ইরান-আরব হাজার বছরের বিবাদ শেষ করতে পারবে কি সৌদি যুবরাজ?
অনুপম নিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ এপ্রিল ২০২১, ২:১০:২৫ অপরাহ্ন
“আমাদের অবস্থান একদম পরিস্কার করি: পারস্য উপসাগর অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্যে বাইরের কারো কোন চেষ্টাকে আমেরিকার অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থে হামলা বলে ধরে নেয়া হবে। আর তেমন হামলা প্রতিহত করা হবে যেকোনোভাবে। সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে হলেও করা হবে।”
:: সারওয়ার চৌধুরী ::
বিশ্বের প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলোতে গতকালের একটি শীর্ষ সংবাদ—
‘সৌদি আরবের যুবরাজ মুহাম্মাদ বিন সালমান বলেছেন, ইরান তাদের প্রতিবেশী দেশ এবং তিনি আশা করেন তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে।’
কতটকু কী করতে পারবে সৌদি ঐ যুবরাজ, একটু ইতিহাসের আলোকে দেখা যাক:
আইএসআইএস আমেরিকার সৃষ্টি মর্মে বিভিন্ন মিডিয়াতে খবর/প্রতিবেদন/কলাম এসেছিল ২০১৬ সালে। তখন ৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলার রাজস্ব এসেছে আমেরিকার শুধু মধ্যপ্রাচ্যে ২০১৫ সালে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে। (ডেইলি সাবা, মার্চ ২৯, ২০১৬) এর মধ্যে ২১ বিলিয়নের অস্ত্র কিনেছে সৌদিআরব, ইসরাইল কিনেছে ১.৯ বিলিয়নের সামরিক সরঞ্জাম, যেগুলো আইএসআইএসকে সরবরাহ করা হয়েছে বলে মিডিয়াতে বিস্তর তথ্য ও আলাপ এসেছিল। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট জানিয়েছিল, আইএসের অস্ত্র মেইড ইন ইউএসএ ও রাশিয়া এবং কিছু অস্ত্র রাশিয়ার বানানো কিন্তু তা ইরাক থেকে চুরিকৃত। চীন তো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাশিয়ার সাথে।
রাশিয়া আমেরিকা চীন মধ্যপ্রাচ্যে দিবানিশি ব্যস্ত। পড়িমরি দৌড়-ঝাপ, কী কারণে? সহজ জবাব তাদের স্বার্থে। তাদের স্বার্থ ওখানে কেন? আরেকটি সহজ জবাব বিশ্বগ্রামের রাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। আর, এও অন্যতম প্রধান কারণ আরব ও পারস্য দেশের মানুষদের হাজার বছর ধরে আসা বংশানুক্রমিক মতবিরোধ।
আরব আর ইরানের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভেদ খুব শক্তপোক্ত। মধ্যপ্রাচ্যে দুই যুগের বেশি সময় থাকাকালে আমি আরবকে বলতে শুনেছি, ইরানিরা অগ্নিউপাসক, রগচটা। তাদের আমরা ইসলাম দিয়ে আলোকিত করেছি। ইরানিকে বলতে শুনেছি, আরব হল, রাখাল জাতের মানুষ, যাযাবর, অসভ্য, বেকুব। উভয় তরফের এসব কথায় সত্যমিথ্যার মিশ্রণ রয়েছে। তবে দুই তরফেই সামান্য সংখ্যক মানুষ বংশানুক্রমে আসছেনই যারা সাংস্কৃতিক গোঁড়ামির বাইরে থাকেন।
আরব দেশগুলোতে লাখ লাখ ইরানি থাকছেন ব্যবসা করছেন। বহু ইরানি কুয়েত কাতার ইমারত সৌদিতে এসে আরব নাগরিকও হয়েছেন। সুন্দর স্থানীয় আরবী ভাষা বলেন। ইরান ইরাক সীমান্তবর্তী এলাকায় ইরানের অভ্যন্তরে লাখ লাখ আরব আছেন। ইসলামের ইতিহাসে আরব ও ইরানের জ্ঞানী গুণী যুগ সংস্কারক, ফকিহ, বিজ্ঞানী, আউলিয়া আছেনই। তালিকা অনেক লম্বা।
বেশি আগে না যাই, মাত্র আড়াই হাজার বছর ধরেই পার্সী আর আরবের রেষারেষি, ধর্মীয় বিভেদ, জাত্যাভিমান, পারস্পরিক তাচ্ছিল্য আর আস্থাহীনতা চলে আসছে। ১৯৭৯-তে ইরানে বিপ্লবের আগে ও পরে আরব ইরান রেষারেষির সুযোগ নেয় আমেরিকা। আরবরা ইরানকে মোকাবেলা করতে বড় শক্তিকে পাশে আনে। এখনও তেল গ্যাস বাণিজ্য ভাগাভাগিতে আরব ইরান ঠেলা-ধাক্কা শক্তিশালী দেশগুলোকে লুটবার সুযোগ দিচ্ছে।
লুটছে? হ্যাঁ ব্যবসায়িক অংশীদার হিসাবে যতটুকু নেয়ার, তার চেয়ে বেশি নিচ্ছে ছল-চাতুরী করে।
‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’ রূপ ধরে বৃটিশ এসেছিল উপমহাদেশে। হয়েছিল শাসক। আমেরিকা বিশ শতকের গোড়ার দিকে পারস্য উপসাগরের তেলের উদ্দেশ্যে আরবে আসে ‘ফ্রেন্ডলি অয়েল প্রডিউসার’ হিসাবে। প্রাচীন কায়দায় দখল নেয়া আমেরিকার স্ট্রাটেজি না। দখলদারিত্বের আধুনিক রুপ হল, ব্যবসায়িক চুক্তির মাধ্যমে বান্ধা রাখা এবং আমেরিকাকে সুযোগ সুবিধা দেয় এমন শাসক ক্ষমতায় রাখা। এভাবে কব্জায় রাখার অন্যতম প্রধান কারণ তেলের বাজার মূল্য স্থিতিশীল রাখা। নইলে আমেরিকার তেল ব্যবসারও বারোটা বাজবে। তেল সমৃদ্ধ আরব দেশগুলো কম দামে তেল বিক্রি করলে আমেরিকার মানুষের কপাল পুড়বে, অর্থনীতি মন্দা হবে। বিশ্বঅর্থব্যবস্থায়ও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এখানে উল্লেখ্য, আমেরিকার ফরেন পলিসি নিয়ে কথা মানে ঢালাওভাবে আমেরিকার মানুষের প্রতি বিদ্বেষ রাখা নয়। আমেরিকান মানেই বুনিয়াদি রেড ইন্ডিয়ানদের বংশধর না। এশিয়া আফ্রিকা দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের মানুষের বংশধরেরা আমেরিকান হয়েছে। আমেরিকা দেশটিও তার সমস্যা নিয়ে পেরেশান। তাদের ফরেন পলিসি এও দেখাচ্ছে যে, ‘অধীন হয়ে বাঁচবো কেন? অধীন করে বাঁচবো’ বা ‘বুদ্ধি দিয়ে পারলে আমারেও আটকাও’। বা ‘তোমারে সাহায্য করবো, আমারে তুমি বদলা দাও’। কিন্তু প্রশ্ন হল, তোমার স্বার্থ দেখতে গিয়ে তুমি ছল-চাতুরী করে ধুমসে নিতে থাকবে কেন?
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার স্বার্থ কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট-
“Let our position be absolutely clear: An attempt by any outside force to gain control of the Persian Gulf region will be regarded as an assault on the vital interests of the United States of America, and such an assault will be repelled by any means necessary, including military force.” —Jimmy Carter, state of the union address, Jan. 23, 1980
মানে কার্টার বললেন,
“আমাদের অবস্থান একদম পরিস্কার করি: পারস্য উপসাগর অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্যে বাইরের কারো কোন চেষ্টাকে আমেরিকার অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থে হামলা বলে ধরে নেয়া হবে। আর তেমন হামলা প্রতিহত করা হবে যেকোনোভাবে। সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে হলেও করা হবে।” – জিমি কার্টার, স্টেট অব দি ইউনিয়ন এড্রেস, জানুয়ারী ২৩, ১৯৮০। (অক্সফোর্ড জার্নালস)
একটু বলা যাক, সিরিয়া ইস্যুতে রাশিয়া সামরিক শক্তি প্রয়োগের সুযোগ পেলো কেমনে? সিরিয়ার ভেতর দিয়ে কাতার প্রস্তাবিত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে বাশার একমত হন নি। এই না হওয়ার ব্যাপারটা আসলে আমেরিকার স্বার্থকে আঘাত করেছে। কাতার আমেরিকার মিত্র, সেখানে আমেরিকার ঘাঁটিও আছে।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, আমেরিকা কর্তৃক সাদ্দাম হোসেনকে উস্কে দিয়ে ইরান আক্রমণ করানো এবং দীর্ঘ সাত বছর যুদ্ধ চলাকালে এক পর্যায়ে দুনিয়া দেখলো রিগান-গরবাচেভ আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন। সাদ্দামকে সরানোর জন্যে আমেরিকার নেতৃত্বে কোয়ালিশন ফোর্স যখন ইরাকে হামলা চালিয়েছিল, তখন এই পুটিন “গ্রেট পলিটিক্যাল এরর” বলেই চুপ থাকলেন। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি মস্কো গেলেন। তারা দুইয়ে মিলে সিরিয়ার আইএসকে মারতে একমত হলেন। এই ঐকমত্যের মানে এই নয় যে, আমেরিকার মিত্র দেশ, যেমন সৌদি, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ইত্যাদি কারও বিমান বন্দর রাশিয়া ব্যবহার করে মারতে পারবে। রাশিয়া মেরেছিল তার মতলবের মিত্র ইরানের এয়ারবেইস ব্যবহার করে। এরিমধ্যে ২০১৬ সালের জুলাই মাসে রাশিয়া ইরানকে ২২০ কোটি ইউরো ঋণ দেবার ব্যাপারে একমত হয়েছিল।
আমার এক ইরানি বন্ধু সুন্নি মুসলিম। তার সাথে আলাপ করি মাঝে-মধ্যে তার এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা উন্নয়ন, সুন্নিদের সাথে শিয়ার আচরণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে। তিনি জানালেন, না, শিয়ারা কোনো খবরদারী করে না, অত্যাচার করে না। আমাদের এলাকায় বড় শিয়া আলেম কেউ কোনো কারণে এলে সুন্নি মসজিদে নামাজ পড়েন, এবং ঐ মসজিদের সুন্নি ইমামের ইমামতিতেই নামাজ পড়েন। একদিন জানতে চাইলাম, সরকারি উঁচু পদে সুন্নিরা চাকরী পান কিনা? জানালেন, পান তবে কম, বেশি শিয়াদেরকেই বসানো হয়।
একটু বেশি দ্বীন দুনিয়ার খবর রাখেন এমন কেউ কেউ বলেন, সৌদির বর্তমান শাসক বংশ ‘আহলে সৌদ’, এরা আবদুল ওয়াহাব নজদির অনুসারী, এরা ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে শিয়াদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় বেশি। মিত্র পরাশক্তি আমেরিকাও তাদের মতামতের পক্ষে থাকে। ইরানে শিয়া বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনি শিয়া মতাদর্শ আরব দেশগুলোতেও ছড়িয়ে দেবার ঘোষণা দেয়ায় উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর শাসকেরা ইরানের ব্যাপারে বেশি সতর্ক হয়ে ওঠে। উপসাগরীয় সবচেয়ে বড় আরব দেশ সৌদি আরব ইরানের তৎপরতার ব্যাপারে কড়া নজর রাখে সব সময়। এই সচেতনতার কারণেই ইয়েমেনে সৌদি জোট সবাই মিলে শিয়াপন্থীদের উপর হামলা চালায়।
ইরান সিরিয়ার বাশারকে সমর্থন করছে আঞ্চলিক স্বার্থে। ইরান চায় আমেরিকা সমর্থিত আরব গ্যাস পাইপলাইনের বিপরীতে ইরানের গ্যাস পাইপলাইন যাক সিরিয়া হয়ে ইউরোপে।
এই যে আরব ইরান সাংস্কৃতিক আড়াআড়ি, রাজনৈতিক রেষারেষি, ক্ষমতার বিবাদ; এসবের সমাধান কি দিতে পারবেন মুহাম্মাদ বিন সালমান ? রাজনীতির সহজ হিসাব দেখায়, সৌদি—ইরান ‘ভাল সম্পর্ক’ করতে হলে আমেরিকার জোট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সৌদি আরবকে। পারবে কি?
সারওয়ার চৌধুরী: কবি, কলামিস্ট, অনুবাদক