আমেরিকা কি সত্যি ছেড়ে গেল? তালেবানের আফগানিস্তান ‘স্বাধীন’ হলো?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ আগস্ট ২০২১, ৩:২৯:৩৬ অপরাহ্ন
অনুপম প্রতিবেদক : ৩১ অগাস্টের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শেষ করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। টুইট করে নিজেই এই ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমেরিকা এবং ন্যাটোর বাহিনী কাবুল ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আতশবাজি ফাটিয়ে রীতিমতো উৎসবে করছে তালেবান।
টুইটারে দেশের সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে জো বাইডেন লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানে আমাদের সামরিক উপস্থিতি শেষ হল। গত ১৭ দিনে আমেরিকার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ আকাশপথে সব থেকে বেশি মানুষকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ সম্পন্ন করেছে আমাদের বাহিনী। ১ লক্ষ ২০ হাজারের বেশি মার্কিন নাগরিক, সহযোগী দেশগুলির নাগরিক এবং আমেরিকার আফগান সহযোগীদের উদ্ধার করা হয়েছে। এই কাজ করতে গিয়ে অতুলনীয় সাহসিকতা, পেশাদারিত্ব এবং দৃঢ়তার ছাপ রেখেছে আমাদের সেনাবাহিনী।’
প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ কথা বললেও পেন্টাগনের তরফে জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি স্বীকার করে নিয়েছেন, যত মানুষকে আফগানিস্তান থেকে উদ্ধার করা যাবে বলে আশা করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
তবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আমেরিকার ইতিহাসে এত বাজে সেনা প্রত্যাহারের নজির নেই। তিনি বলেন, “ইতিহাসে কখনওই বাইডেন প্রশাসনের আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের মতো এত খারাপ বা অদক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেনি।”
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে তালেবান তাদের পূর্ণ অস্তিত্ব জানান দিলো পুনরায়। কাবুলে গোষ্ঠটির হামলায় নিহত হয় ১১৫ জন। তালেবানকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলে দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ নিরাপত্তা সহায়তা বন্ধ করে দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওই বছরই মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের শর্তে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসে তালেবান। এরই মধ্যে কয়েক দফায় আফগানিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক মার্কিন সেনাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল দখলে নেয়ার পর।
২০২১ সালের মে মাসে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পহেলা সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব মার্কিন সেনাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন। জুনে প্রায় ৯০ শতাংশ সেনা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যায়। ওই সময় থেকেই তালেবানরা আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে হামলা জোরদার করে। শেষ পর্যন্ত গত ১৫ আগস্ট তালেবানের হাতে পতন ঘটলো কাবুলের।
সোমবার কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উদ্ধারকারী বিমানে মার্কিন সেনা, কম্যান্ডোরা ছাড়াও আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতও ফিরে যান।
তালেবানদের তরফে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ৩১ অগাস্টের পর আফগানিস্তানে আমেরিকা সহ কোনো বিদেশি বাহিনীর থাকা চলবে না। আমেরিকার সঙ্গে এই মর্মে চুক্তি হয়েছে তাদের। শুধু সামরিক বাহিনীকে ফিরিয়ে নেওয়াই নয়, আফগানিস্তানে নিজেদের কূটনৈতিক উপস্থিতিও বন্ধ করে দিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ আপাতত কাতার থেকে চালানো হবে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার জঙ্গি হামলার পর আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী অভিযান শুরু করে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ৩১ আগস্টের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার সম্পূর্ণ করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন অভিযানে ২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত ইসলামি কট্টরপন্থী গোষ্ঠী তালেবান আবারও ক্ষমতায় ফিরেছে গত ১৫ আগস্ট। বিশ বছর পর মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানের মাটি ছাড়লো।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগান জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনী যখন দেশটির একের পর এক শহরে আত্মসমর্পণ করছিল, তখন তালেবানরা তাদের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র জব্দের সুযোগ পায়। পায় হামভি ট্রাক ও ব্ল্যাক হকের মতো হেলিকপ্টার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বলছেন, এখন তালেবানরাই পৃথিবীর একমাত্র উগ্রপন্থি গোষ্ঠী, যাদের একটি বিমান বাহিনীও থাকছে। চলতি বছরের জুনের শেষ দিকেও আফগান বিমানবাহিনীর কাছে হামলায় ব্যবহারযোগ্য হেলিকপ্টার ও বিমানসহ মোট ১৬৭টি এয়ারক্রাফট ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশনের (সিগার) এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল। তবে এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত কতগুলো তালেবানের হাতে পৌঁছেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তালেবানের দখলে এখন হেরাত, খোস্ত, কুন্দুজ ও মাজার-ই-শরিফসহ আফগানিস্তানের বাকি ৯টি বিমান ঘাঁটিও। এসব ঘাঁটি থেকে মনুষ্যবিহীন ড্রোন এবং এয়ারক্রাফট জব্দের ছবি দিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যম ও তালেবান যোদ্ধারা।
তবে এটা ঠিক যে, এসব চালাতে পারদর্শী হতে তালেবানদের যথেষ্ট সময় লাগবে, ব্যবস্থাপনা লাগবে, মিকানিক্যাল সাপোর্ট লাগবে। হুট করে তারা সব পেয়ে যাবে না।
আরও কথা আছে। আমেরিকা সব ভালো অবস্থায় রেখে গেছে কি? কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দর ত্যাগের আগে সেখানে থাকা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ৭৩টি সামরিক বিমান মার্কিন বাহিনী এমনভাবে নষ্ট করে রেখেছে, যাতে তালেবানরা আর এগুলো ব্যবহার করতে না পারে।
মার্কিন সামরিক বাহিনীর জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি জানিয়েছেন, কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য যেসব সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা ছিল, সামরিক বিমানগুলোর মতো সেগুলোও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।
কেনেথ ম্যাকেঞ্জি আরও বলেন, ফেলে রেখে আসা মার্কিন সামরিক বিমানগুলো আর কখনও আকাশে উড়বে না। এছাড়া ৭০টি সামরিক যান এবং ২৭টি হামরি টহল যান নষ্ট করা হয়েছে, যার প্রতিটির মূল্য এক মিলিয়ন ডলার।
প্রশ্ন হলো, আমেরিকা কি সত্যিই আফগানিস্তান ছেড়ে গেল? তালেবানের আফগানিস্তান সত্যিই কি ‘স্বাধীন’ হলো? যারা এর উত্তরে ভাববেন ‘হ্যাঁ’। তারা ও তালেবানের মাঠ পর্যায়ের যোদ্ধারা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছুই বোঝেন না। তারা কেবল জোশে নাচেন।
এটা ঠিক, জো বাইডেন বিমর্ষ, চিন্তিত। তিনি তার দেশের ভিতরেও আফগান ইস্যুতে চাপে আছেন।
আমেরিকার ফেলে যাওয়া যুদ্ধ বিমান হেলিকপ্টাগুলোর নমুনা।
তবু বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস দেখায়, চিত্র বদল হতে পারে খুব অল্প সময়ে। আমেরিকা তাদের আফগানিস্তানে কূটনীতিক মিশন অব্যাহত রাখবে কাতার থেকে। আমেরিকার সাথে তালেবানদের গোপন আলাপ শেষ হয়ে যায় নি। শেষ হবে না। পাবলিককে প্রেরণা দিতে জোশ দেখানো এক জিনিস আর গোপনে সংযোগ রক্ষা করে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করা আরেক জিনিস। তালেবান ক্ষমতা ধরে রাখতে ‘বিস্ময়কর কম্প্রোমাইজ’ করতেই পারে শত্রু পক্ষের সাথে। আমেরিকার সাথে তালেবানের দোস্তি-দুশমনির লম্বা ইতিহাস আছে।
দুইদিনের ভিতর আফগানিস্তান আরেকটি ইরান হয়ে উঠবে কি? সম্ভব কি? কিংবা হতে চাইবে কি তালেবান? এখনই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশটিতে প্রায় নয় মিলিয়ন শিশু অপুষ্টির শিকার। অনেক অনেক বিদেশি সাহায্য তাদের দরকার। কেবল ‘বিদেশি’ তাড়াতে পেরে নাচলে তো দেশ চালানো যাবে না। এক ‘বিদেশি’ তাড়িয়ে অন্য ‘বিদেশি’র শরণাপন্ন হওয়ার মানে কী দাঁড়ায়?