হোটেল কোয়ারেন্টিন: প্রবাসীদের ভোগান্তি—অব্যবস্থা, প্রতারণা
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ মে ২০২১, ২:৫৩:৪১ অপরাহ্ন
অনুপম ডেস্ক : করোনার সংক্রমণ রোধে ৩৮টি দেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে ১ মে থেকে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। এই ৩৮টি দেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে আসলে তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রে আগতদের হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। তবে সরকার নির্ধারিত হোটেলের তালিকা প্রকাশ না করা, ভাড়া নির্ধারণ না করা, হোটেলের বুকিং অনলাইনে করতে না পারাসহ বিভিন্ন জটিলতার মধ্য পড়ছেন প্রবাসীরা। প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে প্রতারণারও অভিযোগও রয়েছে কোনও কোনও হোটেলের বিরুদ্ধে।
প্রবাসীদের অভিযোগ, সরকার নির্ধারিত হোটেলের নামসহ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। সরকারি কোনও সংস্থার ওয়েবসাইটেও এ বিষয়ে তথ্য নেই। ফলে কোন হোটেলে কোয়ারেন্টিন থাকতে হবে, তা জানেন না কেউই। অপরদিকে বিভিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হোটেলের তালিকা ছড়িয়ে পড়লেও সেখানে হোটেলের ভাড়া ও যোগাযোগের নম্বর উল্লেখ নেই। বাধ্য হয়ে বিদেশে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে হোটেল বুক করছেন প্রবাসীরা। সেক্ষেত্রে একই হোটেলের জন্য ভাড়া চাওয়া হচ্ছে এক এক জনের কাছে এক এক রকম। বুকিং করার জন্য হোটেল ভাড়ার সঙ্গে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে এজেন্টগুলো। যারা সরাসরি হোটেলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন— তাদেরকে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট কার্ড অথবা বিকাশের মাধ্যমে অগ্রিম টাকা পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রবাসী কর্মীদের বেশিরভাগেরই আন্তর্জাতিক পেমেন্ট কার্ড নেই। এছাড়া বিদেশে মোবাইল ব্যাংকিং নিষিদ্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে তাদের। কেউ কেউ বাধ্য হয়ে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সহযোহিতায় অবৈধভাবে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন। দেশে আসার পর হোটেলগুলোর সেবা ও খাবারের মান নিয়েও অভিযোগ প্রবাসী কর্মীদের।
এক প্রবাসী দুবাই থেকে হোটেল বুক করতে না পেরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে উত্তরায় ব্লু ক্যাসেল হোটেলে রুম বুক করেন। কিন্তু ২৯ এপ্রিল বিমানবন্দর থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘সী শেল’ হোটেলে। যদিও সরকার অনুমোদিত ৫২টি হোটেলের তালিকায় নেই সী শেলের নাম। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। হোটেলে গিয়ে খোরশেদ আলম দেখতে পান— তার রুমে আরেকজন গেস্ট আছেন। অথচ প্রতিদিন ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে সিঙ্গেল রুম ভাড়া নিয়েছিলেন ঐ প্রবাসী।
তিনি দুবাই প্রবাসী খোরশেদ আলম। জানালেন, ‘আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সী শেল হোটেলে। অথচ সরকার নির্ধারিত ৫২টি হোটেলের তালিকায় আমি এই হোটেলের নাম দেখিনি। সিঙ্গেল রুম ভাড়া নিয়েছিলাম, অথচ হোটেলে প্রবেশ করে দেখি অন্য মানুষের সঙ্গে রুম শেয়ার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ওই হোটেলে সবার একই রকম অবস্থা। রুম শেয়ার করলেও সবার কাছ থেকেই তারা দিনপ্রতি ৩৫০০ টাকা করে ভাড়া নিচ্ছে।’
ব্লু ক্যাসেলের পরিচালক মহিউদ্দিন খান সুজন বলেন, ‘আমাদের ৩টি হোটেল। যখন যেখানে খালি থাকছে সেখানেই গেস্টদের রাখা হচ্ছে। নাম ভিন্ন হলেও আমাদের ব্যবস্থাপনা একই। ব্লু ক্যাসেল নামে আমরা সরকারের অনুমোদন নিয়েছি। কোনও যাত্রী তো আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি।’
কাজী জাহিদুল ইসলাম কাতার থেকে দেশে আসার আগেই তারিক ট্রাভেলস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিন দিনের জন্য হোটেল বুক করেন। সেজন্য তাকে দিতে হয় ৮২০ কাতারের রিয়াল, যা বাংলাদেশি টাকায় ১৯ হাজার ১৮০ টাকা। দেশে আসার পর গুলশানের nascent gardenia নামের হোটেলে ছিলেন তিনি। তিন দিনের জন্য তার বিল করা হয় ১৪ হাজার ১০০ টাকা। কাতারে থাকা এজেন্সি শুধু মাত্র বুকিং করার জন্য তার কাছ থেকে নিয়েছে ৫ হাজার ৮০ টাকা।
কাজী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘হোটেলটির ভাড়া অনুসারে খাবারের মান অতটা ভালো না। আমি এই হোটেলে ২৯ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত ছিলাম। ভাড়া দিতে হয়েছে প্রতি দিন ৪ হাজার ৭০০ টাকা করে। তিন দিনে ১৪ হাজার ১০০ টাকা। আমি জানি না সরকার আসলে কত টাকা ভাড়া নির্ধারণ করেছে। তারা ভাড়া বেশি নিলো কিনা। অভিযোগ কোথায় দেবো তারও কোনও ব্যবস্থা নেই।’
কাতার থেকে আসা সব প্রবাসীকেই এমন অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে বলে জানান কাজী জাহিদুল।
সিঙ্গাপুর থেকে ৬ মে দেশে আসবেন মনির হোসেন। আগের নিয়ম অনুসারে কোয়ারেন্টিনের জন্য হোটেল বুকিং দিয়েছিলেন তিনি। বেবিচকের নতুন নিয়ম অনুসারে তার হোটেলে থাকার প্রয়োজন নেই। এখন কি হোটেল বুকিংয়ের টাকা ফেরত পাবেন, প্রশ্ন মনির হোসেনের। তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত এ বিষয়ে পরিষ্কার ঘোষণা দেওয়া। এখন যদি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকা না লাগে, তবে অবশ্যই সরকারের উচিত নিয়ম করা, যাতে হোটেলগুলো টাকা ফেরত দিয়ে দেয়। এমনিতেই আমরা অনেকেই চাকরি হারিয়ে এক কাপড়ে দেশে আসছি। এখন আমাদের কাছ একটা টাকাও অনেক কিছু। এভাবে আমাদের পদে পদে ভোগান্তিতে ফেলার মানে হয় না।’
সাইদুর সোহান দুবাই থেকে এসে হোটেলে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। দেশে থাকা তার ভাইয়ের মাধ্যমে মতিঝিল এলাকায় হোটেল রহমানিয়া ইন্টারন্যাশনালে তিন দিনের জন্য রুম বুকড করেছিলেন। ২৭ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ছিলেন সেই হোটেলে ছিলেন তিনি। সাইদুর সোহান বলেন, ‘রমজান মাস, তাই সকালের খাবার না দেওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাতের খাবারে তারা দিয়েছে ১টি কলা, ১ পিস কেক। বাধ্য হয়ে আমাকে রাতে বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে হয়েছে। তাদের হোটেলে মানের তুলনায় ভাড়া অনেক বেশি। ওয়ান স্টার মানের হোটেলের মধ্যেও তারা পড়বে বলে মনে হয় না। অথচ ভাড়া তিন দিনের জন্য ২২ হাজার ৫০০ টাকা।’
দোহা থেকে রবিউল ইসলাম, মোহাম্মদ হাসান, শামিম আহমেদ, শফিকুল ইসলাম, নাহিদুল ইসলাম— এক সঙ্গে এই ৫ জনের গত ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। হোটেল বুকিংয়ের জটিলতায় তারা আসতে পারেননি সেদিন। এ জন্য হোটেলের ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন তারা। একই সঙ্গে তারা উত্তরায় ‘অ্যাফোর্ড ইন’ নামের একটি হোটেলের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন।
নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দোহা থেকে ৩০ এপ্রিল সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে ফ্লাইট ছিল। আমরা জানতাম বাংলাদেশে গিয়ে হোটেল বুকিং করা যাবে। কিন্তু দোহা বিমানবন্দরে এসে জানতে পারলাম, ফ্লাইটে ওঠার আগেই হোটেল বুকিং করতে হবে। আমাদের পরিচিত যারা আগে দেশে গেছেন, তাদের মাধ্যমে অ্যাফোর্ড ইন নামের একটি হোটেলের নম্বর পাই। আমরা সকাল সাড়ে ৬টার দিকে হোটেলের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা (হোটেল কর্তৃপক্ষ) ৫ জনকে একটি শেয়ার রুম দেওয়ার কথা বলে। তারা জানায়, ৫ জন এক রুমে শেয়ার করে থাকার জন্য দিনে ১২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে। আমাদের জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে অগ্রিম দিতে বলে। আমরা সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে ২০ হাজার টাকা বিকাশ করি। এরপর আর হোটেলের লোকজনের কোনও খবর নেই। তারা আমাদের ফোনও ধরে না। সকাল ৮টা ২৯ মিনিটের দিকে তারা আমাদেরকে হোটেল বুকিংয়ের কাগজ পাঠায়। কিন্তু সেই কাগজ পাওয়ার পরে দেখতে পাই— ফ্লাইটের বোডিং শেষ, আমরা আর যেতে পারবো না। বোডিং কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ বুকিংয়ের কাগজ পাঠাতে দেরি করায় আমরা ফ্লাইট মিস করলাম। তখন আমরা টাকা ফেরত চেয়ে যোগাযোগ করলে হোটেলের কেউ আর ফোন ধরে না, আবার কল ধরলেও তা কেটে দেয়।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও অ্যাফোর্ড ইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম নূরুন নবীর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।’
এসব অনিয়মের বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, ‘সবার আগে প্রয়োজন ছিল ভাড়ার তালিকা, যোগাযোগের নম্বরসহ হোটেলগুলোর নাম প্রকাশ করা। সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইটে সেই তালিকা প্রকাশ করা। তাহলে প্রবাসীদের বুকিং সংক্রান্ত জটিলতায় পড়তে হতো না। আর ঠিক মতো সবকিছু হচ্ছে কিনা, তা তদারকির জন্য মনিটরিংও জরুরি। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সহজে ভোগান্তি কমবে না।’