তালেবান প্রশ্ন : যেসব উত্তর ঠিক উত্তর না, কারণ-
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২১ আগস্ট ২০২১, ১:৩৬:১৪ অপরাহ্ন
আঘাত করতে তৎপর তালেবান যুবক।
একটা সুবিবেচিত মধ্যপন্থা অবলম্বন না করলে নানা সংস্কৃতির বৈচিত্রের সম্মিলন হয় কি পৃথিবীর কোথাও? যে কারণেই হোক তালেবান তাদের দেশ চালাতে হলে গ্লোবাল রাজনীতির হিসাব বুঝে চাল দিতে গিয়ে, অন্য দেশ অন্য সংস্কৃতির কর্তাদের সাথে হাত মিলিয়ে চলতে হবে। তখন তাদেরকে ‘কৌশল অবলম্বন’ বলে নিজেদের নীতি-আদর্শের উল্টা চলতে হবে।
:: সারওয়ার চৌধুরী ::
তালেবানের নিয়ন্ত্রণে আফগানিস্তান। মানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ যাকে বলে বন্দুকের জোরে নিয়ন্ত্রণ। যে-নিয়ন্ত্রণ অগণতান্ত্রিক, যে-নিয়ন্ত্রণ ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণেরই একটি অন্যরকম রূপ।
রাজধানী কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ১৬ আগস্ট কাবুল বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের সি-১৭ সামরিক বিমানটিকে শত শত আফগান বেসামরিক নাগরিক ঘিরে ধরে।
বিমান বন্দরে আফগান নাগরিক আর বিদেশিদের ভিড়, পড়িমরি বিমানে চড়ার দৃশ্য বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখেছে। বাসে ট্রেনে চড়ার জন্য যেরকম ভিড় ঠেলা-ধাক্কা দেখা যায় আমাদের দেশে ঈদের সময়, সেভাবে আফগানরা প্লেনের উপড়ে চড়তে শুরু করে। তাদের মাথায় এটা আসছিল না যে, এভাবে প্লেনে যাওয়া যায় না। সম্ভব না।
আমেরিকার প্লেনটির সাথে সাথে দৌড়ছিলেন আফগান নাগরিকেরা। যেভাবেই হোক উঠতে হবে এতে।
আফগান ফুটবলার জাকি আনওয়ারি পরের দিন একটি আমেরিকান বিমানের চাকা গুটিয়ে রাখার জায়গায় ঢুকে বসেছিলেন স্বদেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্যে। হয়ত ভেবেছিলেন তখন তার মতো করে চাকা এসে সেট হবে যেখানে তার চিপায় ছোট্ট জায়গায় তিনি বসে থাকতে পারবেন। তালেবানের হাতে মরে যাওয়া থেকে বেঁচে যাবেন। কিন্তু হিসাব ভুল ছিল তার। এক ধরনের বিপদ থেকে বাঁচার জন্যে আরেক বিপদে পড়ে জীবন তার নাশ হয়ে গেল! কাতারে বিমানটি ল্যান্ড করার পর আনওয়ারীর দেহাবশেষ পাওয়া যায়। কী মর্মান্তিক!
কেন ওরা পালাতে চায়? বিশ বছর আগের তালেবান বর্তমানের তালেবান না, বললেই সব পানির মতো স্বচ্ছ হয় কি?
কয়েক দিন আগে সিএনএনের চিফ ইন্টারন্যাশনাল করেসপন্ডেন্ট ক্ল্যারিসা ওয়ার্ড যেভাবে কাবুল থেকে রিপোর্ট করছিলেন।
গত বিশ বছর ধরে কাবুলে কান্দাহারে জালালাবাদে কেবল নয়, দেশটির ৩৪ প্রদেশে তালেবান কি তাদের আচরণে এটা প্রমাণ করতে পেরেছে যে, তারা আগের মতো কট্টরপন্থা অবলম্বনকারী না?
পারে নি বলেই তাদের ভয়ে পালাচ্ছে আফগান নাগরিকেরা যারা তালেবানের কট্টর পন্থা পছন্দ করে না। যারা তাদের কঠোরতা কী রকম দেখেছেন অতীতে। তাদের নিয়ন্ত্রণে শ্বাসরুদ্ধকর জীবন যাপন করেছেন নারীরা।
যারা পালাচ্ছেন তারা মনে করে, তালেবান নিজেরা যা ঠিক মনে করে তা ছাড়া ভিন্নমতের অন্য কিছু ঠিক না। তাদের বিবেচনা এ রকম। ভিন্ন মত ভিন্ন পছন্দকে তারা সহ্য করতে পারেন না। সরিয়ে ফেলতে চান। এ কারণেই তালেবান নেতা ওয়াহিদুল্লাহ হাশিমি বলেছেন, আফগানিস্তানে গনতন্ত্র থাকবে না।
আমেরিকার কার্গো বিমানে এভাবে ঠাশাঠাশি চড়ে আফগান নাগরিক ও বিদেশিরা কাবুল ত্যাগ করে।
গণতন্ত্র থাকলে ভিন্ন মত পথ পছন্দের মানুষকে সম্মান দিতে হয়। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন এই বিশ্ব ও মহাবিশ্ব বৈচিত্রের আধার। এখানে আলো অন্ধকার একসাথে থাকে। এখানে বহু রঙ রূপের সম্মিলিত অবস্থান, যেখানে যার যার মহিমা তার তার, যার যার কর্মফল তার তার প্রাকৃতিকভাবেই অনেকটা নির্ধারিত।
পৃথিবীতে এমন কোনো দর্শন নেই, যে-দর্শন মানুষকে পৃথিবীতে স্বর্গসুখে রাখবে। পৃথিবী স্বর্গ না। এখানে পর্যায়ক্রমে সুখ ও দুখের স্বাদ নিতে হয়। নইলে জীবন অর্থবহ হয় না।
আমেরিকার কূটনীতিকরা যেদিন কাবুল ছেড়ে যায়।
সাংবাদিক সম্মেলেনে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ যা বললেন তাতে স্ববিরোধ রয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতা, পরিপক্কতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে বিশ বছর আগের তালেবানের সাথে আজকের তালেবানের বিশাল তফাত রয়েছে’। ‘বিশাল তফাৎ’ কি তারা কাবুল দখলে নেওয়ার পর হুট করে হয়ে গেল ম্যাজিকের মতো।
এই বিশাল তফাৎ আফগানিরা বুঝতে পারছেন না কেন যারা পালাচ্ছেন? বিদেশিরা কেন বিশ্বাস করছেন না তালেবানের কথা? পালাচ্ছেন তারা।
তালেবান মুখপাত্র বলেছেন, নারী অধিকার দিবেন তারা তাদের সাংস্কৃতিক চিন্তার অধীনে। তাহলে ভিন্ন সংস্কৃতির নারীরা কেমনে ওখানে থাকবেন? বৈষম্য তো থেকেই যাচ্ছে।
তালেবানের ভয়ে বিমানের উপরে চড়ে হলেও দেশ ছাড়তে চায় ওরা
আর তারা মিডিয়াকে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে দিবেন না। এ তো কট্টর অবস্থান। আবার বলছেন বেসরকারি মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। স্ববিরোধ নয় কি?
তালেবান আগে নারীকে ঘরবন্দী রাখতে বলতেন। এখন বলছেন বাইরে কাজ করতে দেবেন তারা। এটা অবশ্য ভারতের রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের চেয়ে একটু উন্নত অবস্থান। সেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগওয়াত পরিস্কার জানিয়েছেন, ‘নারী কেবল গৃহবধু’-ঘরের কাজ করবার মানুষ।
যদিও আফগানিস্তানের সাংবাদিক রেজওয়ান নাতিক মনে করেন, তালেবানের কোনো পরিবর্তন হয় নি। তিনি মনে করেন অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে না। ভবিষ্যতে খাদ্যাভাব দেখা দেবে দেশটিতে। আবার গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। এখনই দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্লোজ টু জিরো।
ওরা তাদের দেশ আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে
মূলত, একটা সুবিবেচিত মধ্যপন্থা অবলম্বন না করলে নানা সংস্কৃতির বৈচিত্রের সম্মিলন হয় কি পৃথিবীর কোথাও? যে কারণেই হোক তালেবান তাদের দেশ চালাতে হলে গ্লোবাল রাজনীতির হিসাব বুঝে চাল দিতে গিয়ে, অন্য দেশ অন্য সংস্কৃতির কর্তাদের সাথে হাত মিলিয়ে চলতে হবে। তখন তাদেরকে ‘কৌশল অবলম্বন’ বলে নিজেদের নীতি-আদর্শের উল্টা চলতে হবে।
চীন রাশিয়া ইরানের সাথে তারা কি আপোষ করছেন না?
তালেবান নেতা শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই ভারতের সাথে খাতির জমানোর কোশেশ করছেন কেন এখন? এতদিন তো কঠোর ভারত বিরোধী ছিলেন। মানে কী দাঁড়ালো?
ক্ষমতায় থাকবার জন্যে নিজেদের নীতি বিসর্জন দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা। এ চেষ্টার মানে কি সুবিধাবাদী হ্ওয়া বোঝায় না? তালেবান তাদের নিজের দেশে অন্য সংস্কৃতির মানুষকে একটুও স্বাধীনতা না দিলে অন্য সংস্কৃতির দেশের সাথে ‘সুসম্পর্ক’ কেমনে হবে?
বলখের রাজধানী মাজার-ই-শরীফের ঐতিহাসিক নীল মসজিদ
ওদিকে চীনকে পাশে পাওয়ার জন্যে তালেবান নেতা চীনকে কথা দিয়েছেন উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে তারা মাথা ঘামাবেন না। অর্থাৎ চীন ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন দর্শনের দেশ হলেও সমস্যা নাই। চীন অন্যতম সুপার পাওয়া বিশ্ব রাজনীতির। চীন যেভাবে খুশি থাকে সেভাবে কাজ করতে রাজি তালেবান।
স্ববিরোধগুলো স্পষ্ট নয় কি? এতে এটাও দেখা যায়, তালেবান বোঝাচ্ছে তারা শক্তের ভক্ত নরমের জম। তাহলে তারা আর আলাদা বিশেষ কিছু কি?
আরেকটি ব্যাপার,তালেবানরা আফগানিস্তানের মানুষ। সামগ্রিকভাবে আফগানদের মধ্যে গোষ্ঠীগত লড়াই হাজার বছর ধরে চলে আসছে। মাঝে মাঝে আপোষ করলেও, হাতে হাতে বন্দুক থাকা তাদের সংস্কৃতিতে বহু পুরোনো ব্যাপার। গোষ্ঠীগত বড়াই দেখাতে জঙ শুরু করে দেন তারা যেকোনো মুহূর্তে। তথাকথিত আদর্শের দোহাই দিয়ে নিজের দেশের মানুষ মেরে ফেলার ইতিহাস তালেবানদের আছে।
আফগানিস্তানের বলখ শহরে প্রবেশ তোরণ
উল্লেখ্য, বর্তমান তালেবান গোষ্ঠীর ভিতরেও বিভিন্ন নেতাকে ঘিরে আছে ভিন্ন ভিন্ন নেটওয়ার্ক। আনাস হাক্কানির প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’। যার সাথে ইতোমধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বৈঠকও করেছেন। দেশে অচলাবস্থা দেখা দিলে তালেবানের ভিতরেই মারামারি শুরু হয়ে যেতে পারে ফের। কিংবা বিশ্ব রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে দিশেহারা নেতারা মোড়লদের পাপেট হতে পারে।
সচেতন আফগানরা টুইট করছেন এই মর্মে যে, সামরিক জয় পেলেও তালেবানের দ্বারা দেশ চালানো অতো সহজ হবে না যত সহজে তারা সামরিক জয় পেয়েছে।
তত্বীয়ভাবে এখনও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। তিনি এখন আরব আমিরাতে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারীতে তিনি ভারতের আজমির শরিফে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি রহ: মাজারের জন্যে এই গিলাফটি পাঠিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তালেবান সৌদি শাসকদের দর্শনের কাছাকাছি। ওদিকে সৌদির সাথে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। সৌদি আরবের মাধ্যমে তালেবান শাসিত আফগানিস্তান কব্জায় রাখার চেষ্টা নিতেই পারে আমেরিকা। কারণ চীন রাশিয়া ইরান আফগানিস্তানের ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। এটা আমেরিকার জন্যে রাজনৈতিক পরাজয়।
উল্লেখ্য, সমগ্র আফগানিস্তানে রয়েছে ইসলামের সুফিধারার দরবেশদের মাজার। শুনতে বিস্ময়কর লাগলেও সত্য এই যে তালেবানদের মাঝেও সুফিধারার কিছু অনুসারী আছে যারা হত্যাকাণ্ডের পক্ষে না। কিন্তু ১৯৯৬-২০০১ সময়খণ্ডে তালেবান শাসকগোষ্ঠী যারা সৌদি শাসকগোষ্ঠীর দর্শনের অনুসারী, তারা অনেক আফগান সুফিদের উপর অত্যাচার করেছে। চিশতিয়া তরিকার কিছু সুফিকে মেরে ফেলেছেও। অর্থাৎ আফগানিস্তানে এ দুই দর্শন ধারার দ্বন্দও বিদ্যমান যুগ যুগ ধরে।
আফগান সুফি নেতা আহমদ শাহ মওদুদি বিবিসিকে বলেছিলেন ২০১১ সালে যে, তিনি বহু তালেবানকে নিরস্ত্র করে শান্তির পথে সহনশীল সুন্দর মানুষ হওয়ার পথে এনেছেন।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি রহ: এর আরামগাহ, কুনিয়া, তুরস্ক। তাঁর পূর্বপুরুষের বাড়ি আফগানিস্তানের বলখে।
বলা হয়, আফগানিস্তান সুফিদের বাড়ি। শত শত বছর ধরে সুফিধারা চর্চা হয়ে আসছে সেখানে। দেশটির বলখ রাজ্যে ছিল বিখ্যাত সুফি ওস্তাদ, আমেরিকার জনজীবনে সাংস্কৃতিক প্রভাব রেখেছেন যে সুফি, সেই মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির রহ: পৈত্রিক আবাস। মোঙ্গলদের অত্যাচারের আমলে রুমির বাবা স্বপরিবারে চলে গিয়েছিলেন তুরস্কের আনাতোলিয়ার কুনিয়ায়।
বর্তমান ক্ষমতাবান তালেবান নেতৃত্ব সৌদি শাসকদের দর্শনের অনুসারী হয়ে থাকেন যদি ষোলআনা, তাহলে তারা তাদের কট্টর অবস্থানের কারণে, যতই মুখে মিষ্টি কথা বলুক না কেন, গ্লোবাল রাজনীতির ক্রীড়নক হওয়া ছাড়া তাদের অন্য উপায় আছে কি? হয় চীন রাশিয়া, নয়তো আমেরিকা ব্লকের পাশে থাকতে হবে টিকে থাকতে হলে।