একজন গোয়েন্দা প্রধান যার শত শত পাসপোর্ট ছিল, তার সফল গোপন অভিযানগুলো..
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১২ জুন ২০২১, ১:০৩:৩৩ অপরাহ্ন
ইরানে ওই অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে তাদের দুই বছর লেগেছে। সেখানে ২০ জন মোসাদ এজেন্ট অংশ নিয়েছিলেন, যাদের একজনও ইসরাইলি নাগরিক নন। তেল আবিবের একটি কমান্ড সেন্টার থেকে ওই অভিযানে নজরদারি করেন মোসাদ প্রধান।
অনুপম নিউজ ডেস্ক: গুপ্তচর গোপনে কাজটি করে। মানুষ ঘটনা দেখবে, কে বা কারা ঘটালো জানা যাবে না। তাই বলা হয় Espionage by definition is intended to occur without detection, ব্যাপার তা-ই। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কীভাবে ইরানে গোপন অভিযান পরিচালনা করে আসছে, তার লোমহর্ষক বর্ণনা তুলে ধরেছেন মোসাদ প্রধানের দায়িত্ব থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া ইয়োসি কোহেন। ইরানের পরমাণু আর্কাইভ থেকে কীভাবে নথিপত্র চুরি করা হয়েছিল, সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তারও বিস্তারিত তুলে ধরেছেন ইয়োসি কোহেন।
২০১৮ সালে আর্কাইভে ওই অভিযান চালিয়ে হাজার হাজার নথিপত্র চুরি করে ইসরাইল নিয়ে আসা হয়। তিনি আরও ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরানের পরমাণু স্থাপনা নাতাঞ্জে যে ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছিল এবং ইরানের একজন পরমাণু বিজ্ঞানীর হত্যার পেছনেও ইসরাইলি সম্পৃক্ততা রয়েছে।
মোসাদ প্রধানের দায়িত্ব থেকে গত সপ্তাহে অবসরে যান কোহেন। ইসরাইলি চ্যানেল ১২-এর সাংবাদিক ইলানা ডায়ানকে তিনি এই সাক্ষাৎকারটি দেন, যা ইসরাইলে বৃহস্পতিবার রাতে প্রচারিত হয়।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোসাদের সাবেক প্রধানদের সাক্ষাৎকার দেওয়া বা নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছে বক্তব্য দেওয়া নতুন নয়। কিন্তু ইয়োসি কোহেন এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা বিস্ময়কর। তিনিই প্রথম স্বীকার করার কাছাকাছি গেছেন যে, ইরানের ভূগর্ভস্থ পরমাণু কেন্দ্রে নাশকতার পেছনে ইসরাইল জড়িত।
তবে অনেক হিসাবনিকাশ করে সাক্ষাৎকারটি দেওয়া হয়েছে এবং সেটি ইসরাইলের সামরিক সেন্সর পার হয়ে এসেছে।
২০১৫ সালে মোসাদের প্রধান হিসেবে ইয়োসি কোহেনকে নিয়োগ দেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পড়াশোনা শেষে ১৯৮২ সালে তিনি এই গোয়েন্দা সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন, এই পেশায় থাকার সময় তার শত শত পাসপোর্ট ছিল।
কোহেনের সাক্ষাৎকারের সবচেয়ে লোমহর্ষক অংশ ছিল, যখন তিনি ইরানের পরমাণু আর্কাইভ থেকে চুরির বিস্তারিত জানাতে শুরু করেন।
২০১৮ সালে একটি সংবাদ সম্মেলনে চুরি যাওয়া এসব নথির কথা উল্লেখ করে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছিলেন যে, ইরান একবার গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করেছে এবং অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি তাদের আছে। কিন্তু ইরান বরাবরই সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সাক্ষাৎকারে কোহেন বলেন, ইরানে ওই অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে তাদের দুই বছর লেগেছে। সেখানে ২০ জন মোসাদ এজেন্ট অংশ নিয়েছিলেন, যাদের একজনও ইসরাইলি নাগরিক নন। তেল আবিবের একটি কমান্ড সেন্টার থেকে ওই অভিযানে নজরদারি করেন মোসাদ প্রধান। এজেন্টরা ওয়্যারহাউজের ভেতরে প্রবেশ করে ৩০টির বেশি সিন্দুক ভাঙ্গে।
কোহেনের উদ্বৃতি দিয়ে ইসরায়েলি সংবাদপত্র দ্য টাইমস অব ইসরাইল-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যখন সেসব নথিপত্রের ছবি স্ক্রিনে দেখানো হয়, তা ছিল আমাদের জন্য দারুণ রোমাঞ্চকর।’
ওই অভিযানে অংশ নেওয়া সবাই বেঁচে ফিরে এসেছেন এবং ভালো আছেন, যদিও তাদের কয়েকজনকে ইরান থেকে বের করে আনা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এই হাজার হাজার নথিপত্র পাওয়ার কথা ইসরাইল প্রকাশ্যেই বলে আসছে। কিন্তু কোহেন আরও কিছু অভিযানে মোসাদের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলি এজেন্টরা করেছে বলে গুঞ্জন ছিল।
সাক্ষাৎকারের শুরুর দিকে ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের বিষয়ে বলেন কোহেন।
ইরান জানিয়েছিল, ২০২০ সালের জুলাই মাসের ওই নাশকতার ঘটনায় নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অংশে আগুন লাগে। এই বছরের এপ্রিল মাসে নতুন সরঞ্জাম সংযোজনের পরদিনই কর্মকর্তারা জানান, সেখানে আবার নাশকতার ঘটনা ঘটেছে এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেসব ঘটনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘পরমাণু সন্ত্রাসের’ অভিযোগ আনে ইরান।
মিজ ডায়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কোহেন বলেন, তিনি ওই পরমাণু স্থাপনা সম্পর্কে এত ভালোভাবে জানেন যে, যেখানে ঘূর্ণায়মান সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে, সেখানেও তাকে তিনি নিয়ে যেতে পারবেন।
সাক্ষাৎকারে তিনি ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মহসেন ফাখরিজাদকে নিয়েও কথা বলেন, যিনি গত নভেম্বরে তেহরানের উপকণ্ঠে একটি সড়কে গুপ্তঘাতকের হামলায় নিহত হন। ওই হামলার জন্য প্রকাশ্যেই ইসরাইলকে দায়ী করে আসছে ইরান।
ওই মৃত্যুর সঙ্গে মোসাদের সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার বা অস্বীকার করেননি গোয়েন্দা সংস্থাটির সাবেক প্রধান। কিন্তু তিনি বলেছেন, ওই বিজ্ঞানীকে বহু বছর ধরে ‘টার্গেট’ করা হয়েছিল, কারণ তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মোসাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছিল।
কোহেনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইসরাইলি নাগরিকদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে ওঠেন, তাহলে তাকে অবশ্যই থামতে হবে। তবে কেউ যদি পেশা পরিবর্তন করে বা আর ক্ষতি না করে, তাহলে তিনি বেঁচে যেতে পারেন।’
এই সাক্ষাৎকার এমন সময়ে দেওয়া হলো যখন ইরানের পরমাণু চুক্তির পুনর্জীবন নিয়ে আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে।