যে বিদেশী এই বাংলার নারী নদী ফসলের মাঠ ভালোবেসে রয়ে গেলেন এইখানে
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ আগস্ট ২০২১, ৩:২১:১৭ অপরাহ্ন
অনুপম ডেস্ক: সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছেন মার্কিন মুল্লুকের পেট্রোলিয়াম বিজ্ঞানী ক্রিস হোগল। বাঙালি নারীর প্রেমে পড়ে সুদূর আমেরিকার আয়েশী জীবন ফেলে চলে এসেছেন যশোরের কেশবপুরে। এই কেশবপুরের এক অতিসাধারণ গ্রাম্য মেয়ে রহিমা খাতুনকে বিয়ে করে আর ফিরে যাননি আমেরিকায়। কেশবপুরের অঁজপাড়াগায়ের গ্রাম মেহেরপুরে রহিমার পিত্রালয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস হোলগ। গড়ে তোলেন ছোট্ট কৃষি খামার। স্ত্রী রহিমাকে সঙ্গে নিয়ে সেই কৃষি খামারেই কাজ করে জীবন পার করছেন।
আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার ক্রিস হোগল ও বাঙালি নারী রহিমা খাতুন প্রেমের প্রায় একযুগ পার করে ঘর বেঁধেছেন কেশবপুরের মেহেরপুর গ্রামে। মুন্সি মেহেরুল্লার মাজারের পাশে তারা বাস করছেন।
ক্রিস হোগল নিজেকে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন পুরোপুরি।
কৃষি কাজ করেন পরম মমতা নিয়ে। নিজেই জমিতে ধান কাটেন, বোঝা টেনে নিয়ে ধান তোলেন ভ্যানে। এই কায়িক শ্রমে মার্কিন ইঞ্জিনিয়ারকে ক্লান্ত মনে হয় না।
শনিবার সরজমিনে কপোতাক্ষ নদের তীরে মেহেরপুর গ্রামে বিশাল বট গাছের কাছে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে মুন্সি মেহেরুল্লার মাজার। বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গল্প শুনছিলাম সেখানে আগে থেকে বসে থাকা স্থানীয় আশরাদ আলি মোড়লের কাছ থেকে। তাকে এলাকার সবাই ‘মোড়ল’ নামে জানে।
মোড়লের সঙ্গে কথা বলার সময় আমাদের পেছন থেকে এসে আধো উচ্চারণে সালাম দিলেন এক ব্যক্তি। ফিরে দেখি তিনি একজন বিদেশি শ্বেতাঙ্গ। শরীরে ট্যাটু আঁকা মানুষটি নিজে থেকে বললেন ‘তার নাম মো. আয়ূব।’
তাকে ইরেজিতে প্রশ্ন করলে তিনি নাম বলেন, ক্রিস হোগল। এর পর ত্রস্ত পায়ে তিনি নদীর তীরের দিকে গেলেন।
শিল্পী মোড়ল বললেন, বিদেশি মানুষটি এখানে বিয়ে করে অনেকদিন ধরে বসবাস করছেন। প্রায় ১০-১২ বিঘা ফসলি জমি ক্রয় করেছেন।
‘ক্রিস হোগল ধানক্ষেত থেকে ধান এনে ভ্যানে ওঠাচ্ছেন। তিনি ধানভর্তি ভ্যান ঠেলে নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর যখন তিনি আবার ফিরে আসেন তখন আমি ও মোড়ল ক্রিস হোগলের পথ আগলে দাঁড়ালাম।
তিনি থামলেন এবং আমাদের সময় দিলেন। তিনি বাংলায় দু’একটি বাক্য বলতে পারেন। বিশাল বটবৃক্ষের ছায়ায় মুন্সি মেহেরুল্লার মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে কথোপকথন শুরু হয়।
ক্রিস হোগল জানান, তার বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে, পেশায় তিনি পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার। রহিমা খাতুনের সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন তিনি ভারতের মুম্বাই শহরে থাকতেন। সেখানে তিনি অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ন্যাচারাল রিসোর্সেস লিমিটেড কোম্পানিতে পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন। মুম্বাই শহরেই ঘটনাক্রমে রহিমার সঙ্গে তার দেখা হয়।
রহিমা খাতুন জানান, তার জীবনের কাহিনী। তিনি বলেন, শৈশবে তার বাবা আবুল খাঁ ও মা নেছারুন নেছার হাত ধরে অভাবের তাড়নায় পাড়ি জমান ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। বাবা শ্রম বিক্রি করতেন। আর রহিমা সেই শৈশবে বারাসাতের বস্তিতে একা থাকতেন। তের চৌদ্দ বছর বয়সে বাবা তাকে বিয়ে দেন।
জমিও ক্রয় করেন সেখানে। রহিমা খাতুন তখন তিন সন্তানের জননী। কিন্তু অভাবের তাড়নায় তার স্বামী সেখানকার জমি বিক্রি করে দেন। রহিমা খাতুনকে একা ফেলে তার স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যান। রহিমা খাতুন চলে যান জীবিকার সন্ধানে মুম্বাই শহরে। শ্যামল বর্ণের রহিমা খাতুন আশ্রয় নেন পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তির বস্তির খুপরিতে।
রহিমা খাতুন দাবি করেন, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ের রাস্তায় পরিচয় হয় ক্রিস হোগলের সঙ্গে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন হোগল তার পানে।
হিন্দিতে দু এক লাইন কথা বলার পর তারা আবার দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন। লাভ এট ফার্স্ট সাইড- প্রথম দেখাতেই রহিমার প্রেমে পড়ে যান মার্কিন বিজ্ঞানি ক্রিস হোগল। ভালো লাগা থেকে ভালবাসা। প্রেম থেকে মেলামেশা। যা এক পর্যায়ে শারীরিক সম্পর্কে পৌঁছায়। এভাবে ছয় মাস পার হলে তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। মুম্বই শহরের স্থানীয় এক মসজিদের ইমামের কাছে তওবা করে কালিমা শাহাদৎ পড়ে মুসলমান হন ক্রিস হোগল। নাম ধারণ করেন মোঃ আয়ুব হোসেন। মুম্বই শহরের একটি নিকাহ নামা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তারা রেজিস্ট্রি কাবিননামা করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের তিন বছর পর কর্মসূত্রে ক্রিস হোগল স্ত্রী রহিমাকে নিয়ে চীনে যান। সেখানে পাঁচ বছর ছিলেন। এরপর তারা কেশবপুরের মেহেরপুর গ্রামে রহিমা খাতুনের বাবার ভিটায় ফিরে আসেন।
মেহেরপুরে ফিরে আসার মাস ছয়েক পর রহিমা খাতুনের বাবা আবুল খাঁ মারা যান। বাড়ির উঠানের পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়। মোজাইক পাথর দিয়ে প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ করে বাবার কবর সংরক্ষণ করেন রহিমা দম্পতি। রহিমার মা নেছারুন নেছা এখনও জীবিত। রহিমার প্রথম স্বামীর তিনটি সন্তান তাদের সঙ্গেই থাকে।
ক্রিস হোগলের শখ বই পড়া ও মোটরসাইকেলে দূর ভ্রমণ। বর্তমানে একটি সুন্দর পরিবার পেয়ে তারা সুখী।
ক্রিস হোগল বলেন, মিশিগান খুব সুন্দর শহর। আমেরিকান স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় অনেক আগে। সেখানে তার মা ও ছেলে মেয়ে রয়েছেন।
মেহেরপুরে আমেরিকান স্টাইলে একটি বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন ক্রিস হোগল দম্পতি। বাড়ির কাজ শেষ হলে আমেরিকা থেকে মা ও ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসবেন এখানে। বহুদেশ ঘুরেছেন ক্রিস। তবে বাংলার সবুজ প্রকৃতি, ধান ক্ষেত ও সরিষা ফুলের হলুদ রং তাকে বিমোহিত করে বারংবার। এই দেশে অনেক ভালো মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে।
৪ বছর একটানা মেহেরপুরে আছেন। বাকি জীবনটা এখানেই কাটাতে চান বাংলার প্রকৃতিকে ভালোবেসে। ক্রিস হোগল মহাকবি মাইকেল মধুসূদনকে চেনেন ও জানেন। তার কবিতা ক্রিস হোগলকে টানে। তাই সময় পেলেই তিনি মহাকবির জন্মভিটা কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়িতে যান। কবির জন্মভিটায় কিছুটা সময় নীরবে পার করেন। কবিকে স্মরণ করেন। কবির লেখা কবিতা গুলো পাঠ করেন।
এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য পোশাক কারখানা করাসহ আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কাজ করতে চান এই মার্কিন বিজ্ঞানী। এই জন্য তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চান।
রহিমা খাতুনের আগের স্বামীর ঘরের তিন সন্তান বিদেশী পিতাকে পেয়ে দারুন খুশি। তারা ক্রিস হোগলকে নিজেদের পিতার মতো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছেন। তারা পিতার আসনে বসিয়ে ক্রিস হোগলকে অভিভাবক মেনে তার আদেশ নিষেধ সব মেনে চলেন। রহিমার বড় ছেলে ইদ্রিস আলী বলেন, আমাদের পিতা আমার মা আর আমাদের তিন ভাইবোনকে ফেলে পালিয়ে যায়। আর একজন বিদেশী আমাদের মাকে বিয়ে করে আমাদের কে তার সন্তানের মর্যাদা দিয়ে বুকে টেনে নিয়েছেন। আমরা ক্রিস হোগলকে আমাদের জন্মদাতা পিতার চেয়েও বেশি সম্মান করি, ভালোবাসি। তিনি তার কর্মগুণে সেই আসন অলংকৃত করেছেন। তাকে পিতা হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত। তিনি আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একজন বাঙালির মতো কৃষি কাজ করেন। একজন পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার হয়েও আমার মায়ের মতো একজন সামান্য নারীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে তার সাথে সারাজীবন সংসার করার যে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তা বাঙালি সমাজে বিরল। আমরা আমাদের পিতা ক্রিস হোগলের জন্য গর্বিত। (মানব জমিনের সৌজন্যে, লিখেছেন নূর ইসলাম যশোর থেকে)