কাঠ-কয়লার আগুন
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ১২ মে ২০২১, ১:১৫:৫০ অপরাহ্ন
কাঠ-কয়লার আগুন :: শেখ লুৎফর
উত্তরের হলহলা বাতাস এট্টু এট্টু হিম আর ধানের মিঠা গন্ধ নিয়ে এলে তার ভেতরটা টলে ওঠে। আর সে যেন বিজলির চমকের মতো এক পলকে নিজের সারাটা চাষা-জিন্দিগী দেখে ফেলে। দুনিয়াদারির মতিগতি তার আর জানার কিছু বাকি নাই।
➡️ মানুষটা মাঝে মাঝে নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করে, জীবনের আরেক নাম কী দুঃখ? হ, অনুমান করি সে এইরকমই বুঝে। তাই যখন ল্যাংড়া মানুষটা দীর্ঘশ্বাসে দীর্ঘশ্বাসে আনমনা হয়ে যায়, তার অসহায় স্ত্রী আর মেয়েদের দিকে চোখ পড়ে তখন তার মন বলে, দুঃখ দুঃখ খেলাটাই জীবন নামক লাড্ডু। এই কথা ভাবতে ভাবতে মানুষটা চিতই পিঠার তাওয়ায় একদলা কাই ছেড়ে অপেক্ষা করে। সামনের বেঞ্চে এইমাত্র বসা ঢ্যাঙা ছেলেটা তার হাড়গিলা মেয়েটাকে আড়ে আড়ে দেখছে। এই দেখে তার বুকটা ছাৎ করে উঠে। ছোট-ছোট দুইটা মেয়ে নিয়ে সে পিঠার দোকানটা চালায়। নিজে প্রায় পঙ্গু। ভারী কোনো কাজ করতে পারে না বলেইতো পেটের দায়ে মেয়ে দুইটাকে নিয়ে বাজারে আসে। আর এখন কিনা এই এক রত্তি মেয়েটার দিকে…। নিজের দুর্দশার ভাবনাটা শেষ করার আগেই পিঠা-পোড়ার গন্ধ নাকে লাগে! লাগবে না? যার আস্ত জীবনটাই পুড়ে কাঠ-কয়লা হয়ে গেছে তার পিঠা তো পুড়বেই।
তাড়াতাড়ি তাওয়া থেকে তুলে এনে দেখে পিঠার বুকটা অঙ্গার কালো হয়ে গেছে। এইটা আর বিকবে না। ছোট মেয়েটা কলসি থেকে টিনের গ্লাসে পানি ভরছে। বড় মেয়েটা বাটিতে এক চিমটি ঝাল চাটনি নিয়ে অপেক্ষায়, পিঠা হলেই সামনে বসা বিটলা ছেলেটাকে দিবে।
সন্ধ্যার দিকে বিকিসিকি বেশি থাকে বলে বিকালে বড় মেয়েটাকেও সাথে আনে। দুইটা পিঠা হয়ে গেলে বড় মেয়েটা বাটিতে নিয়ে ছেলেটার সামনে এগিয়ে দেয়। মানুষটা আড় চোখে দেখে, ইতর পোলাটা বেহায়ার মতো এখনো তার বড় মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। শনের মতো লাল লাল চুল, পিত্তশূলের রোগীর মতো লিকলিকে হাত-পা, চোখে-মুখে কেমন একটা আছন্ন আছন্ন ভাব নিয়ে তার মেয়েটা সামনের আঘুন মাসে বার বছর পুরো করবে।
ছোট মেয়ে কলসি থেকে পানি ঢালতে গিয়ে ছল্লাৎ করে অনেকটা ফেলে দেয়। তার রাগ লাগে? হ, যার কিচ্ছু নাই তার রাগ ছাড়া কি আছে? তাই সে পিঠা উল্টানোর কাঠি দিয়ে মেয়ের পিঠে বাড়ি মারে। তারপর তার নিজের উপরই রাগ হয়। ঘিন্না হয়, কেন সে মরে না? মরলেই তো বাঁচে। জগতে মানুষের কতকিছু হয়: কেউ দালান তুলে, কেউ বিদেশ যায়, কেউ মজার মজার খাবার খেতে খেতে হাতির মতো মোটা হয়। আর বাঘের মতো বলবান মানুষটার পা দুইটা খামাখাই শুকিয়ে শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেল! দুইমণ ধানের বোঝা নিয়ে যে মানুষটা আধ মাইল দূরের মাঠ থেকে দৌড়ে বাড়ি আসতে পারতো সে এখন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটে! লাঠি? হ, ঘর থেকে পেশাব করতে গেলেও তার লাঠি লাগে।
ঢ্যাবা-ঢ্যাবা চোখের হাড়গিলা মেয়েটা মার খেয়ে শেয়ালে-ধরা মুরগির মতো কক্ কক্ করেও চেপে যায়। বাজারভরা মানুষ তাই কাঁদে না। কাঁদবে কেন? জগতের মানুষ জানুক আর না জানুক, তার মেয়েরা জানে: যার পেটে ভাত নাই, তার চোখে পানি নাই।
মরা মরা সন্ধ্যার আবছায়াকে তুড়ি মেরে সারা বাজার বিদ্যুতের ধারালো আলোতে ঝলসে উঠলে একটু আগের মারের কথা ভুলে গিয়ে ছোট মেয়েটা হকচকিয়ে ওঠে। কেন? হ, যাদের পেটের ক্ষিধা জগতের সব আলো গিলে খেয়ে ধুন্দাবুড়ার মতো অন্ধকারে উন্দা হয়ে পড়ে আছে তারা এলইডি বাল্বের ঝলমলা আলোতে হকচকিয়ে উঠবে না?
দোকানের সামনের পাকা সড়ক দিয়ে সাঁ করে একটা সিএনজি ছুটে যায়। তার পিছে পিছে দানবের মতো ছুটে আসে একটা ট্রাক। তার ধাপুটে বাতাস এসে দুই মেয়ের রুক্ষ-লাল চুল নাচায়। তারপর ঘ্যাৎ ঘ্যাৎ করে একটা লেগুনা এসে দাঁড়য়। মানুষটা বড়া-কাঠি দিয়ে পিঠা তুলতে-তুলতে সেই দিকে খেয়াল রাখে। লেগুনা থেকে দুইজন নামে। তাদের একজন এসে দোকানের দ্বিতীয় বেঞ্চটাতে লেপ্টে বসে। ভুঁড়িটা সামনের দিকে ঝুলে পড়ে,পিঠা আছে?
বহু দিনের লেনদেনে গলাটা চেনা। মানুষটা পিঠার তাওয়া থেকে চোখ তুলে। যখন সে নিরোগ আর সবল ছিল তখন এই লোকটার জমি বর্গা করত। খাতির-মহব্বতও ছিল। এখন সে ভিক্ষুকের মতো নিঃস্ব আর পঙ্গু। জন্মাবধি জল-মাটি-রোদের সাথে লড়তে-লড়তে কঠিন পেশীর বন্ধনে যে শরীরটা হয়ে উঠেছিল বাঘের মতো, মাত্র এক বছরের অসুখে সেই গতরটাই আজ শুধু একটা কঙ্কাল। বাড়ি থেকে কয়েক শ হাত দূরের এই বাজারটায় আসতে তাকে কম করে হলেও বারতিনেক পথে বসে দম নিতে হয়।
মানুষটা তাওয়া থেকে পিঠা তুলতে গিয়ে নিজের কব্জির চওড়া হাড়ের দিকে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এক বছর আগেও তাকে এই লোকটা কাছে পেলে কত আলাপ করত। তার মন-মাফিক তালের রসের মতো খাতিরটা সারা বছর জমিয়ে রাখতে চেষ্টা চালাত। চাষের রিত-বাতের কথা, কোন ক্ষেতে কতটা সার দিতে হবে তার কথা আর সে যে খুব খাটতে পারে সেই কথা সুযোগ পেলেই হরহর করে বলত। আর আজ অই মানুষটাই অচেনা মানুষের মতো বেঞ্চে বসে মোবাইল টিপে টিপে তাকে আড়ালে ফেলে রাখছে!
লেপ্টে বসা লোকটা দুইটা পিঠা আর একগ্লাস পনি খেয়ে ঢেকুর তুলে। মানুষটা তার সাবেক মহাজনের দিকে আর ফিরেও তাকায় না। প্রথম থেকেই সে খেয়াল করে দেখেছে, লোকটা একবারও তার দিকে তাকায়নি, খালি খালি মোবাইলের বাটন টিপেছে। পাঞ্জাবীর পকেটে মোবাইলটা রাখতে রাখতে লোকটা উঠে দাঁড়ায়।
কত হইছে?
মানুষটা আর এইসবকে পাত্তা দেয় না। তবে কী তাওয়ার পিঠায় সে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে? হ, যার সামনে অন্ধকার, পেছনটাও পচা গু, তার ভুলে থাকা ছাড়া উপায় কি?
↗️ মানুষটা তাওয়া থেকে পিঠা তুলতে গিয়ে নিজের কব্জির চওড়া হাড়ের দিকে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এক বছর আগেও তাকে এই লোকটা কাছে পেলে কত আলাপ করত। তার মন-মাফিক তালের রসের মতো খাতিরটা সারা বছর জমিয়ে রাখতে চেষ্টা চালাত। চাষের রিত-বাতের কথা, কোন ক্ষেতে কতটা সার দিতে হবে তার কথা আর সে যে খুব খাটতে পারে সেই কথা সুযোগ পেলেই হরহর করে বলত। আর আজ অই মানুষটাই অচেনা মানুষের মতো বেঞ্চে বসে মোবাইল টিপে টিপে তাকে আড়ালে ফেলে রাখছে!↙️
বাপ ব্যস্ত দেখে বড় মেয়েই হিসাব দেয়, টাকা সমঝে লয়। ভুঁড়িওয়ালা লোকটা পিচ রাস্তা টপকে ওপারের মাটির সড়কে নামলে সে মাথা তুলে। চলে যাওয়া লোকটার পিঠ-পাছা, ঘাড়ে বিদ্যুতের চকচকে আলো আর নাক-মুখের দিকে শরীরের ছায়া, থিকথিকে আন্ধকার। কেন যেন হঠাৎ তার অবশ-অবশ ডান হাত আর ভারী ঠোঁট জোড়া থিরথির করে কেঁপে ওঠে, হালা খচ্চর।
গালিটা উদগারের মতো বুক থেকে উঠে আসে। ফিসফিস করে দেওয়া গালিটার শব্দে তার দুই মেয়েই ডরুক চোখে টহরমহর করে।
পেছনের দোকানটা ফ্লেকসি লোডের। বাঁশের খুঁটির সাথে লাল, নীল,হলুদ রঙের তিনটা ছবি তামাম দিন-রাত একই ভাবে ঝুলে থাকে। ছবির মেয়ে তিনটাও শীত-গরম একই রকম ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে হাসে। পিঠার দোকানে ভিড় কম থাকলে তার ছোট মেয়েটা হা-করে সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা কী দেখে? হ, অনেক কিছু দ্যাখে। দ্যাখে দ্যাখে নতুন জামানা চিনতে চায়। পেতেও চায় কী? চাইবনা? চায়। কিন্তু কয় না। কানি বকের মতো রঙিন জিন্দিগির ছবক নিতে চায়! সে অনেক বার নিজেকে প্রশ্ন করেছে, মেয়েকে খেয়াল করে বিষয়টা ঠাওরাতে চেয়েছে কিন্তু আন্দাজ করতে পারে না! এক রত্তি মেয়ে,তবু ওর চোখের নজর, মুখের ভাব বড়ই জটিল।
বড় মেয়েটা খুব লক্ষী। তার কোনো চাওয়া নাই, রা নাই। নিঃশব্দে কাজের মাঝে ডুবে থাকে। বাপের দুক্কু বুঝে কী? হ, বোঝে। না বোঝলে কী আর মাঝে মাঝে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়? তার মুখ কালো হয়? গরিবের বুঝটাই আসল। ভাবতে ভাবতে তার জানি কেমন লাগে। কেমন লাগে? দুক্কু! দুক্কু! দুক্কু লাগে গ…
মানুষটা তার বড় মেয়ের চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে খুব সহজেই অনেক কিছু বুঝতে পারে। তার তো ভাষা নাই। বুকের ভিতর একটা বোধ আছে। সেই জিনিসটা তাকে বুঝিয়ে দেয়: সকালে কলমি পাতায় যেমন শিশির বিন্দু বসে থাকে তেমনি তার মেয়ের ছোট্ট বুকটায় বাপের জন্য একদলা দুক্কু আছে, দুক্কু…। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তারপর যেন সে বিড়বিড় করে বুড়ি দুনিয়াটাকেই জিগায়, গরিবের দুক্কুর কোনো দাম আছে?
সন্ধ্যায় পুবের বাঁশঝাড়ের মাথায় মস্ত-বড় চাঁদ উঠে। ফিনফিনা জোছনা ভরা চৈত্র মাসের রাত আসে। রাত? হ, গরিবের রাত-দিন সব সমান। মানুষটা ফিরতি পথে চলা থামিয়ে মোটা বাতরে বসে এখন ব্যাথায় আবশ পা দুইটা ঢলছে। এই নিয়ে দুইবার তাকে হাঁটা থামিয়ে দিতে হয়েছে। তার দুই মেয়ে দুই পাশে। ছোটটা বসে বসে ঘুমে ঢুলছে আর বড়টা চোখে-মুখে এক দলা কষ্ট নিয়ে বাপের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তার পাশের দশ কাঠার বিশাল ক্ষেতটা এবার তার চাচাত্তু ভাই ফজল মুন্সি বর্গা করেছে। বিকালে বাজারে যাওয়ার সময় সে ঠাহর করে দেখেছে; ধানের ফলন তেমন হয়নি। ভুঁড়ি ঝুলেপড়া সেই লোকটার এই ক্ষেতটা সে টানা দশ বছর চাষ করেছে। তার বুকের পাঁজরের মতো জানা-শুনা এই জমিনের রিতবাত ফজল মুন্সি ক্যামনে জানবে? রোদ-বৃষ্টি আর জল-কাদার মাখামাখিতে সেই দশ বছরের কথা এখন অকালে গর্ভ নষ্ট বউয়ের মরা সন্তান।
উত্তরের হলহলা বাতাস এট্টু এট্টু হিম আর ধানের মিঠা গন্ধ নিয়ে এলে তার ভেতরটা টলে ওঠে। আর সে যেন বিজলির চমকের মতো এক পলকে নিজের সারাটা চাষা-জিন্দিগী দেখে ফেলে। দুনিয়াদারির মতিগতি তার আর জানার কিছু বাকি নাই। কিন্তু তার এই অবুঝ দুই মেয়ে…। মানুষটা চেয়ে দেখে তার ছোট মেয়েটা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ক্ষেতের বাতরেই যেন শুয়ে পড়েছে! আর বড় মেয়েটা হাতের পোটলাটা কখন যেন রেখে দিয়ে বাপের বিষ-বেদনা ভরা অবশ পা দুইটা পরম মমতায় ঢলছে। পিতৃ-হৃদয় ডেকচির ফুটন্ত ভাতের মতো কী এক অনুভবে উথলে ওঠলে সে দুই মেয়েকে দুই হাতে ঝাপটে ধরে কোলে বসায়। মার খাওয়া বিড়ালের মতো ছোট মেয়েটা ভয়ে ভয়ে বাপের মুখের দিকে একবার তাকায়। মানুষটার বুক থেকে সেই আজব অনুভবটা হিরহির করে গলার কাছে এসে আটকে থাকে। বাকহারা মানুষটা এখন টের পায় তার দুই চোখে দুই ফোঁটা পানি এসে ঠাঁই নিয়েছে। পানি? হ, চোখের পানি। নারী লোভী রাক্ষস, লম্পট আর লুটেরায় গিজগিজ করা এই দেশে নিঃস্ব বাপের চোখে পানি ছাড়া তার অসহায় মেয়েদের জন্য আর কী থাকতে পারে? কী?
লেখক: শেখ লুৎফর, জন্ম ১৯৬৬, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ। স্নাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা : শিক্ষকতা। প্রকাশিত বই : গল্প— উল্টারথে [ঐতিহ্য, ২০০৮] ভাতবউ [ঐতিহ্য, ২০১৩] উপন্যাস— আত্মজীবনের দিবারাত্রি [ঐতিহ্য, ২০১০] কিশোর উপন্যাস— সুতিয়া নদীর বাঁকে [রূপসি বাংলা, ২০১৪] ই-মেইল : sheikh.lutfor32@gmail.com