বিজয়ের ৫০ বছর: লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ডিসেম্বর ২০২১, ২:১১:০৫ অপরাহ্ন
🇧🇩 এই অর্জনকে অর্থবহ করতে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে, এবং অর্জিত স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির এই ঐতিহাসিক দিনে এ হোক আমাদের অঙ্গীকার 🇧🇩
মুহিব উদ্দিন চৌধুরী : আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। এবার আমরা বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি পালন করছি। ১৯৭১ সালের এই দিনে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম লাভ করেছিল। এই দিনে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী হয়। এই বিজয় সহজে আসেনি, দীর্ঘ নয় মাস পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধ করেছে এ দেশের দামাল ছেলেরা। এ যুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জন্যে যুদ্ধ, পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্যে যুদ্ধ।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর, বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর ৯১,৬৩৪ সদস্যের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী এই দিনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলাদেশের চৌকস গেরিলাদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল হানাদার শক্তি। এই দিনে ৯ মাসব্যাপী বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত প্রায় সকল দেশ স্বাধীনতার মাসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সেদিন ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী উপস্থিত ছিলেন না।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিজয় দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় ।
দুই.
স্মরণ করি সেইদিনটির কথা, যেদিন পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হয়। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হয়। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করে।
এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হয়। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
তিন.
প্রতিবছর বাংলাদেশের বিজয় দিবস বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে এর সূচনা ঘটে। জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত সামরিক কুচকাওয়াজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যোগ দেন। কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি।
হ্যাঁ, বাংলাদেশের এই বিজয় একদিনে আসেনি। এ বিজয় পিছনে রয়েছে জাতির ঘাম রক্ত ঝরা সংগ্রাম এবং এই সংগ্রামের মূল সেনাপতি ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির মহামন্ত্রে উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ’১৯৪৮-এ বাংলা ভাষার দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলন রূপ নেয় ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ ও ৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ৫৮-এর মার্শাল ’ল বিরোধী আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬-দফার আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান, ৬-দফা ভিত্তিক ’৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ খ্যাত কালজয়ী ঐতিহাসিক ভাষণ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদি ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি।
চার.
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালির উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে এবং পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঙালির জয়যাত্রা শুরু হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে রচিত হয় লাল সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশ। সারাবিশ্বে বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠা পায়।
পাঁচ.
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি আজকের এই বিজয়ের দিনে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের অক্লান্ত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভূমি ৷ যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের রুহের মারফেরাত কামনা করছি।
লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনকে অর্থবহ করতে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে, এবং অর্জিত স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির এই ঐতিহাসিক দিনে এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।