বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য সরকারের কৌশলগত সংলাপ শেষে যৌথ ইশতাহার
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ৯:৪১:৫১ অপরাহ্ন
লণ্ডন অফিস : বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য চতুর্থ বার্ষিক কৌশলগত সংলাপ সম্পন্নের পর দুই দেশের যৌথ বিবৃতি প্রকাশ পেয়েছে। এতে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরিধি আরও বাড়ানো, রাজনৈতিক এবং আচ্ছাদিত কূটনৈতিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমস্যা, অর্থনৈতিক ও উন্নয়নে অংশীদারিত্ব, প্রতিরক্ষা এবং সৃজনশীল বিনিময়ের ব্যাপার স্থান পেয়েছে।
১৩ সেপ্টেম্বর লণ্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দু’দেশের মধ্যকার এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে বৃহস্পতিবার ৯ সেপ্টেম্বর। এতে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ এবং উন্নয়ন বিষয়ক অফিসের (এফসিডিও) নেতৃত্ব দেন আন্ডার সেক্রেটারি ফিলিপ বার্টন। অপরদিকে পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের সংলাপে অংশ নেন। উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা শেষে একটি যৌথ ঘোষণা-পত্র প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে অনুষ্ঠিত এবারের কৌশলগত সংলাপ যুক্তরাজ্য-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করেছে। উভয় দেশের প্রতিনিধিরা যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রবাসী সংযোগ ও কমনওয়েলথের সদস্যপদের কারণে মানুষের সাথে মানুষের সুদৃঢ় সম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বীকৃতিদাতা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের ভূমিকা স্মরণ করে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কে উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অংশীদারিত্বকে বিবেচনায় নেয়া হয়। উভয় দেশই ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লণ্ডন ভিজিট, সে-সময় তৎকালিন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে।
উভয় দেশ স্বীকার করে দুদেশের গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সংযোগ রয়েছে। বিশেষত প্রাণবন্ত অভিবাসী সংযোগ এবং নিজেদের কমনওয়েলথ সদস্যপদের সম্পর্ক রয়েছে।
তাছাড়া, করোনাকালে দুই দেশের মহামারি মোকাবেলার বিষয়ে ঐকমত্য হয়। স্বজন হারানোয় শোক প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যের সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে এবং যুক্তরাজ্য ভ্যাকসিনের অব্যাহত সরবরাহ নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশ দেশব্যাপী কোভিড -১৯ টিকা দেয়া চালু করায় যুক্তরাজ্য অভিনন্দন জানিয়েছে।
দ্বিপাক্ষিক আলাপে উভয় পক্ষ বাংলাদেশের ঐতিহাসিক অর্জনে আনন্দ প্রকাশ করেছে। স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটিসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মানুষের অধিকার সংক্রান্ত সমস্যা আলাপে স্থান পেয়েছে।
যুক্তরাজ্য ‘মেয়েশিশুকে শিক্ষিত করা’ বিষয়ে বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছে। নারীর ক্ষমতায়নকে সমর্থন করার জন্য প্রচারণা এবং উদ্যোগেরও প্রশংসা করেছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কিত কিছু বিষয়, যেমন: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাব, বিধিবহির্ভূত আটক, বিধিবহির্ভূত বিচারপ্রক্রিয়া, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাজ্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উভয় দেশই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব, জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে সুশীল সমাজের উপস্থিতি ও মতপ্রকাশ ও ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে একমত হয়েছে। সংঘাত প্রতিরোধ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, নিয়ম ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা সমর্থনসহ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একে অপরকে সহযোগিতা করতে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে উভয় দেশই প্রশিক্ষণ, পেশাগত সামরিক শিক্ষা ও ইন্সট্রাকশনাল এক্সচেঞ্জ সহ যৌথ সহযোগিতাকে স্বাগত জানায় এবং এই বছরের শেষের দিকে একটি প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংলাপ উদ্বোধনের আশা ব্যক্ত করেন।
যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ বিশ্বের সকল দেশকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরো দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা করে যুক্তরাজ্য। আগামী বছরগুলোতে কার্বন নির্গমন হ্রাস ও ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-জিরো নির্গমন সহ, একটি নিট জিরো টার্গেট ও কয়লা শক্তির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা জন্য বাংলাদেশের নেতৃত্বকে আরও উৎসাহিত করে। বিভিন্ন উৎস থেকে আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে যুক্তরাজ্যের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে উদ্বোধন হওয়া ইউকে-বাংলাদেশ ক্লাইমেট পার্টনারশিপের জন্য উভয় দেশই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার জন্য জাতিসংঘের সুপারিশ লাভ করায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। এই উত্তরণকে সফল করতে সাহায্য করতে ও বাংলাদেশ যেন তাঁদের রপ্তানিভিত্তিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে পারে, তাই যুক্তরাজ্য ২০২৯ পর্যন্ত তাঁদের দেশের বাজারে বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত ও কোটা মুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করলে উভয় দেশ তাঁদের উন্নয়ন অংশীদারিত্বের ভবিষ্যৎ রূপ নিয়ে আলোচনায় বসবেন বলে সম্মত হয়েছেন।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্তরাজ্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউকে-বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ডায়লগের উদ্বোধনকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতির গুরুত্ব এবং বাজার প্রবেশাধিকার বাধা হ্রাস করার উপর যুক্তরাজ্য জোর দিয়েছে। এতে করে উভয় দেশ লাভবান হবে।
দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক আলাপে উভয় দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অভিবাসন ও সম্পর্কের গভীরতাকে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। চলাচল ও অভিবাসন বিষয়ক একটি পার্টনারশিপ গঠনে যুক্ত হতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে। যুক্তরাজ্য তাঁদের নতুন পয়েন্টভিত্তিক অভিবাসন ব্যবস্থায় (the new points-based immigration system) প্রদত্ত সুযোগগুলি উল্লেখ করে। দুই দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করতে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে ‘ক্রস বর্ডার উচ্চশিক্ষা আইন’ বাস্তবায়নের অনুরোধ জানায়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানের জন্যে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সাথে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্য নিয়ে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ তাঁদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গাদের কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয় এবং উল্লেখ করে যে, শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত করবে ও বাংলাদেশে থাকাকালীন মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনে সাহায্য করবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে উভয় দেশ আসিয়ান ও জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
উভয় দেশ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের উপায় নিয়ে আলোচনা করে। যুক্তরাজ্য কারিগরি সহায়তা প্রদান ও প্রোগ্রামের মাধ্যমে কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের প্রভাব উন্নত, জনস্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোকে আরো মজবুত এবং জলবায়ু পরিবর্তন সঙ্কট মোকাবেলায় সাহায্য করতে পারে তা তুলে ধরে।
সবশেষে, উভয় দেশ এই সংলাপের মাধ্যমে গঠনমূলক আলোচনাকে স্বাগত জানায়। পরবর্তী বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য কৌশলগত সংলাপ ২০২২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ার আশা ব্যক্ত করেন।