করোনাকালেও আয়া সোফিয়ায় ত্রিশ লাখ পর্যটক এবং ওসমানীয় সুলতান কনস্টান্টিনোপল জয়ের কারণ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ জুলাই ২০২১, ৮:৩২:২০ অপরাহ্ন
আয়া সোফিয়া মসজিদ
করোনাকালেও আয়া সোফিয়ায় ত্রিশ লাখ পর্যটক এবং ওসমানীয় সুলতান কনস্টান্টিনোপল জয়ের কারণ
:: সারওয়ার চৌধুরী ::
➡️ ২০২০ সালের ২৪ জুলাই তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের আয়া সোফিয়া গ্র্যান্ড মসজিদ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। গত দেড় বছর ধরে মহামারি সংক্রমণ রোধে বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের বিধি-নিষেধ চলছে। তবু গত এক বছরে এখানে ৩০ লাখ পর্যটক এসেছেন।
১৪৫৩ সালে ইস্তাম্বুল বিজয়ের আগ পর্যন্ত ৯১৬ বছর তা খ্রিস্টানদের গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরপর ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শ বছর তা মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এরপর ৮৬ বছর ঐতিহাসিক এ স্থাপনা জাদুঘর হিসেবে থাকে। অতঃপর ২০২০ সালে তা পুনরায় মসজিদের রূপে ফিরে যায়। মসজিদ হলেও তা সব ধর্ম ও বিশ্বাসের পর্যটকের জন্য উম্মুক্ত থাকে।
১০৯৫ থেকে ১৫৭১ সাল পর্যন্ত, (বৃটানিকা মোতাবেক) মধ্যযুগের এই সময়খণ্ডে ইউরোপের খৃষ্টানরা ধর্মযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষত পশ্চিম ইউরোপের ল্যাটিন চার্চের তরফ থেকে, তাদের ভাষায় ‘পবিত্রভূমি জেরুজালেম’ মুসলমানদের হাত থেকে উদ্ধার করার সংকল্প। এই কারণে তারা ক্রসেড করতে আদেশ পায় পোপের কাছ থেকে।
crusade শব্দটি ল্যাটিন crux থেকে, মানে cross, মানে যে যুদ্ধ ক্রস সাইনের অধীনে হয়। জেরুজালেম—মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছেও সম্মানিত স্থান। উভয় পক্ষের সাধারণ যোদ্ধারা এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ ছিলেন যে, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে যুদ্ধে নেমেছেন।
কনস্টান্টিনোপল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ায় এশিয়া মাইনরের দিকে তাদের সম্প্রসারণের হুমকি সব সময় ছিল। কারণ তাদের হলি ল্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছতে হলে এই ভূখণ্ড দখলে নিয়েই আগাতে হবে।
প্রথম ক্রুসেডে ১০৯৬-৯৯ ইউরোপের যৌথবাহিনী দখলে নেয় জেরুজালেম। পরে ১১৮৭ সালে কুর্দি সুন্নি মুসলিম বীর সালাহউদ্দীন আইয়ুবি জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। জেরুজালেম দখল ও হাতছাড়া হওয়ার ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনেও আসে মসজিদুল আকসা তথা জেরুজালেম নগরী। আবার বৃটিশের কাছে হাতছাড়া হয়।
ওসমানীয় সুলতানদেরকে বংশ পরম্পরায় ক্রুসেডারদের আগ্রাসন মোকাবেলা করতে হয়েছিল। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে কে কাকে দৌড়ের উপর রাখবে সে-চিন্তা হরদম করতে হয়েছিল।
সাধারণ পর্যায়ের ক্রুসেডারদের বিবেচনায় তুর্ক সেলজুক আরব মুসলিম শক্তি হলো বর্বর। মুসলমানরা নিজেদেরকে মনে করে শান্তিকামী। সাধারণ স্তরের মুসলমানরা ক্রুসেডারদেকে মনে করে নাপাক বর্বর। ফলে আক্রান্ত আর প্রতিরোধের যুদ্ধ চলতে থাকে। আগ্রাসন চালায় ক্রুসেডারেরা, প্রতিরোধ করে মুসলমানেরা। আবার আগ্রাসী শক্তিকে দুর্বল করার জন্যে পাল্টা আগ্রাসন চলতে থাকে।
কনস্টান্টিনোপল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী হওয়ায় এশিয়া মাইনরের দিকে তাদের সম্প্রসারণের হুমকি সব সময় ছিল। কারণ তাদের হলি ল্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছতে হলে এই ভূখণ্ড দখলে নিয়েই আগাতে হবে। ৫৫০ সালে ভূমধ্যসাগরের চৌদিক বাইজেন্টাইনের হাতে ছিল। ওসমানীয় সুলতান মুরাদ ২য় কনস্টান্টিনোপল ঘিরে ফেলেছিলেন কিন্তু বাইজেন্টাইন রাজার শক্তির সামনে দাঁড়াতে পারেন নি, পিছিয়ে আসতে হয়। পরে এই মুরাদের ছেলে মুহাম্মদ আল ফাতিহ প্রিন্স থাকতেই কনস্টান্টিনোপল দখলের পরিকল্পনা করেন।
পরে দফায় দফায় অভিযান চালিয়ে ৫৫ দিন (সূত্র: বৃটানিকা) কনস্টান্টিনোপল অবরুদ্ধ রাখেন সুলতান মুহাম্মদ। এক সময়ের পরাক্রমশালী এই রাজধানীতে জড়ো হওয়া বাইজেন্টাইন যোদ্ধাদের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলো। ভেঙ্গে পড়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা। সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল প্রবেশ করে প্রথমেই আয়াসোফিয়ার গম্বুজে উঠে রোমান শক্তির ঐতিহাসিক রাজধানী শহরটিকে এক নজর দেখে নেন।
উল্লেখ্য, ২৭ খৃষ্টপূর্ব অব্দ থেকে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী ডি ফ্যাক্টো ও ডি জ্যুর মিলে ৪৭৬ সাল পর্যন্ত রোমে ধরা হয়। মুলতঃ ৪০২ সাল থেকে রাভেনা শহর থেকে রাজকার্য পরিচালিত হতো। ৪৭৬ সালে কম বয়সের ইতালির রাজা রোমুলুস অগাস্টুলুসকে ক্ষমতাচ্যুত করেন গোথ বংশোদ্ভূত ফ্লেভিয়াস ওডোয়াসের তখনের কনস্টান্টিনোপলের প্রাসাদে থাকা বাইজেন্টাইন রাজার ইশারায়। অগাস্টুলুস রাজা হওয়ার আরেক ইতিহাস এই যে, তার পিতা ছিল পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের একজন বিদ্রোহী জেনারেল। অগাস্টুলুস প্রায় নয় মাস রাজা ছিল।
ফ্লেভিয়াসের হাতে অগাস্টুলুস ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মধ্য দিয়ে পুরোপুরি পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়।
পূর্বের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল হওয়ায় এটি হয় তখনের দুনিয়ার পরাক্রমশালী রাজধানী। এরিমধ্যে কয়েক শ বছর চলতে থাকে পূর্ব ও পশ্চিমের খৃষ্টানদের ধর্মীয় বিভেদ—আইকনোক্লাজম বা মূর্তি ভাঙ্গা নিয়ে।
বাইজেন্টাইন রাজা ৩য় লিও আইকনোক্লাস্ট ধারনার প্রবর্তন করলেন যে, কোনো মূর্তি/প্রতিমা সামনে নিয়ে বন্দেগী করার দরকার নেই। যারা ডিভাইন হয়ে গেছেন, তাদের ইমেজ রাখা অর্থহীন। তার মতে, বর্তমান জীবিত রাজা খোদার প্রতিনিধি হয়ে আছেন।
৭১৭ সাল থেকে ৭৪১ সময়খণ্ডে রাজা লিও রাজত্ব করেন। তার আমলে রাজ্যে অসন্তোষ প্রবল হয়। এই সময় গ্রিসে বিদ্রোহ হয়। কারণ এ রাজা তার বিশ্বাস জোরপূর্বক রাজ্যে বাস্তবায়ন করেন।
রাজ্যের ইহুদিদেরকে বল প্রয়োগ করে খৃষ্ট ধর্মে নিয়ে যায়। আয়াসোফিয়ার খৃষ্টীয় মোজাইক আইকনগুলো তারাই বিকৃত করেছিল।
এখন ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া মসজিদে নামাজ হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সব ধর্মের লোক এটি দেখতে ভিতরে যেতে পারে।
সারওয়ার চৌধুরী: কবি, কলামিস্ট, অনুবাদক, নির্বাহী সম্পাদক: অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর