প্রেম ও দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ আগস্ট ২০২১, ৩:০১:৩৩ অপরাহ্ন
অনুপম সাহিত্য প্রতিবেদক : মহা-বিদ্রোহের রণতূর্য বাদক, মহা-যৌবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। আজ ১২ ভাদ্র, ১৪২৮, সেই যৌবনের পূজারি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে প্রেম, মানবতা ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
দানবীয় বিরাটত্ব নিয়ে বাংলা সাহিত্যের আকাশ যখন পুরোটাই দখল করে নিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঠিক সেই সময় কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। সেই আবির্ভাব পর্বেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ধূমকেতু হতে আসেননি, ধ্রুবতারা হতে এসেছেন এবং ধ্রুবতারা হয়েছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাব ও তত্ত্বের জায়গায় প্রেম ও দ্রোহ, নিগূঢ় দর্শনের জায়গায় সাম্য-মানবতার গান গাইলেন কাজী নজরুল ইসলাম। পাকা করে নিলেন বাংলা সাহিত্যে নিজের স্থান, যে স্থান আজ পর্যন্ত কেউ নিতে পারেননি। অদূর ভবিষ্যতে নিতে পারবেন বলেও মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে যে নামটি উচ্চারিত হয়, সেটি কাজী নজরুল ইসলাম।
শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন তরুণ কাজী নজরুল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তার কলম ধারালো তলোয়ারের মতো কাজ করেছে। তার প্রতিটি লেখনি ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সে কারণে বারবার পড়েছেন শাসকদের কোপানলে। নিক্ষিপ্ত হয়েছেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। কিন্তু আদর্শচ্যুত হননি। মাথানত করেননি অন্যায়ের কাছে। কারও সঙ্গে করেননি আপসরফা।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল বিদ্রোহী ছিলেন না, ছিলেন মানবতাবাদীও। তার সাম্য ও মানবতাবাদ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দ্যোতনা সৃষ্টি করে। তার আগে বাংলা কাব্যসাহিত্যে এমন মানবতাবাদ, এমন সাম্যের বাণী আর কেউ শোনায়নি। তিনি যেন মানুষের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে বাংলা সাহিত্য আকাশে উদিত হয়েছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সংগ্রামী। ১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১০ বছর বয়সেই রোজগারে নামতে হয় তাকে। মক্তবের শিক্ষক, মুয়াজ্জিন ও মাজারের খাদেম, লেটোর দলের হয়ে গান বাঁধা, নাটকে অভিনয় করা— জীবন ও জীবিকার জন্য কী করেননি তিনি? রেলের ইংরেজ গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের কর্মচারী হিসেবেও কাজ করতে হয়েছে বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদপুরুষকে।
২৪ মে ১৯৭২ কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাজীবন কেটেছে রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরাম স্কুলে। কিন্তু নিদারুণ দারিদ্র্য তাকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে দেয়নি। সিয়ারসোল রাজ স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল।
১৯২১ সালে মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচিত হন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার সঙ্গেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে যান। সেখানে পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সঙ্গে, যার সাথে তার প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল। তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস খানমের সঙ্গে। বিয়ের আকদ সম্পন্ন হওয়ার পরে ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকৃতি জানান এবং বাসর সম্পন্ন হওয়ার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমীলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
নজরুল চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা করেছেন। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, দোলনচাঁপা, ছায়ানট, ইত্যাদি তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা তার উপন্যাস। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা ইত্যাদি তার বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ।
কাজী নজরুল সুগায়কও ছিলেন। ‘ধ্রুব’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেন। কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন তার বন্ধু। নজরুল যেমন রবীন্দ্রনাথকে তার বই উৎসর্গ করেছেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথও তার ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করেছিলেন নজরুলকে।
দারিদ্র্য ছিল নজরুলের চিরসঙ্গী। জগতের দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষের দুঃখ-কষ্ট গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন তিনি। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণে হঠাৎ করেই তার সাহিত্য সাধনা স্তব্ধ হয়ে যায়।
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা-গান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্যতম প্রেরণা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে ঢাকা নিয়ে আসেন এবং তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মান দেন।
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই…’ কাজী নজরুল ইসলাম
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকীতে এবার কোনো আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না। তবে রেডিও, টেলিভিশন, দৈনিক সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজপোর্টালগুলো নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার ও প্রকাশ করছে।