’৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতির দাবিতে জেনেভায় নির্মূল কমিটির সমাবেশ
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুলাই ২০২১, ৮:২৯:০৭ অপরাহ্ন
আনসার আমেদ উল্লাহ: জেনেভায় জাতিসংঘের ইউরোপীয় সদর দফতরের সামনে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র কেন্দ্র ও সর্ব ইউরোপীয় শাখার সহযোগিতায় সুইজারল্যান্ডের নির্মূল কমিটি বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী মায়ানমারে গণহত্যার শিকার ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর দ্রুত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে।
৭ জুলাই নির্মূল কমিটির সর্ব ইউরোপীয় শাখার সভাপতি তরুণকান্তি চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সুইজারল্যান্ড শাখার সভাপতি খলিলুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় আইটি সেলের সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়ের সঞ্চালনায় এই সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। সমাবেশে কায়িকভাবে উপস্থিত থেকে এবং ভার্চুয়ালি বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্রিটিশ মানবাধিকার নেতা জুলিয়ান ফ্রান্সিস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী সমাজকর্মী আরমা দত্ত এমপি, অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির এমপি লরি ফার্গুসন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, খেমার রুজ ট্রায়ালের কম্বোডিয়ান টাস্ক ফোর্সের উপদেষ্টা গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ড. হেলেন জার্ভিস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলিম চৌধুরীর কন্যা অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী, ভারতের লেখক সাংবাদিক হিরন্ময় কার্লেকার, টার্কিশ পেন-এর সাবেক সভাপতি কবি ও নাট্যকার তারিক গুনারসেল, ভারতের জহওরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় কুমার ভরদ্বাজ, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ইরানের মানবাধিকার নেতা বানাফশে যাদ, পোল্যান্ডের মানবাধিকার কর্মী নাটালিয়া সিনায়েভা পাঙ্কোভস্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডিকাল বিজ্ঞানী ড. জেফ মুডি, যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার নেতা ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিজম তুরস্ক-এর সভাপতি লেখক চলচ্চিত্রনির্মাতা ফেরহাত আতিক, ফোরাম ফর সেক্যুলার ইজিপ্ট এ্যান্ড মিডল ইস্ট-এর সভাপতি মানবাধিকার নেতা সাংবাদিক মহসিন আরিশি, সুইজারল্যান্ডের আর্থ ফোকাস ফাউন্ডেশন-এর সহসভাপতি নিকোলাস ফুরে, যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত বেলুচ বুদ্ধিজীবী ড. নাসির দাস্তি, ওয়ার্ল্ড সিন্ধি কংগ্রেস-এর সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা ড. লাকু লুহানা, সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত বেলুচ মানবাধিকার নেতা মুনির মেঙ্গল, যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত সিন্ধি মানবাধিকার নেতা ডঃ সাগর শেখ, ভারতের ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক প্রিয়জিৎ দেব সরকার, ইংল্যান্ডের মানবাধিকার নেতা ভাল হার্ডিং, পাকিস্তানের মানবাধিকার নেতা তাহিরা আবদুল্লাহ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার নেতা আরিয়াদাসা বিদ্যাসেকারা, যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত পাকিস্তানি মানবাধিকার নেতা আরিফ আজাকিয়া, আফগান ছাত্র নেতা সৈয়দ মশিউল্লাহ হাশিমি, গণহত্যার ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনি লেখক আহমেদ শাফি, তুরস্কে আশ্রয়গ্রহণকারী উইগুর গণহত্যার ভুক্তভোগী সাবো কসিমোভা, লাইবেরিয়ার ছাত্র নেতা আবু এস. কামারা, নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ড. নুরন নবী, সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি এম নজরুল ইসলাম, সর্ব ইউরোপীয় নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা আনসার আহমদ উল্লাহ, শিশু অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ কমিটির সদস্য ফয়সাল হাসান তানভীর, নির্মূল কমিটির বহুভাষিক সাময়িকী জাগরণের হিন্দি বিভাগের সম্পাদক ভারতের তাপস দাস, নির্মূল কমিটির সুইডেন শাখার সভাপতি মানবাধিকার নেতা আখতার এম জামান, নির্মূল কমিটির ফিনল্যান্ড শাখার সভাপতি ড. মুজিবুর দফতরি, বেলজিয়াম নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেত্রী আনার চৌধুরী, নির্মূল কমিটির যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ড শাখার নেতা মানবাধিকারকর্মী মাহফুজ রহমান, নির্মূল কমিটির অস্ট্রেলিয়া শাখার সভাপতি সমাজকর্মী একরাম চৌধুরী, নরওয়ে নির্মূল কমিটির সভাপতি কবি খোরশেদ আহমেদ, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর সেকুলার হিউম্যানিজম তুরস্কের সাধারণ সম্পাদক লেখক চলচ্চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি সহ ওয়ার্ল্ড সিন্ধি কংগ্রেস, বেলুচ ভয়েস, সুইজারল্যান্ডের আর্থ ফোকাস ফাউন্ডেশন, সর্ব ইউরোপীয় আওয়ামী লীগ, সর্ব ইউরোপীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগ, আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন সুইজারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড বঙ্গবন্ধু পরিষদ, নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, সুইডেন, নরওয়ে, ফ্রিনল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ড ও বোস্টন, তুরস্ক, মিশর, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া শাখার নেতৃবৃন্দ।
জেনেভা সময় বেলা বারটায় আরম্ভ হয়ে ছয় ঘন্টা দীর্ঘ এ সমাবেশে পাঁচটি মহাদেশের ২৩টি দেশের মানবাধিকার নেতা, বুদ্ধিজীবী, আইনপ্রণেতা, গণহত্যার ভিকটিম এবং নির্মূল কমিটির বিভিন্ন শাখার নেতাকর্মীরা সশরীরে এবং ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
সমাবেশ শেষে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাই কমিশনারকে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহরিয়ার কবির, সর্ব ইউরোপীয় শাখার সভাপতি তরুণকান্তি চৌধুরী ও সুইজারল্যান্ড শাখার সভাপতি খলিলুর রহমানের স্বাক্ষরকৃত স্মারকপত্র প্রদান করা হয়। অনলাইনে স্মারকপত্র পাঠ করেন নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ।
উদ্বোধনী ভাষণে নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের গণহত্যার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘১৯৭১ সালের গণহত্যার অপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করা হয়েছিল। চলমান বিচার কার্যক্রম নতুন প্রজন্মের মধ্যে পাকিস্তানি দখলদার সেনা এবং এদের দোসরদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করেছে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ এবং নির্মূল কমিটির বৈদেশিক শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি জন্য প্রচার চালাচ্ছে কেন, না এখনও গণহত্যাকারীরা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়। যদিও পাকিস্তানের বিবেকবান নাগরিকরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের চলমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন এবং ১৯৭১ সালে তাদের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছেন, কিন্তু পাকিস্তানি সরকার এখনও ক্ষমা চায়নি এবং তারা এখনও সত্যটি মেনে নিতে পারেনি। তদুপরি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাকিস্তানের বালুচ ও সিন্ধি জাতিসমূহের বিরুদ্ধেও গণহত্যার পুনরাবৃত্তি করছে। গণহত্যাকারীদের যদি শাস্তি না হয় তাহলে বারবার এ ধরনের জঘন্য অপরাধের পুনরাবৃত্তি হবে। যেমনটি মিয়ানমার, পাকিস্তান, মধ্য প্রাচ্য, আফ্রিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে আজও দেখতে পাচ্ছি।
‘২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার ১১ লক্ষেরও অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। আজকের সমাবেশ থেকে আমরা জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সরকার ও গোষ্ঠী দ্বারা সংঘটিত সমস্ত গণহত্যার নিন্দা জানানোর জন্য। রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য শরণার্থীদের তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য জাতিসংঘকে দৃঢ়তার সাথে কাজ করতে হবে।
‘২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ৯ই ডিসেম্বরকে ‘গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের স্মরণ ও সম্মানের দিবস এবং গণহত্যা অপরাধ প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই প্রস্তাব গ্রহণকালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সদস্য দেশসমূহের জনগণকে গণহত্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে, যাতে গণহত্যা রোধ করা যায়। সুতরাং, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে গণহত্যা প্রতিরোধে এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদানে আরও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা মৈত্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্রিটিশ মানবাধিকার নেতা জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, ‘যিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রত্যক্ষ করেছেন তার পক্ষে এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং মেনে নেয়া কঠিন যে, এখনও অনেকেই বাংলাদেশের গণহত্যা অস্বীকার করে। আমার এখনো স্মরণ আছে কিভাবে বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থীরা ভারতের নয়শোটির বেশি শরণার্থী শিবিরে আতঙ্কিত অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। নারী-পুরুষ-শিশু বৃদ্ধ সকলেই নৃশংসতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেননা তাদের সামনে হত্যা করা হয়েছিল তাদের প্রিয়জনদের।’
রোহিঙ্গা গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে জাতিসংঘকে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়ে জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে অবহেলা করেছে এবং এখন কিছু দেশ আলোচনায় বাধা দিচ্ছে। এখন এটি আরও অনিশ্চিত হয়ে গেছে কারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কোভিড-১৯ মহামারীর দিকে। আরও আগেই মিয়ানমারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত ছিল। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সাথে আলোচনায় খুবই নম্র হয়ে কথা বলছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘে ইউএনএইচআরসি-এর অসন্তোষজনক ভোটাভুটিতে চীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সমাধানের বিরোধিতা করেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের উপর আরো কড়া বিধি নিষেধ আরোপ করতে হবে যেন মিয়ানমার দ্রুত কোফি আনান রিপোর্টের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হয়।’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী সমাজকর্মী আরমা দত্ত এমপি বলেন, ‘আমি একজন শহীদ পরিবারের সন্তান। আমার পিতামহ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার শিকার। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় বেছে বেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করত। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের অধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরে তা ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসে। জাতিসংঘের গণহত্যার কনভেনশন অনুযায়ী ‘গণহত্যা’-এর চেয়ে বড় নিদর্শন আর কি হতে পারে? একজন ভুক্তভোগী হিসেবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট আমি গণহত্যা স্বীকৃতি চাই এবং জাতিসংঘ যেন এ ব্যাপারে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাতে বাংলাদেশের মতো আর কোথাও এমন নৃশংস গণহত্যা না ঘটে।’
অস্ট্রেলিয়ান লেবার পার্টির এমপি লরি ফার্গুসন বলেন, ‘হিটলার বাহিনী যেমন ইহুদিদের বেছে বেছে হত্যা করেছিল ঠিক তেমনভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, গায়কসহ বাংলাদেশের তৎকালীন প্রথিতযশা প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার মানুষজনকে বেছে বেছে হত্যা করে। সরকারি হিসেবে ২ লক্ষ (বেসরকারি হিসাবে ৫ লক্ষাধিক) নারীকে তারা নির্যাতন করে যা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনাগুলোর একটি।’
খেমার রুজ ট্রায়ালের কম্বোডিয়ান টাস্ক ফোর্সের উপদেষ্টা গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ড. হেলেন জার্ভিস সমাবেশের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ গণহত্যার নথিপত্র ও আলামত সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি বিভিন্ন দেশে গণহত্যার বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করেছি। কম্বোডিয়াসহ আরো অনেক দেশের সম্প্রদায়ের উপর চালানো গণহত্যাকে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই প্রত্যাশা নিয়ে আমি আজকে আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করছি। জাতিসংঘকে অবশ্যই ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া গণহত্যার স্বীকৃতি দিতেই হবে কেননা এর প্রভাব সরাসরি এখন বাংলাদেশের উপর পড়েছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী গণহত্যার শিকার হয়ে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নিশ্চিত করার বদলে তাদের ভোটাধিকার ও নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদেরকে হত্যা, নির্যাতন, গুম, খুন করে দেশ থেকে বিতাড়ন করছে ঠিক যেমনটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ’৭১ সালে ও তার পূর্ববর্তী বছরগুলোতে বাঙালি জাতির সঙ্গে করে এসেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখনও তাদের দেশে একই কায়দায় গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।’
ভারতের লেখক সাংবাদিক হিরন্ময় কার্লেকার বলেন, ‘সাংবাদিক হিসাবে আমি ’৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কভার করার সময় স্বচক্ষে যদি পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা প্রত্যক্ষ না করতাম তাহলে কখনোই হয়তো এ বীভৎসতার কথা বিশ্বাস করতাম না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ সংঘঠিত করেছিল তা ক্ষমার অযোগ্য।
‘বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি দোসরদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সাজা দিতে পারলেও তাদের নির্দেশদাতাদের এখনও বিচারের মুখোমুখি করতে পারে নি। তারা যে বীভৎস গণহত্যা সংঘটিত করেছে তার জন্য অবশ্যই শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ইরানের মানবাধিকার নেত্রী বানাফশে যাদ ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশীদের পাশে দাঁড়িয়েছি, যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ত্রিশ লক্ষ নিরীহ বাঙালিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা জাতিসংঘকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বর্বরোচিত গণহত্যা, গণহত্যা সংক্রান্ত সমস্ত অপরাধ এবং তাদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংস ও স্বৈরাচারী শাসনামলের সকল হত্যার আনুষ্ঠানিকভাবে নিন্দা জানানোর আহ্বান জানাই।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডিকাল বিজ্ঞানী ড. জেফ মুডি বলেন, ‘আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস থেকে আমি আজকের সভায় বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট বাংলাদেশের একজন হয়ে ১৯৭১ সালের গণহত্যা স্বীকৃতি চাইছি। একই সঙ্গে জাতিসংঘকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাব যেন বাংলাদেশের গণহত্যা মতো বর্বরোচিত গণহত্যা না ভবিষ্যতে আর না সংঘটিত হয়।’
যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার নেতা ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন বলেন, ‘বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতি এখন পর্যন্ত না পাওয়াটা এদেশের উত্তরাধিকারীদের জন্য লজ্জার। আমরা পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে অবগত আছি। সেই ভয়াবহতার বহু ভুক্তভোগী আজও শরীরে সেই নৃশংসতার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। এখন শুধু দরকার বৈশ্বিক স্বীকৃতি। এজন্য বিশ্ব সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘকে এগিয়ে আসতে হবে। গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ বলে ‘নেভার এগেইন’। সত্যিই কি তারা এটি চায়?
‘ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের জন্য নিরাপদ ভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন তারা নিজেদের দেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতি চায়। সুতরাং বিশ্বসম্প্রদায়ের উচিত এখনই বাংলাদেশের সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোর।’
ফোরাম ফর সেক্যুলার ইজিপ্ট এ্যান্ড মিডল ইস্ট-এর সভাপতি মানবাধিকার নেতা সাংবাদিক মহসিন আরিশি বলেন, ‘আরবের দেশগুলোতে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠী- যারা ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী হত্যাকে বৈধতা দেয়, তাদের কারণে মানুষের রক্ত ঝরছে। ঠিক একই ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের গণহত্যায় জামায়াতে ইসলামী ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলগুলো প্রত্যক্ষ জড়িত ছিল। তারা এমনকি মসজিদে সেজদারত মুসল্লিদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। মুসলিম দেশগুলো এবং ওআইসির মতো আন্তর্জাতিক ইসলামী সংগঠনগুলো যদি ৫০ বছর পূর্বে বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য উদ্যোগী হতো, তাহলে আরব ও আমার এই অঞ্চলের মানুষ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা রক্তপাত থেকে রেহাই পেত। মুসলিম দেশগুলোর এজন্য ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গঠন করা জরুরি, যেখানে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের স্থান নেই।
যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত বেলুচ বুদ্ধিজীবী ড. নাসির দাস্তি বলেন, ‘১৯৭১ সালে যারা বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল তারাই আজকে বেলুচিস্তানে গণহত্যা পরিচালনা করছেন। গণহত্যার ক্রীড়ানক যারা, তাদের ধমণিতে বইছে মানুষ হত্যার বংশীয় খুন। পাক সেনাবাহিনী ঔপনিবেশিক আমল থেকেই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেই সমস্ত অফিসারদের দ্বারাই পরিচালিত হয় যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আমল থেকেই বংশীয় ভাবে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীতে কর্মরত। সে সমস্ত সেনাবাহিনীর পূর্বপুরুষরা ১৮৪৩ সালে সিন্ধিতে ছয় হাজারের বেশি মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে, পলাশীর প্রান্তরে লর্ড ক্লাইভের হয়ে ৫০ হাজারের অধিক বাঙালির তাজা রক্তে রঞ্জিত করে তাদের হাত। এমনকি ১৯৭০ সালে জর্ডানে ৩ হাজার ফিলিস্তিনিকে নির্মমভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। ’৭১ সালে বাংলাদেশে আর বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব অঞ্চলে তাদের হত্যাযজ্ঞ চলমান।
‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মানুষের রক্ত পান করার নেশা বহু পুরনো। মাছ চোর বিড়াল সদৃশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গলায় এবার ঘন্টি বাঁধতে হবে। সময় এসেছে তাদের দৌরাত্ম্য থামানোর। তাদের পরিকল্পনা আরও সুদূরপ্রসারি- পারমাণবিক অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে শাসন করা। তাদেরকে এবার থামাতেই হবে।’
ওয়ার্ল্ড সিন্ধি কংগ্রেস-এর সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা ড. লাকু লুহানা বলেন, ‘আমি সিন্ধু জনগণের পক্ষ থেকে নির্মূল কমিটির সঙ্গে বাঙালি সম্প্রদায়ের ভাই বোনের উপর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল- বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিকট তার স্বীকৃতি চাওয়ার জন্য একান্ত ভাবে আজকের সমাবেশে একাত্মতা পোষণ করছি। গণহত্যার বিচার ও স্বীকৃতি খুবই জরুরী একটি বিষয়। ১৯৭১ এর গণহত্যার বিচার না হওয়ায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখন সিন্ধু, বালুচ ও পশতুন সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যা চালাচ্ছে। আমরা আর গণহত্যা দেখতে চাই না।’
পাকিস্তানের মানবাধিকার নেতা তাহিরা আবদুল্লাহ বলেন, ‘১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার জন্য জেনারেল পারভেজ মুশারফ বাংলাদেশে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু আমি চাই- পাকিস্তান যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের কাছে নিঃস্বার্থ ক্ষমা চায়। অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশ করা এবং নিঃস্বার্থভাবে ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে অপরাধ সংঘটিত করেছে সে অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তবু জাতি হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা মোচনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের নিকট পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
গণহত্যার ভুক্তভোগী ফিলিস্তিনি লেখক আহমেদ শাফি বলেন, ‘সবাইকে শুভেচ্ছা, আমি আহমেদ সাফি, একজন ফিলিস্তিনি। আমি ফিলিস্তিন স্কার্ফ ও বাংলাদেশের পাঞ্জাবি পরে আজকের এই সমাবেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য একাত্মতা প্রকাশ করতে এসেছি।
আহমেদ শাফি এরপর ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল ইসরাইলি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত দেয়ার ইয়াসসেন-এর গণহত্যা বর্ণনা দেন, যেখানে কমপক্ষে ১০০ জন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ ও শিশুকে ইসরাইলি বাহিনী হত্যা করেছিল। ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ইসরাইলি সরকার গণহত্যার বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করে আসছে। আমি আজ জাতিসংঘকে অনুরোধ জানাব কর্তৃপক্ষ যেন গণহত্যাকারীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের গণহত্যাসহ পৃথিবীর সমস্ত গণহত্যার স্বীকৃতি দাবি করি। নতুন প্রজন্মের জন্য যেন আমরা এক বাসযোগ্য উন্নত বিশ্ব রেখে যেতে পারি।’
তুরস্কে আশ্রয়গ্রহণকারী উইগুর গণহত্যার ভুক্তভোগী সাবো কসিমোভা সমাবেশের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যা অত্যন্ত নির্মম ছিল। গণহত্যায় ৩০ লক্ষাধিক মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরদের অবশ্যই বিচার করতে হবে।
‘আমার সম্প্রদায়ও গণহত্যার স্বীকৃতি এবং ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে নৃশংস চীনই সুপার পাওয়ার। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী চীন জাতিসংঘের ভেটো প্রদানকারী ক্ষমতাধর একটি দেশ।
‘সমস্ত সম্প্রদায়ের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। জাতিসংঘের কনভেনশনে নিবন্ধিত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের দুটি ধারায় স্পষ্টভাবে এর উল্লেখ করা হয়েছে। চীন সরকার এগুলো সমস্তই লংঘন করেছে। আমি জাতিসংঘ এবং সমস্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানাবো, গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে মানবতার পক্ষে দাঁড়ান।’
লাইবেরিয়ার ছাত্র নেতা আবু এস. কামারা বলেন, ‘আমরা যেন আফ্রিকায় সংঘটিত হওয়া বিভিন্ন গণহত্যার কথা, বিশেষ করে রুয়ান্ডায় ঘটে যাওয়া অন্যতম বৃহৎ গণহত্যার কথা যেন ভুলে না যাই। বিশ্বের কোন না কোন প্রান্তে গণহত্যা ঘটেই চলেছে এবং এর প্রতিরোধে আমাদের আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে বিশেষ করে জাতিসংঘকে। গণহত্যার স্বীকৃতি অবশ্যই আমাদেরকে সচেতন ও দায়িত্বশীল করে তুলবে। যারা গণহত্যা সংঘটিত করে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা গেলে পরবর্তীতে কেউ আর এমন নৃশংস কাজ করার সাহস পাবে না।’