে যে বক্তৃতা দেন তাতেও তিনি হাসন রাজার দর্শন ও সংগীতের উল্লেখ করেন।
সিলেট শহরের জিন্দাবাজারে হাসন রাজা যাদুঘর
১৯০৭ সালে তাঁর রচিত ২০৬টি গানের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। এই সংকলনটির নাম ছিল ‘হাসন উদাস’। এর বাইরে আর কিছু গান ‘হাসন রাজার তিনপুরুষ’ এবং ‘আল ইসলাহ্’ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ধারণা করা হয়, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে এবং বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ ‘সৌখিন বাহার’-এর আলোচ্য বিষয ছিল- ‘স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার। এ পর্যন্ত পাওয়া গানের সংখ্যা ৫৫৩টি। অনেকে অনুমান করেন হাসন রাজার গানের সংখ্যা হাজারেরও বেশী।
সুনামগঞ্জ জেলা উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘হাসন রাজার অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান কম গাওয়া হয়। ভাববাদ ও আধ্যাত্মিক গান বেশি চর্চা হয়। সবকিছুই গাইতে হবে, না হয় হাসন রাজাকে জানা হবে কম।’ হাসন রাজার প্রপৌত্র, হাসন রাজা মিউজিয়ামের পরিচালক সামারিন দেওয়ান বলেন, হাসন রাজাকে স্থানীয় শিল্পকলা একাডেমির আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। তিনি হাসন রাজাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সরকারি সহায়তা বাড়ানোর দাবি জানান।
জেলা কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী জানান, জানুয়ারিতে হাসন রাজাকে নিয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে উৎসব হবে। হাসন রাজার গান সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে শিল্পকলা কর্তৃপক্ষ।
বিশ্বনাথের রামপাশায় হাসন রাজা ব্যবহৃত বাংলো ঘরটি
মরমি কবি হাসন রাজার ১৬৭তম জন্মদিন উপলক্ষে হাসন রাজা ফাউণ্ডেশনের উদ্যোগে আগামী ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বিকেল সাড়ে চারটা থেকে হাসন উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। এতে বর্তমান প্রজন্মের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী জাহিদুল কবির, কামরুজ্জামান রাব্বি, বাউল গরিব মুক্তার, এস বি শাহীন, কানিজ খন্দকার মিতু, অনিকা আক্তার লিমা প্রমুখ সংগীত পরিবেশন করবেন।