যুক্তরাষ্ট্রের যে শহরের শাসনভার মুসলিমদের হাতে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ নভেম্বর ২০২১, ১২:২১:৫৪ অপরাহ্ন
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও অন্য নানা রাজ্যে সাংস্কৃতিক সংঘাতের মধ্যেও ধর্ম ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে হ্যামট্রামক শহরের বাসিন্দারা সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের মধ্যে বসবাস করছেন
অনুপম প্রতিবেদক : বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের হ্যামট্রামক শহর। ২০২০ সালের গণনা অনুযায়ী জনসংখ্যা ২৮,৪৩৩ জন, এখন ত্রিশ হাজার ছাড়িয়েছে। যার প্রায় অর্ধেক মুসলিম।
ঐতিহাসিক ব্যাপার হলো, চলতি মাসের শুরুতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে শহরটির কাউন্সিল নির্বাচনে নির্বাচিত সবাই মুসলিম। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবার হলো এমন। এতে দুজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত আছেন। শহরটিতে ২৫% মানুষ আরব অরিজিন (বেশিরভাগ ইয়েমেনি আরবি)। বাকী ২৭% মুসলিম এশীয়দের মধ্যে বেশিরভাগ বাংলাদেশি। প্রথমবারের মতো সিটি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন— ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত আমেরিকান চিকিৎসক আমির গালিব।
হ্যামট্রামক সিটি হল- শাসনকেন্দ্র
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সিটি কাউন্সিলে খলিল রিফায়ি, আমানদা জাকুস্কি ও আদম বারমাকিসহ মোট ছয়জন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। এদিকে গত দুই দশকে প্রথমবার একজন এশিয়ান বা মুসলিম হিসেবে গালিবের মেয়র পদে বিজয়ী হওয়াকে বড় ধরনের পরিবর্তন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে আমির গালিব বলেছেন, প্রশাসনের কিছুই বদলাবে না, আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের পক্ষে শপথ নেব। আমরা সকল ধর্মের মানুষের কল্যাণে কাজ করবো।
বাহরাইনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত আদম ইরলি কাউন্সিলর নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থীদের বিজয়কে ইতিবাচক হিসেবে বলে মন্তব্য করেছেন। এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের বিভক্ত জাতির জন্য হ্যামট্রামক শহর আশার প্রতীক হয়ে থাকবে।’
বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের হ্যামট্র্যামক ‘মাত্র দুই বর্গ মাইলের বিশ্ব’ বলে একটি প্রবাদ প্রচলিত। কেননা পাঁচ বর্গ কিলোমিটারের এ শহরে ৩০টির বেশি ভাষায় মানুষ কথা বলেন। যেন বিশ্বের বৈচিত্র্যময়তা এখানে এসে একসঙ্গে মিলিত হয়েছে।
কাউন্সিল নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থীদের বিজয়ের মধ্য দিয়ে শহরটি দেশের ইতিহাসের পাতায় অনন্য স্থান অধিকার করেছে। অনেক বছর ধরে নানা ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হয়ে সেখানকার মুসলিমরা এখন শহরের মূল শক্তিতে পরিণত হয়েছে। শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে মুসলিমদের মধ্যে এখন ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। শহরের বৈচিত্র্যময়তা ও বহু-সংস্কৃতিকে ধারণ করে তারা এ শহরের নেতৃত্ব দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও অন্য নানা রাজ্যে সাংস্কৃতিক সংঘাতের মধ্যেও ধর্ম ও সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে হ্যামট্রামক শহরের বাসিন্দারা সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের মধ্যে বসবাস করছেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আগে এ শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠরা জার্মান বাসিন্দা হলেও বর্তমানে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান মুসলিমদের বসবাস। তা ছাড়া এখানকার শতকরা ৪২ ভাগ বাসিন্দা অন্য দেশে জন্মগ্রহণ করেছে। আর শতকরা ৬০ ভাগ বাসিন্দা নিজ ঘরে ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলে থাকে। তা ছাড়া এখানকার অর্ধেকের বেশি মুসলিম গুরুত্বের সঙ্গে নিজ ধর্ম পালন করে। এখানে রয়েছে সুন্দর সুন্দর মসজিদ মন্দির গির্জা প্যাগোডা ইত্যাদি।
হ্যামট্রামক শহরের পথ ধরে হাঁটলে দোকানের সাইনবোর্ডে আরবি ও বাংলা লেখা পাওয়া যায়। দোকানে এমব্রয়ডারি করা বাংলাদেশি পোশাক ও ইয়েমেনের ঐতিহ্যবাহী জানবিয়াত নামের খঞ্জর বা ফলক দেখা যাবে, যা কোমরে বেল্ট দিয়ে ঝোলানো থাকে। এ ছাড়া পোলিশ বেকারির বাইরে দেখা যাবে, মুসলিমরা এক ধরনের পোলিশ কাস্টার্ড কেক কিনতে লাইনে দাঁড়ানো। আবার একই পথে মিনি স্কার্ট ও বোরকা পরা নারীদের হাঁটতে দেখা যাবে। এককথায় বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মিশেলে গড়ে উঠেছে এ শহর।
সিটি মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আমির গালিব বলেন, ‘আমি খুবই গর্বিত ও আনন্দিত। তবে আমি জানি যে তা অনেক বড় দায়িত্ব।’ ২০ বছর আগে ১৭ বছর বয়সে গালিব যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। প্রথমদিকে তিনি হ্যামট্রামক শহরের কাছে একটি দোকানে কাজ করতেন। এরপর তিনি ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। জীববিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। বর্তমানে তিনি স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
পিউ রিসার্চ সেন্টার থিংক ট্যাঙ্ক এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৩.৮৫ মিলিয়ন মুসলিম বসবাস করছে, যা মোট জনসংখ্যার শতকরা ১.১ ভাগ। ২০৪০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমরা খ্রিস্টানদের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী হলেও মার্কিন মুসলিমরা নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হন। বিশেষত ৯/১১-এর বেদনাদায়ক ঘটনা অদ্যাবধি মুসলিমদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এমনকি আমেরিকানদের কাছে অনেক বেশি নেতিবাচক আচরণের মুখোমুখি হন। কিন্তু অনেক ব্যর্থতার পরও পরিস্থিতি সামাল দিয়ে প্রথম মুসলিমদের হাতে হ্যামট্রামক শহরের দায়িত্ব দিলেন ভোটাররা।