বিচার নেই তাই বাড়ছে সাইবার বুলিং
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ আগস্ট ২০২১, ১০:১১:১৬ অপরাহ্ন
প্রতীকি ছবি, সংগৃহীত
অনুপম নিউজ ডেস্ক : দেশে সাইবার বুলিং বা ইন্টারনেটে উত্যক্তকারীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বিশেষত টিনএজ মেয়েরা এ ধরনের সাইবার ক্রাইমের শিকার বেশি দেশে। আদালত আছে কিন্তু শাস্তির দেখা পাওয়া যায় না।
‘ক্লাস শুরুর কয়েকদিন পর-ই আমার আইডিতে ফেসবুকে এক সিনিয়র ভাইয়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। সম্মানের খাতিরে একসেপ্ট করি।
একসেপ্ট করার পরপরই তিনি আমাকে হাই-হ্যালো মেসেজ দিতেন। সম্মান দেখাতে গিয়ে আমি উনার মেসেজের উত্তর দেই।
কিন্তু একপর্যায়ে মেসেজ দেওয়ার মাত্রাটা স্বাভাবিকতার রেশ ছেড়ে অস্বাভাবিকতার দিকে চলে গেলো। বিষয়টি বুঝতে পেরে আমিও উত্তর দেওয়া থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকি। ক্যাম্পাসে হাঁটতে গেলে মাঝে মাঝেই আমার পিছু নিতো। একপর্যায়ে উনি সরাসরি আমাকে প্রেম নিবেদন করলে আমি প্রত্যাখ্যান করি।
এরপর থেকে উনি আমার ওপর চড়াও হন। প্রতিনিয়ত হুমকি ধমকি
দিয়েই যাচ্ছেন তার সঙ্গে প্রেমে জড়ানোর জন্য। নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে আমাকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন। ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাদের দিয়ে আমাকে তুলে নেওয়ারও হুমকি দেন মেসেঞ্জারে।
আমি অতিষ্ট হয়ে ফেসবুক পেজে কিছু মেসেজের ক্রিনশট দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রতিকার চাই। উলটো ফটোশপে আমার ছবি বিকৃতি করে ফেইক আইডিতে বিভিন্ন পেজে পোস্ট করে। এছাড়াও আরো কিছু ফেইক আইডি থেকে নোংরা কথাবার্তা লিখে প্রতিদিন মেসেজ করেই যাচ্ছে। প্রশাসন বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছি। কিন্তু এখনো এসব নোংরা মেসেজ আসা বন্ধ হয়নি। আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
কথাগুলো বলছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী। যিনি গত ১১মে মার্কেটিং বিভাগের ২০১৭-১৮ বর্ষের শিক্ষার্থী ফারুক হোসেন কর্তৃক সাইবার বুলিংয়ের শিকার। শুধু এ শিক্ষার্থীই নয় বিভিন্ন বিভাগের ২৪ জনেরও বেশি ছাত্রী ফারুকের বুলিংয়ের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এ ঘটনার পরপরই শিক্ষার্থীরা তার শাস্তির দাবি জানান। এমনকি মানববন্ধনও হয়। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হয়। কিন্তু সেটা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। আর ওইদিকে ছাত্রীটিও আত্মসম্মান রক্ষার্থে কোনো কিছু না বলে প্রতিনিয়ত এসব নোংরা মেসেজ পেয়েও ডুকরে কাঁদছে। অন্যদিকে অভিযুক্ত ছাত্রটিও পৈশাচিক আনন্দে সাইবার অপরাধে হয়তো বেছে নিয়েছে অন্য কোনো পন্থা।
শিক্ষার্থীদের দাবি, শুধু ফারুক নয়। ফারুকের মতো আরো কিছু শিক্ষার্থীর দ্বারা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে অনেক ছাত্রী। আর এটা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় না নিয়ে আসা। অপরাধ করে বেঁচে যাওয়া দেখে অনেকে উৎসাহিত হয়ে এ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশন পেজে এক সঙ্গে ৭৪ জন ছাত্রীর ছবি জুড়ে দিয়ে আপত্তিকর স্ট্যাটাস। স্ট্যাটাসে নিজেদের ছবি দেখে কার্যত ভেঙে পড়েন অনেক শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বমানের একটা প্ল্যাটফর্ম থেকে এমন জঘন্যতম কাজ ক্ষমার অযোগ্য বলে জানান তারা। আবার অনেক ছাত্রী বিবাহিত। তারা আশঙ্কা করছেন যদি কখনো এ স্ট্যাটাস পরিবারের কোনো সদস্যদের কাছে যায় তাহলে তারা কি জবাব দেবে। সেটা ভেবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন তারা। অভিযুক্ত সামনে এলেও প্রশাসন বলছে এখনো শনাক্ত হয়নি। সেজন্য আইসিটি সেল কাজ করছে। তবে উপাচার্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান।
শুধু এ দুটি ঘটনাই নয়, করোনাকালীন সাইবার বুলিংয়ের ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। কিন্তু কোনোটারই দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয়নি।
গতবছরের ১৩ নভেম্বর অপরিচিত আইডি থেকে গণিত বিভাগের এক ছাত্রীর ছবির ওপর, ফোকলোর বিভাগের এক ছাত্রের মোবাইল নাম্বার বসিয়ে আমাকে কল করুন, আমার কাছে সব পাবে (বাকিটা লেখার অযোগ্য) লিখে স্ট্যাটাস দেন। এ নিয়ে ইবি থানায় সাধারণ ডায়রিও করা হয়। কিন্তু সময়ের আবর্তে বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায়।
একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী তার ফেসবুক আইডি থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এতে রফিকুল ইসলাম নামে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ৪র্থ বর্ষের এক ছাত্র তাকে পাঁচ মাস ধরে মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠিয়ে বিরক্ত করতেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার অভিযোগও পাওয়া যায়। সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমেও শেষ হয় তার বিচার কার্য।
একই বছরের ২৫ জুন এমন আরও একটি ঘটনা সামনে আসে। ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র এনামুল কবীরের বিরূদ্ধে একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে মেসেঞ্জারে বার্তায় গালাগাল দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী তার ফেসবুক টাইমলাইনে প্রতিবাদ জানিয়ে স্ট্যাটাস দিলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। শুধু ওই ছাত্রীই নয় তার হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ৬-৭ জন ছাত্রী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে বলে জানা যায়। ঘটনায় বিভাগীয় শিক্ষকদের কাছে লিখিত ক্ষমা চেয়েই পার পেয়ে যায় সে।
এছাড়াও ইবির আইন বিভাগের কামরুজ্জামান সাগর নামে এক শিক্ষার্থী কর্তৃক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়ার ঘটনা সামনে আসে। কিন্তু প্রশাসন থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেয়নি।
গুটিকয়েক ঘটনা সামনে এলেও আড়ালে আরো বড় বড় ঘটনা থেকে যায়। আত্মসম্মানের ভয়ে অনেক ছাত্রীই প্রকাশ করেন না। রাজনৈতিক ছাত্রনেতা, সামাজিক সংগঠনের নেতা এমনকি শিক্ষকরাও বাদ নেই সাইবার বুলিং কাণ্ডে। অনলাইনে একপ্রকারে আতঙ্কেই কাটছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের। প্রতিনিয়ত সাইবার বুলিংয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। সাইবার বুলিং বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ চায় ছাত্রীরা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এগুলো ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যাবে। আগের ঘটনাগুলোরও বিচার হবে। গতকালকের বিষয়টির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীটি মৌখিকভাবে আমাদের জানিয়েছে, তবে অফিসিয়ালি পদক্ষেপ নিতে গেলে আমাদের ডকুমেন্টস লাগবে। আইসিটি সেল ডকুমেন্টস বের করার জন্য কাজ করছে। তারপর আমরা পরবর্তী পদক্ষেপে যাবো। সূত্র : বাংলানিউজ